গত ১৬ই অক্টোবর ২০২২, সিডনির উপশহর ক্যাম্পসিতে “ওরিয়ন ফাংশন সেন্টার”-এ অত্যন্ত আনন্দঘন, বর্ণিল ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে শারদোৎসবের আমেজে অস্ট্রেলিয়ার ২১টি পূজা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বিত “বিজয়া সম্মিলন ২০২২” অনুষ্ঠিত করেছে। অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর পরিবেশে এই হৃদয়গ্রাহী সান্ধ্য অনুষ্ঠানটি শত শত দর্শক-শ্রোতা ও অতিথিবৃন্দ মুগ্ধমনে উপভোগ করেছেন। এতগুলো সংগঠনের সমণ্বয়ে এরকম মনমাতানো পরিবেশনা সিডনির ইতিহাসে এই প্রথম। বৈচিত্র্যময় এই অনুষ্ঠানটি সিডনি’র সঙ্গীত ও সংস্কৃতিপ্রেমিক মানুষের মনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বহুদিন। আমাদের সবার পরিচিত মুখ, তুষার রায় এই বিজয়া সম্মিলন অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। প্রথমেই বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য/সদস্যবৃন্দ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। এরপর আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নীলাদ্রী চক্রবর্তী’র নেতৃত্বে উপস্থিত কিশোর-কিশোরীরা অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে।
এরপর শ্রী শ্রী চন্ডীর স্তোত্র পাঠ আর এর সাথে ঢাক-ঢোল, কাঁসর-ঘন্টা-শঙ্খ ও ঊলুধ্বনি দিয়ে বিজয়া সম্মিলনের এক অপূর্ব সুন্দর আবহ সৃষ্টি করা হয়। দু’জন সিনিয়র দম্পতি যথাক্রমে বাংলাদেশ থেকে আগত সম্মানিত অতিথি, শ্রী মনোরঞ্জন সাহা ও শ্রীমতি সন্ধ্যা সাহা এবং সিডনি কমিউনিটির সদস্য, শ্রী মৃণালেন্দু শেখর দে এবং ডাঃ রমা দে, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে বিজয়া সম্মিলন অনুষ্ঠানটির শুভ উদ্বোধন করেন। এরপর পবিত্র গীতা থেকে শ্লোক পাঠ করেন শ্রী জ্যোতির্ময় বিশ্বাস।
শুভ উদ্বোধনীর পর এই বিজয়া সম্মিলন আয়োজনের মুখ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে সকল সংগঠনের পক্ষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পাঠ করেন অনুষ্ঠান এর সঞ্চালক তুষার রায়। গত বছর দুর্গাপূজায় মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক সংখ্যালঘুদের উপর যে সহিংস হামলা ও তাণ্ডব চালানো হয়েছিল, তার উপর আকাশ দে’র সম্পাদনায় মিডিয়া টিম একটি সংক্ষিপ্ত ডকুমেন্টারী উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপন করে। এই ডকুমেন্টারি, অত্যন্ত সংগত কারনেই সবাইকে আবেগে আপ্লুত করে এবং কিছুক্ষণের জন্য পুরো হলজুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সেই ন্যাক্কারজনক হিংস্র ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে যথাযথ বিচারের জোর দাবী ওঠে। ঐ ঘটনায় আহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি সংহতি জানানো হয়। এরপর গত বছর দুর্গাপূজার হামলায় নিহত এবং অতি সম্প্রতি পঞ্চগড়ে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে অকালে প্রাণ বিসর্জন দেয়া সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় এবং সকলের বিদেহী আত্মার পারলৌকিক শান্তি কামনা করা হয়।
“অশুভের বিনাশ হোক, শুচি হোক বিশ্বলোক” সম্মিলনের এই প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপর মূল্যবান ও তাৎপর্যপূর্ণ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন, সিডনি’র পরিচিত মুখ, সাংবাদিক, কলামিস্ট, ছড়াকার শ্রী অজয় দাশগুপ্ত। এরপর ইসকন এর পক্ষ থেকে অতিথি হিসেবে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন শ্রী জনার্দন দাস প্রভু। এই বিজয়া সম্মিলন আয়োজককারীদের পক্ষ থেকে এরপর সিডনিস্থ সংগঠনগুলির প্রতিনিধিবৃন্দ বিজয়ার শুভেচ্ছা জানান। এর পরেই আন্তঃরাজ্য সংগঠনগুলির প্রেরিত শুভেচ্ছাবাণী পাঠ করে শোনান অনুষ্ঠানের সঞ্চালক, তুষার রায়।
বৈকালিক চা-চক্রের বিরতির মাঝেই অনুষ্ঠানে আগত শত শত পরিবারের সদস্যবৃন্দ পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিজয়ার শুভেচ্ছা ও কুশলাদি বিনিময় করেন। আবার ক্ষণিকের জন্য মানুষ ঢাক আর বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নেচে উচ্ছ্বাস, আনন্দ ও উদ্দীপনা প্রকাশে মেতে উঠেন। ফলে এই সম্মিলন সুখানন্দের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস আর উল্লাসের মিলনমেলায় পরিণত হয়। অনুষ্ঠানের স্বার্থে এক সময় এই ঢাক-ঢোল, বাদ্যযন্ত্র এবং নাচের রাশ টেনে শুরু করা হয় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার যার জন্য অগণিত দর্শক-শ্রোতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। এই পর্বটি উপস্থাপনা করেন আর এক সুপরিচিত উপস্থাপিকা দেবযানী রায় চৌধুরী। তাঁর স্বভাবসুলভ উপস্থাপনা ছিল অসাধারণ – যেমন ছিল প্রাণবন্ত, তেমনি ছিল হৃদয়গ্রাহী।
এই উৎসবমুখর সন্ধ্যায় সকল সংগঠনের পক্ষ থেকে নাচ, গান আর কবিতা দিয়ে সাজানো সমন্বিত সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ছিল মনমাতানো, যা দর্শক-শ্রোতাদের অকুন্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছে। তারপর ছিল স্থানীয় অতিথি শিল্পী, অন্তরা সিনহা ও শ্যামতনু ব্যানার্জি’র গান এবং কোলকাতা থেকে আগত বাচিক শিল্পী সাম্য কার্ফা’র চমৎকার আবৃত্তি। এই বাচিক শিল্পী সবাইকে মোহমুগ্ধ করে রেখেছিল, যা মনে থাকবে দীর্ঘদিন। পরিশেষে “বিজয়া সম্মিলন ২০২২” উদযাপন কমিটির সমন্বয়ক, ডঃ সমীর সরকার, এই সম্মিলিত ‘বিজয়া সম্মিলন’ এর সাথে যুক্ত সকল সংগঠনগুলোসহ সকল স্বেচ্ছাসেবক, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং স্পনসরদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে এই অনন্য আয়োজনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। জয়তু বিজয়া সম্মিলন ২০২২।