ফজলুল বারী:জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পূর্বাপর নানা ঘটনা এই প্রজন্মের বেশিরভাগ সদস্য জানেনা। একেকটা খুনির ফাঁসির পর বিষয়টি সামনে আসে। সঙ্গে আসে নানা প্রশ্ন। সর্বশেষ বরখাস্ত ক্যাপ্টেন মাজেদের ফাঁসি নিয়ে তা আবার সামনে এসেছে। রবিবার রাতে ফাঁসির পর গোপনে মাজেদের মরদেহ কবর দেয়া হয়েছে সোনারগাঁওর শশুরবাড়ির গ্রামে। কারন তার গ্রামের বাড়ি ভোলার লোকজন এই খুনির লাশ গ্রহনে অস্বীকৃতি জানায়। খুনি মাজেদের স্ত্রী একজন ডাক্তার। পিতার ঘৃন্য অতীতের জন্য মাজেদের চার মেয়ে এক ছেলে প্রকাশ্যে আসতে চায়নি। এমনকি পিতাকে তারা শেষ দেখা দেখতেও যায়নি। বিএনপির ভূমিকাও এক্ষেত্রে মাজেদের পরিচয় লুকোনো ছেলেমেয়ের মতো! এ নিয়ে তাদেরও কোন প্রতিক্রিয়া নেই!
এবার জনসমক্ষে আসার আগে দীর্ঘদিন পরিচয় গোপন করে কলকাতায় কাটিয়েছে মাজেদ। অবশ্য সে সেখানে ভারতীয় গোয়েন্দাদের নজরে থাকায় তাকে বাংলাদেশের বুঝে পেতে সুবিধা হয়। প্রান বাঁচাতে দীর্ঘদিন সে লুকিয়েছিল। অথচ বঙ্গবন্ধুকে খুনের পর রেডিও স্টেশন দখলের পর তার হম্ভিতম্ভি সবাই দেখেছে। ভোলার যে মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে পারছিলোনা বঙ্গবন্ধুর হত্যার দাপটে তখন তার ভাইকেও রেডিও স্টেশনে ধরে এনে আটকে রাখে। পূর্বশত্রুতা মেটাতে তোফায়েল আহমদের তৎকালীন এপিএস ম্যাজিষ্ট্রেট মিন্টুকেও তখন হত্যা করে মাজেদ। জিয়া-এরশাদ-খালেদার আমল পর্যন্ত দাপটেই সে কাটিয়েছে। সেনাবাহিনীর একজন বরখাস্ত ক্যাপ্টেনকে সচিব পর্যন্ত পদোন্নতি দেন জিয়া!
সর্বশেষ খালেদার ১৯৯৬ সময় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর খুনিরা এক রকম নিরাপদজ্ঞানে প্রকাশ্যেই ছিল। খুনিদের অনেকে খালেদাকে ভাবী সম্বোধন করতো। এরশাদ আমলে ফ্রিডম পার্টি নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে খুনিরা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালায়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে খুনিদের অন্যতম আনোয়ার পাশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আন্দোলনের সঙ্গে মিশে ফায়দা হাসিলেরও একটি ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। পাশার স্ত্রী তখন প্রায় নিয়মিত প্রেসক্লাবেও আসতেন।
মতিঝিলে তাদের দৈনিক মিল্লাত নামের একটি পত্রিকার অফিসও ছিল। দৈনিক বাংলা ভবনের বিচিত্রা অফিস ছিল তাদের অন্যতম মিটিং পয়েন্ট। বনানীর ডিএইচওএস এর একটি বাড়িতে থাকতেন খুনি ফারুক। বিলুপ্ত মিল্লাত পত্রিকার সাংবাদিকরা এখন বিএনপি-আওয়ামী শিবিরে মিশে গেছেন!
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সব রাজনৈতিক দল বর্জন করলেও ফ্রিডম পার্টি তাতে অংশ নিলে খুনি রশীদকে বিরোধীদলের নেতা করেন খালেদা জিয়া। ফারুক সে নির্বাচনে প্রার্থী হয়নি। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে শেখ হাসিনার
নেতৃ্ত্বে একুশ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে রশিদ সহ খুনিদের বেশিরভাগ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। মোটা হাঁটুর বুদ্ধির খুনি ফারুক তখনও মনে করতো তাদের ধরা, বিচার করা মানে সেনাবাহিনীর গায়ে হাত দেয়া! তাদেরকে রক্ষায় জিয়ার পার্লামেন্টে পাশ করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশও তাদের মাথার ওপর ছিল। ওই অধ্যাদেশে বলা ছিল বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকান্ডের বিচার করা যাবেনা।
কিন্তু প্রথম সুযোগেই খুনি ফারুক, শাহরিয়ার রশীদগংকে গ্রেফতার করা হয়। শেখ হাসিনা ইনডমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের মাধ্যমেই তাদের বিচারের আয়োজন করেন। বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পিতা বঙ্গবন্ধুর সহযোগী সিরাজুল হক এই মামলার প্রধান কৌশলী হতে জাতীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। আনিসুল হক তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের সঙ্গে জড়িত। সিরাজুল হকের মৃত্যুর পর আনিসুল হক মামলার সঙ্গে থাকতে থাকতে এখন আওয়ামী লীগের এমপি এবং আইনমন্ত্রী।
ব্যাংককে ছিলেন বজলুল হুদা। বাংলাদেশে যাতে না আসতে হয় সে উদ্দেশে ব্যাংককের একটি দোকানে চুরির অভিনয় করে সে সেখানে গ্রেফতার হয়। তার হাঁটুর বুদ্ধি ছিল বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই। তাই সে সেদেশের জেলে থাকবে। তাকে বাংলাদেশ সে দেশ থেকে আনতে পারবেনা। কিন্তু বাংলাদেশ থাইল্যান্ডের সঙ্গে বন্দী বিনিময় চুক্তি করে তাকে দেশে নিয়ে আসে। কিন্তু ডালিম-রশীদ এদের আর কোন খোঁজ বের করে আনা যায়নি। গত ১/১১’র সময় চ্যানেল আই ব্যাংককে গিয়ে রশিদের ইন্টারভ্যু করে এনে তা প্রচার করে। কিন্তু এরপর আর তার সন্ধান কেউ জানেনা। আমেরিকা-কানাডায় থাকা খুনিদের দেশে ফেরত আনা নিয়ে মন্ত্রীরা মাঝে মধ্যে মিডিয়ায় মুখরোচক ইন্টারভ্যু দেন।
কিন্তু সে সব দেশে মৃত্যুদন্ডের আইন না থাকায় তাদের ফেরত আনার সুযোগ নেই। সে হিসাবে মুজিব বর্ষে বাংলাদেশের আপাতত মাজেদের ফাঁসি নিয়ে খুশি থাকা সম্ভব ছিল এবং সেটি হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রসঙ্গ এলেই বিএনপি বলার চেষ্টা করে এর সঙ্গে তারা বা জিয়া জড়িত ছিলেননা। আওয়ামী লীগার খন্দকার মুশতাক এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে, মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যরা সবাই আওয়ামী লীগার, ইত্যাদি।
কিন্তু গ্রানাডা টেলিভিশনে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে খুনিরা বলে তারা এই হত্যাকান্ডের আগে জিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করেছে। হত্যাকান্ডের সকালে জিয়ার এক জুনিয়র অফিসার জিয়াকে খবর দিতে গেলে তিনি সেভ করতে করতে ঠান্ডা মাথায় বলেন, এটা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হবার কী আছে। প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছেন। এখন সংবিধান অনুসারে ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন। ওই জুনিয়র অফিসার তখনই বুঝতে পারেন, তার স্যার সবকিছুর সঙ্গে অবহিত। অতঃপর ক্রমশ প্রকাশ পেলো বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল বেনিফিশিয়ারির নাম জিয়া।
কৃতজ্ঞতার অংশ হিসাবে বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরষ্কৃত করেন। তাদের দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করেন জিয়া। সঙ্গে দেন তার বিশ্বস্ত অনুগত এক অফিসার শমসের মোবিন চৌধুরীকে। জিয়ার পক্ষে এই শমসের মোবিন তখন খুনিদের বিশ্বের বিভিন্ন দূতাবাসে পদ বিলি-বন্টন করেন। দেশ থেকে নেয়া ডলারের বড় বড় প্যাকেটও তখন তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়।
অতঃপর চরম ঔদ্ধত্যে সামরিক ফরমান দিয়ে নানাভাবে দেশে বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করেন জিয়া। অথচ এই বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত মুজিবনগর সরকারের বেতনভূক্ত কর্মচারী ছিলেন জিয়া। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু তাকে কুমিল্লা সেনানিবাসের দায়িত্বে পাঠান। ঢাকা আসার আগে বেগম জিয়া কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহেরের কাছে জানতে চাইতেন ঢাকায় গেলে কোন বাজারে কম টাকায় বাজার করা যাবে। সোয়ারিঘাটে মাছ কিনতে গেলে মাসের মাছ কমদামে কেনা যাবে কিনা।
সেই জিয়া ঢাকা আসার পর থেকে গুটি চালাচালি শুরু করেন। আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নানাকাজে প্রকাশ করেন তার মিশন পাকিস্তান! মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা শ্লোগান মুছে দিতে বিএনপি ও সরকারের শ্লোগান করা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। এমনকি তার সামরিক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের অনুমতি নিতে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করতে দেননি। জিয়ার পার্লামেন্টে পাশ করা হয় বিতর্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। এরমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকান্ডের বিচার নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হবার আগ পর্যন্ত দিল্লীতে থাকা শেখ হাসিনাকে দেশে আসার অনুমতি দেননি জিয়া। শেখ হাসিনা দেশে আসার পর তাকে ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বার বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দেননি। বাড়ির সামনের রাস্তায় তখন শেখ হাসিনা তাঁর নিহত বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের জন্য মিলাদ দেন। জিয়া যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িতই না থাকবেন তার এসব নানান বিধিনিষেধে তার অত আগ্রহের কারনটাই কী?
আর খালেদা জিয়াতো বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনে কাজ করেছেন। খুনিদের একজন বজলুর রশীদকে করেছেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলের নেতা! হঠাৎ করে জাতির জনকের হত্যাকান্ডের দিন ১৫ আগষ্টকে তার জন্মদিন পালন শুরু করেন! ২০০১ সালে ক্ষমতায় ফিরে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ফিরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার আটকে দেন! এর পিছনে কী স্বার্থ ছিল তার? কেউ কী কখনো বলেছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের সঙ্গে তিনি খালেদা জিয়া জড়িত! তিনিতো তখন সাধারন গৃহবধূ ছিলেন।
স্বাধীনতার পর যারা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে খালেদা জিয়াকে দেখেছেন তারাতো জানেন বেগম জিয়া বঙ্গবন্ধুর কাছে উপকৃত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার আটকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের দিন জন্মদিন পালন শুরু করে কী বার্তা দেন খালেদা জিয়া? এরপর আবার ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়। এই হত্যার পিছনেও যদি বিএনপি জড়িত না হয় তাহলে জজ মিয়া নাটক সাজানো কেনো? এসবের উত্তর বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের কাছেও নেই।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পূর্ন করে। সুপ্রিমকোর্টে খুনিদের মৃত্যুদন্ড বহালের পর বিএনপির ক্ষমতাকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দিলে খালেদা জিয়ার ধমকে দমে যান। এরপর থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামীদের ফাঁসিতে সারাদেশের মানুষ খুশি হলেও বিএনপির নেতাকর্মীরা কোন প্রতিক্রিয়া দিতে পারেনা। চোখ-কান বন্ধ করে আমি কিছু দেখি নাই আমি কিছু শুনি নাই অবস্থায় থাকতে হয়!
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে দেশের মানুষ খুশি হলেও বিএনপির নেতাকর্মীরা কোন প্রতিক্রিয়া দিতে পারেনা! এসব নিয়ে আত্মপরিচয়-আত্মজিজ্ঞাসার সংকটে বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থকরা। তারা যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িতই না থাকবে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে সমস্যা কোথায়? তারা যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল হবে তাহলে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্যে তাদের বাধা কেনো? যখন কোন ইস্যুতে জনগনের সামনে কোন রাজনৈতিক দলের স্পষ্ট অবস্থা থাকেনা সে রাজনৈতিক দল দেশের মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়না। সে রাজনৈতিক দল উদ্দেশ্যবিহীন নৌকার মতো চলতে থাকে ঘুরতে থাকে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলোর মূলধারা হওয়া স্বত্ত্বেও মানুষের মনে বন্দরে বিএনপি দলটির তাই না ঘরকা না ঘটকা অবস্থা।