অনেকেই অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষাব্যাবস্থা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দে থাকেন। কিভাবে ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা করবেন এই ভাবনার অন্ত নাই বাবা-মায়ের মধ্যে।
অস্ট্রেলিয়ার সব রাজ্যের মধ্যে নিউ সাউথ ওয়েলসের শিক্ষা ব্যবস্থা একটু ভিন্ন ও খুবই প্রতিযোগিতামূলক। প্রাথমিক পর্যায়ে এই প্রতিযোগিতা শুরু হয় অপর্চুনিটি স্কুল পর্যায়ে। নিউ সাউথ ওয়েলসে মোট ৭৬টি সরকারি স্কুলকে পঞ্চম শ্রেণীতে অপর্চুনিটি ক্লাস করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ১৭৪০ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য সংরক্ষিত আসনে মোট ১১১১০ জন পরীক্ষায় অংশ নেয়। অপর্চুনিটি স্কুলের পরীক্ষা হয় সাধারণত জুলাই / অগাস্ট মাসে চতুর্থ শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় এবং অপর্চুনিটি স্কুলটি চলে দুই বছর। পরবর্তীতে সপ্তম শ্রেণীতে শুরু হয় হাই স্কুলের যাত্রা। আর সিলেকটিভ স্কুল টেস্টের জন্য সংগ্রাম শুরু হয় পঞ্চম শ্রেণী থেকেই।
হাইস্কুলের মধ্যে থেকে বাছাই করা কিছু সরকারি স্কুলকে সিলেকটিভ স্কুল / আধা -সিলেকটিভ স্কুল হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। নিউ সাউথ ওয়েলসে সর্বমোট ২১টি সম্পূর্ণ সিলেকটিভ স্কুল এবং ২৬ টি আধা-সিলেকটিভ আছে এবং ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট ৪২২৬টি সংরক্ষিত আসনে প্রায় ১৫,০০০ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহন করে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ,সেলেকটিভ টেস্টে চারটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। ইংরেজি রিডিং (Reading ) এ থাকে ৪৫টা প্রশ্ন,ম্যাথেমেটিকস (Mathematics) এ ৪০টা প্রশ্ন , জেনারেল এবিলিটি ( General Ability ) তে থাকে ৬০টা প্রশ্ন এবং রাইটিং (Writing ) এ থাকে ২০ মার্ক্স। সেলেকটিভ টেস্টের মার্কের সাথে স্কুলে দেয়া টেস্টগুলোর মধ্য থেকে দুটি বিষয়ের (ইংরেজি (English) ও ম্যাথেমেটিকস (Mathematics)) মার্ক্স যোগ হয়।
৬ জুলাই ২০১৮ তারিখ সন্ধ্যায় শুরু হয় উদ্বিগ্ন পিতামাতাদের প্রতীক্ষার পালা,যার শেষ হয় নিউ সাউথ ওয়েলস পাবলিক এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে মাগদা পোলাক এর প্রতীক্ষিত ইমেইলটি প্রাপ্তির পর । এই ইমেইলটিতে উল্লেখ থাকে পরীক্ষার্থীর দেয়া তিনটি পছন্দের স্কুলের মধ্যে কোনটিতে তাকে অফার দেয়া হয়েছে এবং তা গ্রহণ করতে ২৩ শে জুলাই, ২০১৮ এর মধ্যে অভিভাবকের স্বাক্ষরসহ নির্দিষ্ট ঠিকানায় অথবা ইমেইল এ পাঠাতে বলা হয়েছে। এছাড়াও দ্বিতীয় পাতায় থাকে পরীক্ষার্থীর অর্জিত মার্কের বিবরন।
সিলেকটিভ স্কুল টেস্টে অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশী ছেলে মেয়েরা :
অস্ট্রেলিয়ান বাঙালি কমিউনিটিতে ২০১৮ সালের কিছু মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী:
২০১৮ সালের সিলেকটিভ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ান বাঙালিদের মধ্যে সামিদ হাসান সৰ্বোচ্চ নম্বর (২৬০.৩৯) নিয়ে লুমিয়া পাবলিক স্কুল থেকে সিডনি বয়েজ হাই স্কুলে এ অফার পেয়েছে। তার বাবা মোঃ ইমরুল হাসান এবং মা স্মৃতি হাসান। তার বাবা জানান, সামিদ এর সাফল্যের পিছনে ছিল সামিদের একাগ্রতা। সামিদের পড়ালেখায় প্রি-ইউনি কোচিং সেন্টারের পাশাপাশি তিনিই সাহায্য করতেন। সামিদের পছন্দ বই পড়া।
ইউয়াশা কবির, লুমিয়া পাবলিক স্কুল থেকে সিডনি বয়েজ হাই স্কুলে অফার পেয়েছে। তার বাবা মোহাম্মদ কবির এবং মা মোসাম্মাৎ দেওয়ান ফাতিমা। বাবা কবির জানান, ইউয়াশা পড়ালেখার পাশাপাশি বই পড়তে ও ডকুমেন্টারি মুভি দেখতে পছন্দ করে এবং বাস্কেট বল খেলতে ভালবাসে।
সামরিন সাঈদ, সিডনি গার্লস হাই স্কুলে অফার পেয়েছে। সে লুমিয়া পাবলিক স্কুল থেকে পরীক্ষায় অংশ নেয়। বাবা সৈয়দ বাকাবিল্লাহ বাকের ও মা শামসুন নাহার। সামরিন পিয়ানো বাজাতে ও সুইমিং করতে পছন্দ করে। সামরিনের সাফল্যের পিছনে ছিল তার কঠোর পরিশ্রম এবং বাবা মায়ের একান্ত চেষ্টা।
জান্নাত রহমান, সিডনি গার্লস হাই স্কুলে অফার পেয়েছে। সে লুমিয়া পাবলিক স্কুল থেকে পরীক্ষায় অংশ নেয়। বাবা সৈয়দ হাসিবুর রহমান ও মা নাসরিন সুলতানা। জান্নাতের পরিশ্রমই তাকে সাফল্য এনে দে বলে জানান তার মা জানান। জান্নাতের পছন্দ বই পড়তে ও ছবি আঁকতে।
রাফিন মির্জা, হার্লস্টন এগ্রিকালচারাল হাই স্কুলে অফার পেয়েছে। রাফিনের বাবা মির্জা হক এবং মা নাসিফা হাসান। রাফিনের সাফল্যের পিছনে তার ছেলের সাথে সাথে ছেলের মায়েরও অনেক ভূমিকা আছে বলে জানান তার বাবা।
আদ্রিতা রহমান অফার পেয়েছে ম্যাককোয়ারি ফিল্ড হাই স্কুলে এবং সেন্ট জর্জ হাই স্কুলে রিজার্ভ প্রথম দিকেই আছে। বাবা আনিসুর রহমান ও মা রোকসানা রহমান। আদ্রিতা পড়ালেখার পাশাপাশি মেধার পরিচয় দিয়েছে গানে ও নাচে। বাংলায় গানে দিগন্ত ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতা ২০১৭ সালে তার গ্রূপে তৃতীয় হয়েছিল। এছাড়াও কিশলয় দলের হয়ে সিডনিতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়ে থাকে।
অস্ট্রেলিয়ান বাঙালি কমিউনিটিতে ২০১৭ সালে :
২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশি ছেলে মেয়েদের মধ্যে সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান ছিল এসফিল্ড পাবলিক স্কুলে থেকে রিদওয়ান আহমেদ।বর্তমানে জেমস রুজ হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যানরত। তার মা, শারমিন সূচনা জানায়, রিদওয়ানের এই সাফল্যের পিছনে ছিল তার একনিষ্ঠ পরিশ্রম। রিদওয়ান প্রি-ইউনি , হোমবুশ এ কোচিং সেন্টারে যেত , যা তাকে ভালো করতে সাহায্য করেছে।
ঈশান তারিকও একই বছর (২০১৭) সিলেকটিভ টেস্টে সিডনি বয়েজ হাই স্কুলে অফার পেয়েছিল এবং বর্তমানে সিডনি বয়েজ হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যানরত। ঈশান পড়ালেখার পাশে পাশে, ক্রিকেট খেলে এবং কমিউনিটি প্রাথমিক বাংলা স্কুলে শেষে, লিভারপুল স্যাটারডে স্কুল অফ কমিউনিটি ল্যাংগুয়েজে বাংলা পড়তে যায়। এছাড়াও বাংলায় গানে দিগন্ত ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতা ২০১৭ সালে তার গ্রূপে দ্বিতীয় হয়।
সিলেকটিভ স্কুলে সুযোগ পেয়েছেন এই রকম কয়েকজন অভিভাবকদের মতামত থেকে জানা যায় :
সিলেকটিভ স্কুল কেন?
* সরকারি সাধারণ স্কুলের শিক্ষার মানদন্ড বিচারের জন্য কোন প্রতিযোগিতার পরিবেশ তুলনামুলুক নেই বললেই চলে।
* নিউ সাউথ ওয়েলসের বাছাই করা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা সিলেকটিভ স্কুলে পড়ে, বিধায় উচ্চ শিক্ষার তাদের অংশগ্রহন অনেক বেশী থাকে।
প্রাইভেট স্কুল না সিলেকটিভ স্কুল ?
* আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেই প্রাইভেট স্কুলে পড়ানো যায়, মেধার যাচাই করে প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় না।
* হাতেগুনা কয়েকটা প্রাইভেট স্কুল ছাড়া অন্নান্য প্রাইভেট স্কুলগুলো কখনোই রাঙ্কিং এ আসতে পারে না।
সিলেকটিভ স্কুলে খরচ কেমন ?
* সিলেকটিভ স্কুলে অন্নান্য সরকারি স্কুলের মতই খরচ
* টিউশন ফি , ল্যাব ফি লাগেনা কিন্তু প্রতিটা স্কুল কার্যক্রমে (খেলাধুলা এবং খেলার ক্যাম্প , এক্সকার্শন , বিতর্ক প্রতিযোগিতা, স্কাউট , গানের ক্যাম্প ইত্যাদি প্রতিটি ইভেন্টেই) অভিভাবকদের ফি দিতে হয়।
কোচিং/প্রাইভেট টিউটর ছাড়া কি সিলেকটিভ স্কুলে সুযোগ পাওয়া যায়?
* ছেলে/মেয়েদের সাথে বাবা/মায়ের অলিখিত চুক্তিই সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি। তবে কোচিং অথবা প্রাইভেট টিউটোরিং এর সাহায্য প্রয়োজনে নেয়া যায়. এতে একটা নিয়মের মধ্যে থেকে সিলেকটিভ পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করা যায়।
সিলেকটিভ স্কুলে সুযোগ না পেলে কি হবে ?
উচচ শিক্ষায় সিলেকটিভ স্কুল সহায়ক ভূমিকা রাখে, তার মানে এই না যে সিলেকটিভ স্কুল ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আকাঙ্খিত বিষয়ে পড়া যাবে না। ইয়ার ১০, ১১ ও ১২ তে মনযোগী হয়ে পড়াশুনা করে প্রতি বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে ভাল বিষয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে নন সিলেকটিভ স্কুল থেকে।