মামুন বদরুদ্দোজা পলাশ:বিদেশের মাটিতে যেকোনো বাংলা বাংলাদেশী সংগঠনের জন্য বছর-বছর ধরে ভালোভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়, আর নিরলসভাবে সেবা করে এক যুগ পার করাতো অনেক চ্যালেঞ্জিং, বিশেষত মেলবোর্নের মতো জায়গায়, যেখানে মানুষজন পশ্চিমা ভাবধারায় লালিত, যেখানে দৈনন্দিন জীবন প্রতিনিয়ত সংগ্রামী।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে “ওয়েস্টার্ন রিজিওন বাংলা স্কুল” বাংলাভাষী মানুষজনের কাছে একটি পরিচিত প্রতিষ্ঠানের নাম। মেলবোর্নে ব্যস্ত জীবনে প্রতি রবিবার এখানে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের বাংলা শেখানোর প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছে এই স্কুল সেই ২০০৬ সাল থেকে। বাংলাঅক্ষর, শব্দকথা, বাংলা লেখা, ছড়া-গল্প-কবিতার পাশাপাশি তারা শেখে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ।এছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে, পহেলা বৈশাখ এই বিশেষ দিনগুলি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয় বাংলাদেশকে।
একদিকে বাচ্চারা যেমন তাদের নতুন বন্ধু খুঁজে নেয় তেমনি মেলবোর্নে আসা নতুন পুরাতন, পরিচিত অপরিচিত মানুষের মাঝে চেনাজানার প্লাটফর্ম হিসাবেও কাজ করছে এই বাংলা স্কুল। তাইতো দেখা যায় প্রতি রবিবার কিংবা অন্যান্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলাভাষী মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ। বাংলা স্কুলের কার্যক্রম বিস্তৃত করার লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছে “ভিক্টোরিয়ান বাংলাদেশী কমিউনিটি ফাউন্ডেশন” বা ভিবিসিএফ। ভিবিসিএফ-এর লক্ষ্য হলো “Bringing the Community together” ।
মাধ্যমে বাংলা স্কুল ছাড়াও এখন নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে বড় ও ছোটদের আরবি/ইসলামিক ক্লাস। এখানে আরও হয়েছে স্পোর্টস ক্লাব যেখানে বাংলা স্কুলের একই ভেন্যুর জিম-এ প্রতি রবিবার হয় ব্যাডমিন্টন, অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন ইনডোর/আউটডোর গেমস-এর টুর্নামেন্ট বছরের বিভিন্ন সময়ে। মেলবোর্ন প্রবাসী বাংলাভাষী সংস্কৃতমনাদের জন্য “প্রবাস-ধ্বনি” যেখানে বড়োদের সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি ছোট বাচ্চাদের জন্য আর্ট, নাচ, গান ইত্যাদি নিয়মিত শেখানোর ব্যবস্থা হচ্ছে, এছাড়া “ভিক্টোরিয়ান বাংলা মোবাইল লাইব্রেরি”-যার মাধ্যমে প্রবাসীরা বাংলা বই লেনদেন করতে পারেন। “ভিবিসিএফ”‘-এর উদ্যোগে “বিগত কয়েক বছর যাবৎ একুশে ফেব্রুয়ারী পালিত হচ্ছে “International Mother Language Day ” হিসাবে, স্থানীয় সিটি কাউন্সিলের সাথে যৌথভাবে, যেখানে অস্ট্রেলিয়ান ও অন্যান্য দেশের অভিভাসীরাও অংশগ্রহণ করছে। এছাড়া “বাংলাদেশ হাই কমিশন ক্যানবেরা” কর্তৃক মেলবোর্ন কনস্যুলেট ক্যাম্পে নিয়মিত সহযোগিতা দিয়ে থাকে এই সংগঠন।
এবছর ২০১৮-তে “ওয়েস্টার্র্ন রিজিওন বাংলা স্কুল’ নানা প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ১২ বছর বা এক যুগে পড়লো। এই উপলক্ষে শনিবার ৩রা নভেম্বর অনুষ্ঠিত হলো এক যুগ পূর্তি বেশ আড়ম্বরের সাথে। স্থানীয় সুজান কুরি হাইস্কুলের বিশাল মিলনায়তনে, অতিথিদের মাঝে বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্বে থাকা বাংলা স্কুলের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল ও ভিবিসি।এফ/বাংলা স্কুল কাউন্সিলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্যবৃন্দ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় এমপি জোয়ান রাইয়ান, বাংলা স্কুলের চিফ প্যাট্রন জনাব কামরুল চৌধুরী, ভিক্টোরিয়ান স্টেট ইলেক্শনের নির্বাচনী আমেজ এখন মেলবোর্নে, তাই অস্ট্রেলিয়ার প্রধান জনপ্রিয় দুই দল, লেবার ও লিবারেল-এর স্থানীয় ও আশেপাশের নির্বাচনী এলাকার বেশ কয়েকজন প্রার্থী ছাড়াও স্বতন্ত্র বেশ কয়েকজন প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন নিজেদের পরিচিত করানোর উদ্দেশে।
অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশ দুই দেশের জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করেন সরোদ খন্দকার ও অনন্যা চক্রবর্তী। বক্তৃতা করেন ভিবিসিএফ-এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট নুসরাত ইসলাম বর্ষা ও বাংলা স্কুলের প্রিন্সিপাল অতি পরিচিত মুখ মোর্শেদ কামাল। বক্তারা বাংলা স্কুল ও ভিবিসিএফ-এর বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন, নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশকে পরিচিত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমে আরো বেশি সম্পৃক্ত ও সহযোগিতার আহ্বান জানান. অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, ছিল দুই পর্বে ( ছোট ও বড়োদের ) বিভক্ত, কমবেশি প্রায় সত্তর জন ক্ষুদে শিল্পীদের এই পর্বের বাচ্চাদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন বাংলা স্কুলের শিক্ষিকারা যথাক্রমে তামান্না, পিয়া, রুমানা, রুদাবা, শিল্পী ও ডোরা। আয়োজেন সাজানো ছিল ফেরদৌস নজুলার পরিচালনায় নাটিকা, সায়েরা ও অনন্যার পরিচালনায় দুই গ্রুপে নৃত্য, আর ছোটদের সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন শুভ্রা, এর বাইরেও ছিল নাফিসার পরিকল্পনায় মনোজ্ঞ ফ্যাশন শোর অয়োজন।
জাহিদ মজুমদারের পরিচালনায় বড়োদের অনুষ্ঠানও ছিল বৈচিত্রময়, সুবর্ণা ও তাসলিমার আবৃতি, সায়েরার নৃত্য, সংগীতে অংশ নেন পিনাকী, মিথিলা, সুমি, অনি, রিমন, পল্লব ও অন্যান্য বেশ কয়েকজন। এক যুগ পূর্তির এই মহেন্দ্রক্ষনে পঞ্চাশটিরও বেশি ক্রেস্ট বিতরণ পর্বে অতিথি, স্পনসর, এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্যবৃন্দ, বাংলাস্কুল ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের টিচার ও ট্রেইনার বৃন্দ, সাব কমিটির সদস্যবৃন্দের মাঝে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। এছাড়া ভলান্টিয়ার ও পারফরমারদের(ক্ষুদে ও বড় ) দেয়া হয় বাংলা স্কুল ও এক যুগের লোগো সম্বলিত মেডেল। ক্রেস্ট বিতরণের পর্বগুলোর উপস্থাপনা ও অন্যানো দায়িত্বে ছিলেন নুরুল ইসলাম মানিক, রাকিব দেওয়ান, রিপন, জামিল, ইফতি ও পলাশ।
অনুষ্ঠানের শব্দ নিয়ন্ত্রণ বা সাউন্ড-এর দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেন রেহান ও মিজান. মিলনায়তনের বাইরে ছিল দেশীয় বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের স্টল, সেখানেও ছিল ব্যাপক ভিড়।
মেলবোর্নে বসবাসরত বিভিন্ন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা এ অনুষ্ঠানে স্পন্সরশিপের মাধ্যমে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাদের জন্য ক্রেট বিতরণ পর্ব পরিচালনা, কৃতজ্ঞতা ও সকলকে ধন্যবাদ দেন ভিবিসিএফ-এর সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলী. অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে বিভিন্ন পর্বে অংশগ্রহণকারী পারফরমার, ভলান্টিয়ার ও উপস্থিত সকলের জন্য হালকা নৈশভোজের ব্যবস্থা করা হয়।