বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থতি, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট জেলায় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দিনাজপুর বা কুড়িগ্রামের অনেক জায়গায় স্থানীয়রা বলছেন তারা জীবনে এরকম দুর্যোগের মুখোমুখি হননি।
সরকারি হিসাবেই ২১টি জেলায় অন্তত ৩৩ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৪০ ছাড়িয়ে গেছে।
অনেকগুলো জেলায় রাস্তা, রেললাইন ডুবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উপদ্রুত লাখ লাখ মানুষ সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও উঁচু জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
পুরো দিনাজপুর জেলাই বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে পাঁচদিন ধরে। সেখানকার মানুষ গত প্রায় তিন দশকে বন্যার এত পানি দেখেননি।
বন্যায় তলিয়ে থাকা দিনাজপুর শহরের একটি স্কুলে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ইয়াসিন আলী বলছিলেন, “জেলা শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে গ্রামে আমার ঘরের টিনের চাল পর্যন্ত পানি। ঘরের কিছুই বের করতে পারিনি। শুধু মানুষগুলো বেরিয়ে এসে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছি। এখানে খাদ্য এবং খাবার পানির অভাবে আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি।”
একই আশ্রয়কেন্দ্রে দুই শিশু এবং স্বামীসহ উঠেছেন নূরজাহান বেগম। তিনি বলছিলেন,সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা, কারও কাছ থেকেই সেভাবে ত্রাণ সহায়তা তাঁরা পাচ্ছেন না।
তিনি বা তাঁর স্বামী একবেলা খেয়েও বেঁচে থাকতে পারবেন। কিন্তু তিনি কোলের দুই শিশুর খাবার জোগাড় করা নিয়ে চরম দুরবস্থায় পড়েছেন।
দিনাজপুরে এবারের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে আমন ধানের। সেখানকার সাংবাদিক আসাদুল্লাহ সরকার জানিয়েছেন, দিনাজপুরে দুই লাখ আটাত্তর হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়।
দিনাজপুরে আগেই আমন ধান রোপন করা হয়েছে। বন্যায় দুই লাখ হেক্টর জমিই পানির নিচে গেছে। নতুন করে আমন রোপনের বীজতলাও নেই। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পরিস্থিতি সামলে ওঠা বেশ কঠিন হবে বলে তিনি মনে করেন।
উত্তরের বন্যা কবলিত আরেকটি জেলা গাইবান্ধার শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। সেখানকার মানুষের মাঝে আতংক তৈরি হয়েছে।
জেলাটির পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রৌকশলী মাহবুবুর রহমান বলছিলেন, “গাইবান্ধাকে রক্ষার জন্য ২২৭ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এই বাঁধের বিভিন্ন জায়গায় ইঁদুর আর উইপোকার গর্ত। এসব গর্ত দিয়ে পানি ঢুকে বাঁধের ক্ষতি হচ্ছে। তবে গর্তগুলো বন্ধ করা হচ্ছে। আর এখন পানি কমতে শুরু করায় বাঁধ ভাঙ্গার সম্ভাবনা নেই।”
উত্তরের কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাটসহ অন্যান্য জেলাগুলোতেও এবং বিভিন্ন নদীর বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় মানুষকে বেশি দুরবস্থায় পড়তে হয়েছে।
নদী এবং বন্যা নিয়ে কাজ করেন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ। তিনি বলছিলেন, “কখনও খনন না করায় উত্তরের নদীগুলো সব ভরাট হয়ে গেছে।ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং উজানে ভারত থেকে যে পানির ঢল এসেছে, তা এখানকার নদীগুলো ধারণ করতে পারেনি এবং অনেক নদীর বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।”
“আর বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় অনেক উঁচু হয়ে জ্বলোচ্ছাসের মতো হু হু করে পানি এসেছে বিস্তীর্ণ এলাকায়। এমন ভয়াবহ পানির তোড়ে অনেক এলাকার মানুষ ভিটেমাটিতে সব ফেলে শুধু নিজের জীবনটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে।”
উত্তর পূর্বে সিলেট অঞ্চলে সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যায় এবার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলছিলেন, “উত্তরে যমুনা নদীর পানি এখন কমতে শুরু করেছে। এই পানি পদ্মা নদী দিয়ে বেরিয়ে যাবে। ফলে এখন রাজবাড়ী, শরিয়তপুর, মুন্সিগঞ্জসহ মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে বন্যার পানি আসছে।”
সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন যে, এবার উত্তরের জেলাগুলোর মানুষ আগের বছরগুলোর তুলনায় বয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছেন।
এই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা দাবি করেছেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা তারা করছেন। ( বিবিসি বাংলা)