বিলাত প্রবাসীদের অবিস্মরণীয় ভূমিকা

বিলাত প্রবাসীদের অবিস্মরণীয় ভূমিকা

৭ মার্চ ডাকা সর্বদলীয় সভায় প্রায় ১০ হাজার বাঙালি জড়ো হন। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া এ সভায় যোগ দেওয়া মানুষেরা পুনরায় পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তিন ঘণ্টাব্যাপী যানজটে বন্ধ থাকা সেন্ট্রাল লন্ডনের আটকে পড়া পথচারীরা বিন্দুমাত্র অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেনি সেদিন।

মার্চ মাস, বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি চির শাশ্বত মাস। সময়ের নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সাফল্যমণ্ডিত বাংলাদেশ সত্তাটি ৪৮ বছরের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে জানা-অজানা অসংখ্য নারী-পুরুষ অপরিসীম আত্মত্যাগের মাধ্যমে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন ১৯৭১ সালটিকে। আর এ অকুতোভয় জনতার একটি বড় অংশই হলো বিলেত প্রবাসী বাঙালিরা।
স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের সূচনার গল্পটি ১৯৫২ সালের রক্ত রাঙা ফাগুনের পথ ধরেই এসেছিল। প্রবাসী বাঙালিরা বরাবরই অধিকার সচেতন। আর ‘তৃতীয় বাংলা’ বলে সুপরিচিত বিলেতবাসী বাঙালি আরেকটু এগিয়ে। মুক্তিসংগ্রামের বার্তা সমগ্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসের শেষ ভাগে বার্মিংহাম ১৫ নম্বর ডাউন স্ট্রিটের আস্টনে ‘ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট’ নামে ৩০ সদস্যের একটি সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। সবার সম্মতিক্রমে এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মরহুম আব্দুস সবুর চৌধুরী। আর সেক্রেটারি নির্বাচিত হন মরহুম আজিজুল হক ভূঁইয়া। এই ফ্রন্টের মুখপত্র ছিল ‘বিদ্রোহী বাংলা’, যা প্রতি ১৫ দিন পরপর প্রকাশিত হতো মোস্তাফিজুর রহমানের তত্ত্বাবধানে। সচেতনভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের শোষণ নীতি এতে গুরুত্ব সহকারে ছাপা হতো।
কমিটির কার্যক্রম শুধু অফিসকেন্দ্রিক নয়, বরং গণমানুষের কাছে পৌঁছানোর প্রয়াসে ১৯৭০ সালের ২৯ নভেম্বর বার্মিংহামের দিগবাত সিবিক এলাকায় এক জনসভার আয়োজন করা হয়। বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি, ভারতীয় ও স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশি এতে উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানের তৎকালীন বিখ্যাত ছাত্রনেতা তারেক আলীর উপস্থিতিতে একটিমাত্র কথাই উচ্চারিত হতে থাকে সভাস্থ জনতার মুখে মুখে—‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই’। আন্দোলন বাস্তবায়নের জন্য নানা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। এদিকে ওত পেতে থাকে পাকিস্তানের গুপ্তচর সিআইডি।
বিশ্বজনমতকে সোচ্চার করতেই ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ কাকডাকা ভোরে কমিটির সদস্যদের নিয়ে একটি কোচ বার্মিংহাম থেকে লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বিদ্রোহী বাঙালিরা সাহসের সঙ্গে পাকিস্তান হাইকমিশন কার্যালয় ঘেরাও করে পাকিস্তানি পতাকা ও স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার প্রতিকৃতিতে আগুন দেয়। ‘ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টের’ সেক্রেটারি আজিজুল হক স্বাধীন বাংলার স্মারকলিপি পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুলেমান আলীর হাতে তুলে দেন। দীর্ঘ সময়ব্যাপী সাহসী বাঙালিরা কমিটির নেতৃত্বে সভা, মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিদ্রোহের এ বিস্ফোরিত আগুনটি অল ইন্ডিয়া রেডিও ও ভয়েস অব আমেরিকা বারবার প্রচার করতে থাকে। সেদিনের পোড়া পাকিস্তানি পতাকাটিই ছিল বিবিসি সংবাদের অন্যতম হেডলাইন। বিশ্বের আনাচে-কানাচে প্রতিবাদমুখর বাঙালিরা একযোগে জেগে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ঢেউটি আছড়ে পড়ে সুদূর বিলেতেও। ৭ মার্চ ডাকা সর্বদলীয় সভায় প্রায় ১০ হাজার বাঙালি জড়ো হন। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া এ সভায় যোগ দেওয়া মানুষেরা পুনরায় পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তিন ঘণ্টাব্যাপী যানজটে বন্ধ থাকা সেন্ট্রাল লন্ডনের আটকে পড়া পথচারীরা বিন্দুমাত্র অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেনি সেদিন। তৎকালীন মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে বলা হয়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর লন্ডনে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় সমাবেশ।
২৫ মার্চের কালরাত্রিতে শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইট নামের সে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। হতাশ, মুষড়ে পড়া স্বদেশিদের চাঙা করতেই মানুষের কানে কানে পৌঁছানো হয় সে অমোঘ মন্ত্রটি, ‘দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে’। ২৭ মার্চ হাজার হাজার স্বতঃস্ফূর্ত জনতার পদচারণায় ভরে ওঠে বার্মিংহামের স্মলহিথ পার্ক। অতি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার আন্দোলনের বৃহত্তর স্বার্থেই লিবারেশন ফ্রন্টকে বিলীন ঘোষণা করে মরহুম জগলুল হক পাশাকে প্রেসিডেন্ট ও পূর্বোক্ত সেক্রেটারি পদটি অবিকল রেখে গঠন করা হয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি। কমিটির প্রতি দিনের কার্যক্রমে ব্যয়িত অর্থের হিসাবপত্রের প্রকৃত বিবরণীটি ঠিকভাবে পাওয়ার উদ্দেশ্যে মোহাম্মদ ইসরাইলকে নতুন কমিটির নির্দেশিত অডিট কমিটির চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত করা হয়। বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। তবে জাতির পিতার সার্বক্ষণিক সংবাদ যে তাঁদের চাই-ই চাই। অলক্ষ্যে থেকেও যে তিনি মুক্তিকামী বাঙালির সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা, যুদ্ধরত দামাল মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্য সাহস। আর তাই নেতার সঠিক খবর জানতে অ্যাকশন কমিটি ৫০০ পাউন্ড ব্যয়ে ব্যারিস্টার কিউ সি উইলিয়ামসকে পাকিস্তানে পাঠায়। খবর আসে, চার দেয়ালের ওই অন্ধকার কারাগারে বহাল তবিয়তেই আছেন তিনি।
গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সে সময় প্রতি দিন বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে একটা এজেন্ডায় আলোচনা করা হতো। ব্রিটেনের বর্তমান রানি এলিজাবেথ সে সময় ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সংবাদ জেনে তাঁকে জীবিত রাখা ও তাঁর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়ার জন্য পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এক সতর্কবার্তায় হুঁশিয়ার করেন।
পরবর্তীতে রানির পদাঙ্ক অনুসরণ করেই ৩ মে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দীর্ঘকাল বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে মোট ৩০০ জন এমপি বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে একমত হয়ে ব্রিটিশ সরকার থেকে বিপুল গোলা-বারুদসহ অন্যান্য সাহায্য পাকিস্তানকে দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২৭ মার্চের স্মলহিথ পার্কের সফল জনসমাবেশ দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছিল প্রবাসীদের। ২৮ মার্চ স্বাধীন বাংলার গৌরবময় পতাকা সেই পার্কে উত্তোলন ও মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারীদের একটি সুলিখিত তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে অ্যাকশন কমিটি দেশের প্রতি তার দায়বদ্ধতা প্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর ওসমানি সে সময় তাঁর বিজ্ঞ মতামত ব্যক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক কিশোর-তরুণের সংখ্যা নেহাত কম নয় দেশে! আর প্রবাসে স্বদেশের জন্য আন্দোলন, এ তো আরেক মুক্তিযুদ্ধ! তাঁর এ প্রাজ্ঞ মতামতের ফলাফল হয় চমকপ্রদ। ফোন করে ও বার্মিংহাম থেকে লোক পাঠিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মিডলইস্টসহ সর্বমোট ৮৫টি দেশে অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়, যারা একযোগে দুর্বার গতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য কাজ করে যেতে থাকে অবিরাম। তবে কেন্দ্র থেকেই সমস্ত কিছুর উৎপত্তি, আর এ কেন্দ্রকে ঘিরেই আবর্তিত হয় সবকিছু। এ অতীত সত্য বাক্যটিকে সামনে রেখেই সব অ্যাকশন কমিটির কার্যক্রম একত্রে পরিচালনা করতে মরহুম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রেসিডেন্ট ও আজিজুল হক সাহেবকে পুনরায় সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি ২৪ এপ্রিল কভেন্ট্রিতে গঠন করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই স্টিয়ারিং কমিটি বিশ্বজোড়া মোট ৮৫টি অ্যাকশন কমিটি থেকে মোট ৪ লাখ ৬ হাজার ৮৫৬ পাউন্ড চাঁদা তুলতে সমর্থ হয়। এ থেকেই কমিটি পরিচালনা বাবদ ৩৩ হাজার ২১২ পাউন্ড ব্যয় করা হয়। অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসরাইল সে সময় পূর্ণাঙ্গ হিসাব বিবরণীটি বাংলাদেশ ফান্ডের হিসাবরক্ষক জেনারেল কাজী মুজিবুর রহমানের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে মানসিকভাবে চাঙা রাখতে বিপুল ভূমিকা রাখেন।

(সূত্রঃ আফতাব চৌধুরী, প্রথম আলো , ২৯ সে মার্চ ২০১৯)