পার্থে শেক্সপিয়রের ওথেলো মঞ্চস্থ

পার্থে শেক্সপিয়রের ওথেলো মঞ্চস্থ

অষ্ট্রেলিয়ার পার্থে বসে মঞ্চ নাটক উপভোগ তাও আবার স্থানীয় থিয়েটারের পরিবেশনায় কালজয়ী নাট্যকার মহামতি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ওথেলো। ব্যাপারটা নাটকপ্রেমিদের জন্য বেশ রোমাঞ্চকর। গত ২ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মারডক ইউনিভার্সিটির নেক্সাস থিয়েটারের প্রসেনিয়াম মঞ্চে পরিবেশিত হলো দ্যা ট্র‍্যাজিডি অব ওথেলো, দ্যা মুর অব ভেনিসের বাংলা রুপান্তর ওমিও।
অধুনা থিয়েটারকে বলা হয় সমাজের দর্পন। যে সমাজে নাটকের মঞ্চ থাকে সেই সমাজ অন্যদের থেকে আলাদা, বনেদি এবং মানবিক বলে বিবেচিত হয়। এই যেমন হিজ মাজেস্টি এবং দি রিগাল থিয়েটারের জন্য পার্থ শহর জগৎ বিখ্যাত।

ইতিহাস থেকে জানা যায় মঞ্চ নাটকের সূতিকাগার প্রাচীন গ্রীসে। পঞ্চম শতাব্দীর শেষ দিকে ইস্কেলিয়াস, সফোক্লেস আর ইউরিডিয়ানের হাত ধরে।
মঞ্চ নাটকের শুরু হয় সমস্বর বা কোরাসের মাধ্যমে। মুলত: সমস্বরে স্তুতি মুলক গল্প বলা। বাংলায় যাকে বন্দনা বলা হয়। পরবর্তীতে সংলাপ যুক্ত হয় এবং ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। মঞ্চ নাটকের বিয়োগাত্মক ও কমেডি (বিনদন) ধারা জনপ্রিয় হয়। এছাড়া স্যাটায়ার নাটকও হয়।
ইংরেজি সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ষোড়শ শতাব্দীতে লিখেছেন কালজয়ী নাটক ওথেলো।
ইতালির সিনথিও রচিত কাহিনি উন ক্যাপিট্যানো মোরো (জনৈক মুর-জাতীয় ক্যাপ্টেন) অবলম্বনে ওথেলো নাটকটি রচিত হয়। মূল কাহিনিটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৫৬৫ সালে।
চিরকালীন সম্পর্কের রাজনীতি আর প্রেমের মনস্তত্ত্ব ও তার বিচিত্র বিষয়বস্তুর প্রেক্ষাপটে রচিত হওয়ায় ওথেলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি রুপান্তরিত ও অনুদিত নাটকের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। যা এখনও পেশাদার ও সামাজিক নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয়। এছাড়াও একাধিকবার ওপেরা, চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে এই নাটকটি অভিযোজিত হয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমার অভিনিত সপ্তপদী সিনেমায় এক টুকরো ওথেলোর কথা অনেকের হয়ত মনে আছে।

অভিনয় সংলাপ আলো ছায়া মিশিয়ে দর্শকের ভাবনার উদ্রেক করাই মঞ্চ নাটকের মুল সুর যা কান্ডারী বাপি মাযহারের বাংলা থিয়েটার আরো একবার করে দেখালেন এই ওমিও মঞ্চায়নের মাধ্যমে ।

প্রেম, বর্ণবিদ্বেষ, ঈর্ষা, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশোধ ও অনুশোচনা এই নাটকের প্রতিপাদ্য। তাই শত বছরের পুরনো মুর কালো চরিত্রের সেনা নায়ক ওথেলো হয়ে উঠে বাংলাদেশের খুদ্র নৃ গোষ্ঠীর প্রতিনিধি পুলিশ অফিসার ওমিও। বন্ধু বৎসল, ছল-চতুর, ঈর্ষা আর প্রতিশোধ পরায়ণ ইয়গো রূপায়ন করে ওমিওর বন্ধু ইফতি। স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া প্রেমিকা ডেইজি আর তার বান্ধবি আরমিন। পুলিশের হাতে নিহত পার্বত্য চট্টগ্রামের এক আদিবাসীর ঘটনা নিয়ে জমে উঠে নাটক। বাপি মাযহারের রুপান্তরে আর শক্তিশালী সংলাপের কারণে গল্পটি যেন হয়ে উঠে আমাদের সকলের। থিয়েটার ভর্তি দর্শক যেন নাটকের মাঝে নিজেদের চরিত্র বিশ্লেষণের সুযোগ খুঁজে।

নাটকের ওমিও চরিত্রটি ব্যক্তিক দান্দ্বিকতায় ভরপুর। একদিকে পেশাগত সাফল্য আর অন্যদিকে ঈর্ষা, প্রেমিকা হারানোর ভয়। এই চরিত্রে অভিনেতা অভিষেক বড়ুয়া সুদক্ষ অবভনয়শৈলী দিয়ে প্রেম ও তার আবেগ, আবেদন, মানসিক টানাপোড়েনে, সাফল্য জিঘাংসা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার সংলাপ প্রক্ষেপন -অভিক্ষেপণ এবং শারীরিক গতিবিধি সামঞ্জস্য ছিল দারুণ পরিপক্ক। ডেইজি ছিল নি:স্বার্থ প্রেমিক। যে কিনা প্রেমিকের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উৎজীবিত হয়। প্রেমিকের ভালবাসায় নিজের জগৎ সাজায়। অভিজ্ঞ অভিনেত্রী শামা কামাল চরিত্র অনুযায়ী অভিনয় করেছেন। কন্ঠের সহযোগিতা তেমন না পেলেও অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন চরিত্রটি।

ইফতি খল চরিত্র। যার ছল আর প্রতিশোধস্পৃহার শিকার হয় ওমিওর জীবন। বর্তমান পৃথিবীতে আমরা যাদের সাইকোটিক বলি। যাদের কুকর্মের জন্য তাদের সরাসরি দায়ী না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে বলতে হয়,তেমনি একজন ইফতি। সততার মুর্তি ধারন করে কুট ও ছল চাতুরী করে একটু একটু করে বিষিয়ে তুলে ওমিও র মন। হারানোর ভয় ঢুকিয়ে বন্ধু ওমিওর প্রেমে সন্দেহ তৈরি করে প্রতিশোধ পরায়ণ ইফতি। এই আপাত বাই- পোলার চরিত্র দারুণ ভাবে তুলে ধরেছেন বাপি মাযহার নিজেই।
অপেক্ষাকৃত ছোট চরিত্র হলেও ডেইজির বাবার চরিত্র অভিনয় করে জাত চিনিয়েছেন প্রিয়ংকর। এছাড়াও শোয়েব, নবাগতা ফারাহ দিবা, ওয়াহেদ হুদা অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছেন।

সাড়ে তিন ঘন্টার নাটকে শেষ পর্যন্ত দর্শক ধরে রাখাই ছিল নির্দেশক এর সাফল্য। দুই দৃশ্যের মাঝে মাঝে হল ভর্তি দর্শকের করতালি অভিনয় কলাকুশলীদের জন্য বিরাট পাওয়া ছিল।

নাটকের পিছনে সাজ সজ্যার জন্য হুমাইরা রহমান বড়ুয়া বাহবা পেতে পারেন চরিত্র অনুযায়ী কুশীলবদের সাজানোর জন্য। বিশেষ করে ওমিও, ডেইজি, আমরিন এর সাজসজ্জা দারুণ ছিল।

মঞ্চ সজ্জা পরিমিত ছিল। আলোক সজ্জা যথুপযুক্ত।
এই নাটকের দর্শকবৃন্দ নিজেকে নায়ক নায়িকা কিম্বা ভিলেনের দলভুক্ত না করে সমস্ত চরিত্রেই নিজেকে মিলাবে আবার একই সংগে চরিত্র থেকে বের হওয়ার পথ খুজবে। আর এভাবেই নাটকটি সবার মনস্তত্ত্বে জায়গা করে নিবে।
এই নাটকের জনপ্রিয়তার জন্য পঞ্চাশের দশকে জন টড নামক একজন ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ববিদ প্রেমিকা-প্রেমিকার সন্দেহ সমস্যাকে ‘ওথেলো সিনড্রোম’ হিসেবে অভিহিত করেন।
এরকম নাটক আরও বেশি বেশি মঞ্চস্থ হলে আস্ট্রেলিয়ান- বাংলাদেশি সমাজের সদস্যদের মনস্তাত্ত্বিক অগ্রগতিতে সহায়ক হবে বলে বিশ্বাস।

(আবুহেনা ভূঁইয়া, পার্থ, ওয়েষ্টার্ন অষ্ট্রেলিয়া )