ফজলুল বারী:করোনা ভাইরাসের সংক্রমন এখন বিশ্বজনীন এক ভয়াবহ সংকট। কোন রোগকে কেন্দ্র করে বিশ্ব আগে কখনো এ ধরনের সংকটে পড়েনি। আমেরিকা-ইউরোপ থেকে শুরু করে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাসের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কাজেই এই পরিস্থিতিকে কেউ যাতে রাজনৈতিক বাহাস বা ঠাট্টা-মস্করার বিষয় মনে না করেন। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রতিদিন যে ব্রিফিং করছে এটি চমৎকার হচ্ছে। আইইডিসিআর এর পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সব্রিনা ফ্লোরার ব্রিফিং’এ খুঁটিনাটি কোন তথ্য-পরামর্শ বাদ পড়ছেনা। কাজেই এর বাইরে সারাদিন অমুক তমুকের ব্রিফিং করার দরকার নেই। এতে বিভ্রান্তি ছড়াবে। মানুষ আতংকগ্রস্ত হবে। যা পরিস্থিতিকে জটিল করবে। আমরা দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে অভ্যস্ত জাতি। এলোপাতাড়ি বক্তব্যের মাধ্যমে জাতির জীবনী শক্তিকে কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না করেন। বাংলাদেশের কিছু কিছু মিডিয়ার ভূমিকা আপত্তিকর। এরা করোনা পরিস্থিতিকে নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির দায়িত্বহীন ভূমিকায় সক্রিয়। কোন মিডিয়াকে পুলিশ দিয়ে শুদ্ধ করা অনুচিত। যারা মিডিয়া চালান তাদের নিজস্ব হিতাহিত জ্ঞান থাকা উচিত।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার এক ব্রফিং’এ সরকারের বিরুদ্ধে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নানা অভিযোগ করে দু’সপ্তাহের জন্যে স্কুল-কলেজ বন্ধ করতে বলেছেন। মির্জা ফখরুল কোন দায়িত্বহীন ব্যক্তি নন। এক সময় শিক্ষকতাও করেছেন। একটা দেশের ক্ষমতাসীন সরকার এ ধরনের দুর্যোগ পরিস্থিতিকে অবহেলা করে দেশে করোনাকে ওয়েলকাম করছে, এমন ছেলেমানুষি বক্তব্য না মিঃ ফখরুল? এখন দু’সপ্তাহের জন্যে স্কুল-কলেজ বন্ধ করলে কী করোনা চলে যাবে? এ দুর্যোগ সামাল দিতে কতোদিন লাগবে তা এখন পর্যন্ত বিশ্ব জানেনা। মির্জা ফখরুলের মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। মেয়ের কাছে ফোন করে একটু অস্ট্রেলিয়ার নানা কিছু জেন নিলে পরিস্থিতি নিয়ে এভাবে ফাউল টক করা লাগেনা। অনলাইনে চোখ রেখে বিশ্ব পরিস্থিতি জানাও কঠিন নয়।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তিন জন করোনা ভাইরাসের রোগী পাওয়া গেছে। আর অস্ট্রেলিয়ায় এখন পর্যন্ত এমন রোগী পাওয়া গেছে একশ জন। এই ভাইরাসে আক্রান্ত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। সিডনির একটি স্কুলের ইয়ার ইলেভেনের এক ছাত্র আক্রান্তের খবর বেরুলে আতঙ্ক ছড়ায়। এরপর ওই স্কুল একদিনের জন্যে ছুটি ঘোষনা, সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সহ নানান সতর্কতার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ছাত্রদের কেউ অস্বস্তিতে পড়লে তাকে বাড়ি থেকে পড়া অনুসরনের পরামর্শ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেবার কথা কেউ বলছেনা। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের পচাত্তর শতাংশ চীনা। এডুকেশন সেক্টরে ৭ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা লাটে উঠেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কী করে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেবে, পরিচালনা ব্যয় মেটাবে তা নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। চীন-দক্ষিন কোরিয়ার সঙ্গে ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা থাকায় এসব দেশের ছাত্রছাত্রীরা অস্ট্রেলিয়ায় আসতে পারছেনা, ক্লাসে যোগ দিতে পারছেনা। এতে করে পুরো এডুকেশন ইন্ডাস্ট্রি, ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। এরজন্যে দেশগুলোয় ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বলা হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে আমরা কোন দেশকে আইসোলেশন করতে পারিনা। কোন রোগী পাওয়া গেলে শুধু তাদের নিয়ে যেতে পারি আইসোলেশনে।
বাংলাদেশে তিনজন করোনা রোগী পাবার পর মুজিব বর্ষের বড় জন সমাবেশের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। নরেন্দ্র মোদী সহ বিদেশি অতিথিদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সফর বাতিল করেন। এ নিয়েই বাংলাদেশে কান্ডজ্ঞানহীন রাজনৈতিক মন্তব্য করা হয়েছে! অথচ ভারতের পরিস্থিতি আরও নাজুক। এখন পর্যন্ত দেশটায় ৬৪ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী। ভারত বিরোধীদের প্রিয় দেশ পাকিস্তানের অবস্থা আরও নাজুক। কারন ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত রয়েছে। চীনের পর দক্ষিন কোরিয়া, ইরান, ইতালির অবস্থা ভয়াবহ। ইতালিতে জরুরি অবস্থা ঘোষনা করা হয়েছে। দেশটির সেনা প্রধানও এখন এ রোগে আক্রান্ত। জার্মানিতে একটি বৈঠকে গিয়ে একজন মার্কিন জেনারেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় নড়চড়ে বসেছে মার্কিন প্রশাসন। দেশে দেশে নানা বৈঠক-সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে-হচ্ছে। উমরা হজ বন্ধ করে দিয়েছে সৌদি আরব। আর দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বিরোধীরা মুজিব জন্মশত বার্ষিকীর মূল কর্মসূচি স্থগিত করা নিয়ে করছে নানা কটাক্ষ!
করোনা ভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশ সামনের দিনগুলোতে নানান অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে। গার্মেন্টস সহ নানাখাত পড়বে সংকটে। চীন থেকে বাংলাদেশ গার্মেন্টস উপকরন আমদানি করে, ইতালি সহ ইউরোপের নানা দেশে বিক্রি করে। সব জায়গায় এখন করোনার কালো থাবা। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল সহ নানা বৃহৎ প্রকল্প বিলম্বিত হবে। খরচ বাড়বে। বাংলাদেশ সুযোগ সন্ধানীদের দেশ। এরমাঝে একদল লোক মাস্ক আর হাত ধোয়ার জীবানু নাশক লিকুইট সামগ্রী বিক্রি নিয়ে মুনাফাখোরের ভূমিকায়। সবার সারাদিন মাস্ক পরার দরকার নেই। সাবান দিয়ে নির্দিষ্ট সময় ধরে হাত ধোওয়াই যথেষ্ঠ। এসবতো মূল সংকট না। সংকট আসবে অর্থনৈতিক। সারা দুনিয়ার শেয়ার বাজারে ধস চলছে। পরিস্থিতির কারনে অস্ট্রেলিয়ায় ক্যাজুয়াল ওয়ার্কারদের কাজ কমে গেছে। এ দেশে বেকার নাগরিকদের নিউ স্টার্ট এলাউন্স নামের সাপ্তাহিক একটি ভাতা দেয়া হয়। কাজ না পাওয়া পর্যন্ত দেয়া হয় এই ভাতা। নিউ স্টার্ট এলাউন্সের পরিমান বাড়ানোর চিন্তা চলছে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে নাগরিকরা যাতে ভীত সন্ত্রস্ত না পড়েন সে চিন্তা করা উচিত সরকারের। অস্ট্রেলিয়ার হাসপাতাল ছাড়াও বিভিন্ন চিকিৎসকের চেম্বারে কাজ করা স্বাস্থ্য কর্মীদেরও বিনামূল্যে মাস্ক সরবরাহের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।