ফজলুল বারী:প্রিয় প্রজন্ম’র পৃথক একটি বাংলাদেশ পর্ব আছে। অস্ট্রেলিয়া পর্ব নিয়ে লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে। এ পর্বটি মূলত সহযোগিতামূলক। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের যে সব ছেলেমেয়েরা অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে আসে তাদের প্রথম দিনগুলোয় একটু সহযোগিতা করা। কোন প্ল্যান করে এটা শুরু হয়নি। আমার আসলে প্ল্যান করে খুব একটা কিছু করা হয়নি জীবনে। মন-বিবেক যখন যা করতে বলেছে তা শুরু করে দিয়েছি।
প্রিয় প্রজন্মের অস্ট্রেলিয়া পর্বের পিছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে। তানহা নামের একটি মেয়ে পড়তে আসবে অস্ট্রেলিয়ায়। তানহা কিছুদিন ঢাকার আজকের কাগজ পত্রিকায় কাজ করতো। একদিন ঢাকা থেকে ফোন এলো আজকের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খানের। আমাকে অনুরোধ করা হয়, আমি যাতে তাদের তানহা মেয়েটির দেখভাল করি একটু। এরপর থেকে অপেক্ষা চলে তানহা দম্পতির সিডনি আসা’র। মনে মনে ভাবা হয় তাদের কী উপহার দেয়া যায়। তখন মোবাইল ফোন সিডনিতে আজকের মতো এত সুযোগ সুবিধার ছিলোনা। তানহা, তার বরের জন্যে মোবাইল ফোনের দুটি সিম কিনে রাখা হয়। সিডনি পৌঁছে তানহা দম্পতি যখন দেখা করতে এলো তাদের সিম দুটি দেবার পর চোখ ঝলমলে আনন্দ দেখে খুব ভালোলাগে। সামান্য দুটি সিম নিয়ে এত আনন্দ পাওয়া যায়! সেই শুরু।
সিডনির প্রথম দিনগুলোয় তারেক-মুরাদ নামের দুই যুবকের ইন্টারভ্যু করেছিলাম। তারেক-মুরাদ জমজ দুই ভাই। অস্ট্রেলিয়ার পার্থে পড়াশুনা করেছে। এখন ব্যবসা করে অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে এডুকেশন কাউন্সিল (ABEC) নামের প্রতিষ্ঠানও তাদের আছে। প্রতিষ্ঠানটি অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি এজেন্ট। ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় অফিস। ফেসবুকে আমি একাউন্ট খুলি ২০০৭’র শেষের দিকে। একদিন সুজন নামের একটি ছেলে যোগাযোগ করলো ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে। ঢাকার গেন্ডারিয়ার ছেলে। এইচএসসিতে পড়ে। সুজন আমাকে বলে তার স্বপ্ন অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে আসবে। কিন্তু এদেশে তার পরিচিত কেউ নেই। তারেক-মুরাদের সঙ্গে কথা বলে আমি সুজনকে তাদের কাছে পাঠাই। তারা সুজন, তার বাবাকে আন্তরিক সহযোগিতা করে। আইএলটিএস’এর জন্যে কোর্স করানো, ব্যাংক সলভেন্সির কাগজপত্র তৈরি সহ নানা প্রস্তুতির এ টু জেড সহযোগিতা তারা দেয়। এইচএসসি পড়ুয়া সুজন হয়ে যায় আমার বন্ধু। প্রতিদিন ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হয়। আমি আবার আমার আনন্দগুলো লিখি ফেসবুকে। ঝড়ের বেগে বাংলাদেশ থেকে ছেলেমেয়েরা যোগাযোগ করতে শুরু করে। যেহেতু আমি বাংলাদেশে মিডিয়ার লোক ছিলাম, ফেসবুকেও একটিভ, ফেসবুকই এখন আমার মিডিয়া তাই আমাকে পাওয়া বেশ সহজ হয়। আন্দোলনটি মূলত এভাবেই শুরু। এই আন্দোলনের নাম প্রিয় প্রজন্ম। এভাবে তারেক-মুরাদদের পাঠানো অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশুনা শেষ করে এখন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক অথবা স্থায়ী বাসিন্দা।
আমি এক সময় রাতে সিডনির বন্দাইতে কাজ করতাম। এক রাতে এগারটার দিকে একটা ছেলে ফোন করে বলে সে মাস তিনেক হয় স্ত্রীর পড়াশুনা উপলক্ষে সিডনি এসেছে। কিন্তু এখনো কোন কাজ জোগাড় করতে পারেনি। একটা কাজের ব্যবস্থার জন্য সে মিনতি করে। আমি তাকে মজা করে বলি এখনই সে আসতে পারবে কিনা। ঘন্টা খানেকের মধ্যে চলে আসে ছেলেটি। বাংলাদেশের একজন সৎ পুলিশ অফিসারের ছেলে। রাতে তার সঙ্গে অনেক আড্ডা হয়। সে রাতেই পরিচিত একজন তার এক কাজে ফোন করেন। আমি সুযোগ পেয়ে তার কাছে একটা কাজ চাই। পরেরদিনই ছেলেটা তার ওখানে কাজে যোগ দেয়। কাজ পেয়ে তার আনন্দ আমার চোখ সিক্ত করে। এভাবে কারও কাজ পেতে সহযোগিতার মজা পেয়ে যাই আমি।
বাংলাদেশে থাকতে যখন ছেলেরা কাজ পেতে সহায়তার আশায় আমার কাছে আসতো আমি তাদের একটি ফোন কিনে উপহার দেবার চেষ্টা করতাম। এটা ২০০৩-২০০৪ সালের দিকের কথা। তখন চার-সাড়ে চার হাজার টাকায় কোন একটি ফোনের সংযোগ সহ নকিয়ার একটি সেট পাওয়া যেতো। আমার অভিজ্ঞতা ওই ফোন সহায়তা ভীষন আত্মবিশ্বাস আনতো সেই ছেলে অথবা মেয়েটির। যে কোন কাজের জন্যে আত্মবিশ্বাস জরুরি। আর এখানে অস্ট্রেলিয়ায় যারা পড়তে আসে তারাতো দেশের মেধাবী ক্রিম ছেলেমেয়ে। আইএলটিএস দিয়ে নিজস্ব যোগ্যতায় আসে। তাদের প্রথম দিনগুলোয় একটু সহায়তা দিলে, প্রথম একটি মাসে হাত ধরে একটু এগিয়ে দিলে আর কিছু লাগেনা। তখন সেই ছেলে বা মেয়েটি একা একাই চলতে পারে।
সিডনির প্রিয় প্রজন্মদের আরও কিছু গল্প। একদিন খুলনা থেকে একজনের অনুরোধ আসে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে। তার পরিচিত একজন সিডনিতে পড়তে এসে খুব একা বোধ করছে। নতুন ছেলেটির ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে দেখি একাকিত্বের কান্না। খুলনায় থাকতে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর এলাকার কোনন এক পচার দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতো সে। আর এখানে সে একা। পরিচিত কেউ নেই। ছেলেটি সিডনি এসে তার ফেসবুক ওয়ালে এখানকার ফোন নাম্বার পোষ্ট করেছিল। সেটিতে কল দিতেই জানলাম সে তার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আমার ফোন পেয়ে সে রওয়ানা হয়। আর আমি তার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি ওয়ালি পার্ক স্টেশনে। সেদিন আমার কাজ ছিলোনা। তাই তাকে নিয়ে সে রাতে ঘুরতে বেরুলাম। সিটিতে গিয়ে সোজা গেলাম এক নাইট ক্লাবে। তরুন বয়স। এ ছিল তার স্বপ্নের মতো বিষয়। ওখানে বসেই সে পোষ্ট দিলো ফেসবুকে। এমন আনন্দ সে এর আগে কখনো পায়নি। এরপর আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। এদেশে নতুন একজন ছাত্র আসার পর তার প্রথম কিছু কাজ, ব্যাংক একাউন্ট করা, ট্যাক্স ফাইল নাম্বার বানানো, মেডিক্যাল ইন্সুরেন্সের সেন্টারে নিয়ে যাওয়া এসব কাজ করে ফেলি। তরুনদের বন্ধুত্ব দিতে বন্ধুত্ব পেতে ভালোলাগে আমার। এখানে বড়ভাইর স্নেহ আছে। কোন প্রতিযোগিতা নেই।
একবার একটি ছেলে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে লিখলো সে অস্ট্রেলিয়ায় এক বছরের ওয়ার্কিং হলিডে ভিসা পেয়েছে। কিন্তু তার পরিচিত কেউ নেই এদেশে। আমি যদি তাকে একটু সহযোগিতা করি। তার নাম্বার নিয়ে ফোন দিলাম। ফোন পেয়ে সেতো আবেগে কাঁদতে শুরু করে। কিছু বলতে পারেনা। ফোন দিয়ে দেয় তার বাবা’র হাতে। তার বাবাও কাঁদতে শুরু করেন। আমি তাকে বাবা ডেকে বলি, আপনার ছেলে এদেশে আমাদের বন্ধু হয়ে থাকবে। আমরা ভালো থাকলে সেও ভালো থাকবে। আশ্বস্ত বাবা তখন দোয়া করতে থাকেন। এই ছেলেটিকে নিয়ে লিখেছিলাম। লেখাটি পড়ে একজন ফোন করে বলেন আপনার এ ছেলেটি কবে আসবে। আসার পরদিন সে আমার এখানে কাজে জয়েন করবে। ছেলেটি সিডনি পৌঁছার পরদিনই সে সেই কাজে যোগ দিয়েছিল। এমন আনন্দ অভিজ্ঞতা যখন কারো হয় সেতো সেই কাজ করেই যাবে তাই নয় কি। এক বছর পর ছেলেটি বড় একটি সঞ্চয় সহ দেশে ফিরে গিয়েছিল। এরপর আবার এখানে এসেছে পড়াশুনা উপলক্ষে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করে এসেছে। এখন তার স্ত্রী আসবে। এমন অনেক গল্প। গত দশ-বছরে এমন কয়েকশো ছেলেমেয়ে এসেছে। তাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করা, বাসা ঠিক করে রাখা, প্রথম কয়েকদিন এখানে সেখানে নিয়ে যাওয়া, গাড়িতে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কাউন্সিলিং এই কাজগুলো করতে পারলে ভালো লাগে। এখন অবশ্য একটা নেটওয়ার্কিং হয়ে যাওয়াতে আমার কাজ কমেছে। এখন পুরনোরাই নতুনদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করছে বাসা ঠিক করছে। অথবা কারও হাতে একটা কাজ এলে ফোন করে বলছে, বারী ভাই একটা ছেলে বা মেয়ে দেন। আজই জয়েন করতে হবে। কাজ এভাবেই আসে। কাজ নিয়ে কোন জাদুকরী ক্ষমতা নেই। আবার অনেকে মনে করেন এই লোকটার কোন বড় ব্যবসা বা জব এজেন্সী আছে কিনা! ফোন করেই বলবে ভাই আমাকে আপনার ওখানে একটা অফিস জব দেননা। আমি অমুক অমুক দিন ফ্রি।