ফজলুল বারী: দেশের সাধারন নির্বাচন এক সপ্তাহ পিছিয়ে ভোটের দিন ৩০ ডিসেম্বর করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধে দেয়া হয়েছে নতুন তফসিল। বিষয়টি আমার ভালো লাগেনি। কারন আমাদের দেশের নির্বাচনের সঙ্গে ইনজুরি টাইম গুরুত্বপূর্ন। ভোটের দিন কোন একটি এলাকা অথবা কিছু কেন্দ্রে কোন কারনে ভোটগ্রহন স্থগিত হলে পুনঃভোটগ্রহনের জন্যে এসব ইনজুরি টাইম গুরুত্বপূর্ন।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এই সাত দিন পিছানোয় সন্তুষ্ট না। তারা কমপক্ষে একমাস পিছাতে চায় নির্বাচন! এমন আবদারে মন দেয়া ঠিক হবেনা। কারন এ ভোট নিয়ে তাদের পদক্ষেপের সঙ্গেই না’ জড়িত। তাদের কোথায় এবার হ্যাঁ’ পাওয়া যাবে তা কেউ জানেনা। সম্ভবত তারাও না। আর এ জোটের দৃশ্যত প্রধান নেতা ড কামাল হোসেন নির্বাচনের লোক না। তার সবসময় নিজস্ব অন্য গেম থাকে। তিনি সংবিধান প্রনেতা। আবার ১/১১’এর তিন মাসের সরকার অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন! আইনজীবী রাজনীতিকরা এভাবেই যার যার সুবিধামতো ফতোয়া দেন।
নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র বিক্রয় নিয়ে হৈহৈ কান্ড-পরিস্থিতি হয়েছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কিনেছেন ৪ হাজার ২৩ জন! বিএনপির মনোনয়নপত্র বিক্রয় নিয়েও বিস্তর ভিড় হয়েছে। মনোনয়নপত্র বিক্রয় বাবদ শাসক দলটির ১২ কোটি ৭ লাখ টাকা আয় হয়েছে! মনোনয়নপত্র বিক্রয় ভিত্তিক দলটির এমন আয় রোজগার নিয়ে খুশি হবার কোন কারন নেই। আসন মাত্র ৩০০। এরমাঝে শরীকদের জন্যে আসন ছাড়তে হবে। বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে দলের পক্ষে যত হুঙ্কার দেয়া হোক না কেনো বিদ্রোহী প্রার্থী হবেই। শাসকদলের জন্যে বিষয়টি আত্মঘাতী পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্রের দাম ছিল ৩০ হাজার টাকা। বিএনপি-জাতীয় পার্টির মনোনয়পত্রেরও একই দাম! আবার দেখা গেলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে টাকা কোন সমস্যা না! শুধু শাসকদল না, টাকার ঘাটতি নেই দশ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিরও! এরপর আছে জাতীয় পার্টি-জামায়াত সহ অন্য দলগুলোর টাকার মচ্ছব! শুধু মনোনয়পত্র কেনা নয়। একেক প্রার্থী নিজেরা কতো জনপ্রিয়-গুরুত্বপূর্ণ দেখাতে বিপুল লোকবল নিয়ে মনোনয়নপত্র কিনতে এসেছিলেন! এসবের সঙ্গেও বেশুমার অংকের টাকাকড়ি জড়িত। আর নির্বাচনতো শুধু মনোনয়পত্র কেনা নয়।
বাংলাদেশের নির্বাচনকে ভোট উৎসব বলা হয়। এসব উৎসবের পরতে পরতে জড়িত শুধু টাকা আর টাকা! যা সম্ভবত দেশের ক্ষয়িষ্ণু বামপন্থীদের নেই। এরজন্যে তাদের সঙ্গে পপুলার ভোটের লোকজনও নেই। দেশের দক্ষিনাঞ্চলের বরগুনা-১ আসন থেকে শাসকদলের মনোনয়ন পেতে মনোনয়ন পত্র কিনেছেন ৫১ জন! এক আসন থেকে সর্বোচ্চ মনোনয়ন ফরম কেনার রেকর্ড এটা। নারায়নঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করতে মনোনয়ন পত্র কিনেছেন ৩২জন! দেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুর। মেহেরপুর -১ মাত্র দুটি থানা নিয়ে এ আসন। এ আসনের বিপরীতে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পত্র কিনেছেন ১১ জন! এ চিত্র সারাদেশের!
এতো লোক দেশে এমপি হতে চান! এতো লোকজন দেশে নিজেদের এমপি হবার যোগ্য ভাবেন! অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে বসে এটা আমাদের জন্যেও চিন্তার বিষয় বৈকি! এসব দেশের মূলধারায় থাকা আমরা শুধুই কাজ করে নিজে চলা আর টাকা বাঁচিয়ে দেশে পাঠিয়েই গেলাম। এটি আমাদের গতরখাটা শতভাগ হালাল রোজগারের টাকা। কিন্তু আমরাতো এভাবে এমপি হবার কথা ভাবিনা। অথবা নিজেদের এমন ঢালাও যোগ্যও মনে করিনা।একজন এমপিকে সংসদ, সংসদীয় আইনকানুন জানতে হয়। আমরা এসব খুব ভালো জানিনা-বুঝিনা বলে এমপি হবার কথাও ভাবিনা। এসব দেশে আমাদের চারপাশে নানা দেশ থেকে আসা পড়াশুনা জানা লোকজনও এভাবে নিজেদের ঢালাও এমপি হবার যোগ্য মনে করেননা।
বাংলাদেশে এই নির্বাচনে যদি দশ সহস্রাধিক ব্যক্তি নিজেদের এমপি হবার কথা ভেবে থাকেন, এমপি হবার যোগ্যতা নিশ্চয় তাদের এক-দু’শ জনের বেশি নয়। তবু এতো লোকজন দেশের এমপি হতে চাইছেন! এমপি হবার রাজনৈতিক মেধা-যোগ্যতা থাক বা না থাক, টাকায় নিজেদের যোগ্য মনে করছেন! এটি নিশ্চয় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্বাস্থ্যের নমুনা নয়। গণতন্ত্রের শতফুল ফুটিতে দেয়া হয় বলে যে বচন দেয়া হয় এরজন্যেও বিষয়টি স্বাস্থ্যকর নয়। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অসুখের নমুনা। এ অসুখের নমুনা প্রকাশ প্রধান দুটি দলের জন্যে আগাম একটি মনোস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি করে। কারন
এ নির্বাচনে ভালো ফল করতে চাইলে ভোটের বাজারে যাবার আগে তাদেরকে ভোট শরীকদের হৃদয়জয়ের কঠিন কাজটিতে পাশ করতে হবে।