ফজলুল বারী:বাংলাদেশ এখন নির্বাচনী জ্বরাক্রান্ত। একটি সাংবিধানিক দলীয় সরকারের অধীনে এবার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। কিন্তু এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে সব সমস্যা-সমালোচনা-অভিযোগ উঠছে এর অনেক কিছুই নতুন। এসবের উৎস বৃত্তান্ত এ লেখায় পর্যালোচনা করবো। শাসক দলটি আওয়ামী লীগ। এ দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। অথচ এ দলটিকে নিশ্চিহ্ন করতে হত্যা করা হয়েছে দলটির প্রান পুরুষ ও বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে। শুধু তাই নয়, এ দলটি যাতে আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্যে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যাও করা হয়েছে। এরপর আবার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে দলটির বর্তমান নেত্রী শেখ হাসিনাকে! সেই নেত্রীর নেতৃত্বেই ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলটি ভূমিধস বিজয় সহ ক্ষমতায় ফিরে আসে। সেই থেকে শেখ হাসিনা দোর্দন্ড প্রতাপে ক্ষমতায়। এবার তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন দৃশ্যমান উন্নয়ন-অগ্রগতির মহাসড়কে।
অথচ যারা এই শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে মেরে ফেলতে চেয়েছিল তারাই এবার তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের সুবিধাভোগী সহযোগী ডক্টর কামালকে হায়ার করে তার নেতৃ্ত্বে একটি জোট গঠন করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অস্ত্রহাতে প্রতিবাদ করা কাদের সিদ্দিকীও সামিল হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর মেয়েকে ক্ষমতাচ্যুত করার মিশনে! নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার পর থেকে এদের সম্মিলিত হুংঙ্কার, এই করে ফেলবো সেই করে ফেলবো! এরপর হুমকিদাতারা সম্ভবত যে বিষয়টি মাথায় রাখেননি তাহলো আওয়ামী লীগ কোন ভূঁইফোঁড় দল নয়, এর নেত্রী শেখ হাসিনাও কোন ভূঁইফোঁড় নেত্রী নন। তাদের মতো ভূঁইফোঁড়দের হুমকি-ধামকির পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত একটি সাংবিধানিক সরকার যে বসে বসে বাদাম খাবেনা তা এখন তারা ঢের বুঝতে পারছেন।
এর আগে কোনদিন এমপি হতে না পারা এবং রাজনৈতিক বহুগামী মাহমুদুর রহমান মান্না এবার বিএনপির ধানের শীষে এমপি হবার স্বপ্ন দেখছেন। ১/১১’র সময়কার সামরিক সরকারের দোসর মান্না হুমকি দিয়ে বলেছিলেন অমুক দিন থেকে প্রশাসন আর শেখ হাসিনার কথা শুনবেনা। এখন কি অবস্থা? মান্না কী টের পাচ্ছেন প্রশাসন শেখ হাসিনার জন্যে এখন আরও একাট্টা। বিএনপি আগে বরাবর হুমকি দিয়ে বলতো অমুক ঈদের পর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে! এখন বলছে অমুক দিন সেনাবাহিনী নামার পর তারা আবার মাঠে নামবে! কিন্তু অতি চালাক দলটির হিসাবের ভুলটি হচ্ছে এই সেনাবাহিনী তাদের চিন্তার সেই সেনাবাহিনী না। খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে বের করে দেবার সময় তিনি এই সেনাবাহিনীকে দেখে নেবার হুমকি দিয়েছিলেন! ঢাকা শহরের ভিতরের সেই নয় বিঘা জমির বাড়িত যেটিতে খালেদা জিয়া একা থাকতেন সেখানে বিশাল সব এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স গড়ে তোলায় সেগুলো এখন থাকেন বাংলাদেশের কয়েকশো সেনা কর্মকর্তার পরিবার। পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে বাংলাদেশের চলতি সব বড় অর্থনৈতিক যজ্ঞের সঙ্গে আর্মি ইঞ্জিনীয়ারিং কোর জড়িত। ইনারা আরও যা ভুলে বসে আছেন তাহলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ সাংবিধানিক সরকারের অধীনে সেনাবাহিনী শুধুমাত্র তাদের দেয়া সাংবিধানিক দায়িত্বই পালন করবে।
এবার নির্বাচনী তফসিলের পর মনোনয়ন পর্বে বিএনপি-জামায়াতের প্রস্তুতি ছিল সবচেয়ে বড়। পঁচিশ হাজার টাকা মূল্যের মনোনয়নপত্র তারাই সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছে। মনোনয়ন বিক্রিকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টন আর গুলশানের অফিসের সামনের ভিড়বাট্টা দেখে অতি উৎসাহীরা বলা শুরু করেছিলেন এবার বিএনপির ক্ষমতায় ফেরায় ঠেকায় কে? কিন্তু দলটি যে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সামরিক ফরমানে গড়া, আরাম খাঁটি নারকেল তেল মাথায় মাখাদের দল, ক্ষমতায় না থাকা অবস্থায় এটি যে ছত্রখান, আশা বিলাসীরা বিষয়টি মাথায় রাখেননি।
বাংলাদেশের আইনে দন্ডিত পলাতক, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব-পাসপোর্ট ত্যাগকারী বিএনপির নেতা তারেক রহমান স্কাইপেতে ইন্টারভ্যু নিয়ে প্রার্থী ঠিক করেছেন। পরিবর্তনের শ্লোগান দিয়ে তারা কী সব প্রার্থী নিয়েছেন সে তালিকা এখন সবার সামনে। প্রার্থীদের নানা আইনগত সমস্যা মাথায় রেখে একেকটি আসনে তিন-চারজন প্রার্থীও দেয়া হয়েছে। নিবন্ধনহীন যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের প্রার্থীদের প্রতারনামূলক বিএনপির পরিচয়ে করা হয়েছে ধানের শীষের প্রার্থী! বিশাল সব আইনজীবীদের দল বিএনপি। সর্বশেষ এখানে ডক্টর কামালকেও হায়ার করা হয়েছে। ২০০৪ সালের নির্বাচন ঠেকানোর ভয়াবহ অভিযান পেট্রোল বোমায় মানুষ পুড়িয়ে দেবার আসামীকে আইনত নিরাপদ করতে এই আইনজীবীরা কী করেছেন। জামায়াতের প্রার্থীদের বিএনপি পরিচয় দিয়ে প্রতারনামূলক বিএনপির প্রার্থী করা! দেশের আইন কি তখন চোখ বন্ধ করে থাকবে? মনোনয়নের পর শুরু হলো মনোনয়ন বানিজ্যের অভিযোগ। মালয়েশিয়াবাসী একজন আদম ব্যবসায়ীকে মোটা টাকা বিনিয়োগের বিনিময়ে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে! এমন নানান এলাকায় মনোনয়ন বানিজ্যের অভিযোগ। মনোনয়নের আগে কী পেট্রোল বোমায় মানুষ পুড়িয়ে মামলার আসামীদের বিষয়টির আইনগত দিক ফয়সালা করা হয়েছে? না মনে করা হয়েছে তফসিল ঘোষনা করলেই এসব মামলা সব তামাদি হয়ে যায়? মাথায় এতো বুদ্ধি লোকজনের!
নির্বাচনী মাঠে নিজেদের গোলমাল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কিছু অতি উৎসাহী কর্মীদের হামলায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। কিন্তু প্রথম থেকে সারাদেশের চিত্রটি হলো আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মাঠে ময়দানে যেভাবে সরব, বিএনপির প্রার্থীরা সেভাবে মাঠে ময়দানে নেই। কেনো নেই, এসব কৌশল কিনা না সাংগঠনিক দূর্বলতা, এসব নিয়ে নানা পত্রিকায়-টিভিতে রিপোর্ট হয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, পোষ্টার ছিঁড়ে ফেলা এমন অনেক অভিযোগ আসছে। এমন ঘটনা ঘটেছে, ঘটছেও। আওয়ামী লীগ যখন বিরোধীদলে ছিল এমন হামলা-হয়রানি হয়নি? মানুষ কী সে ঘটনাগুলো ভুলে গেছে? আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তখন সমর্থক-জনগনকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে না মাঠ ছেড়ে চলে গেছে? এরমাঝে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছাপা হয়েছে কালের কন্ঠে। ওই রিপোর্টে দেখানো কয়েকটি আসনের প্রার্থীরা সেভাবে মাঠেই নামেননি। পোস্টারও ছাপা হয়নি। নির্বাচনী কর্মীদের সংগঠিত করে যে সব কাজকর্ম করা হয় সে সবও মাঠে ময়দানে অনুপস্থিত। এখন তারাই বলে বেড়াচ্ছে সেনাবাহিনী নামার পর নামবে! আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এরমাঝে মাঠে-ময়দানে যেভাবে এগিয়ে গেছে তাতে কী তারা তখন পিছিয়ে পড়বে?
গত দশ বছরে বিএনপি বিরোধীদলের ভূমিকায় আন্দোলনে কেনো ব্যর্থতা নিয়ে অনেক পর্যালোচনা হয়েছে। এসবের সারকথা হলো বিএনপি বিপ্লবী কথাবার্তা বলেছে, কিন্তু এটি কোন বিপ্লবী সংগঠন নয়। পরিবার ভিত্তিক দলটি দূর্নীতির মামলায় পর্যুদস্ত। বিরোধীদলে থাকতে আওয়ামী লীগ যেমন সারাদেশের কর্মী-সমর্থকের পাশাপাশি জনগনকে যেভাবে সংগঠিত করে সব বাধা পেরিয়েছে বিএনপি দলীয় চরিত্রের কারনে তা পারেনি। এখন ডক্টর কামাল-রব-মান্না-কাদের সিদ্দিকীর বড় বড় গর্জন দলটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু মাঠে মানুষকে সংগঠিত করে যেভাবে এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় এ যোগ্যতা প্রদর্শনে বিএনপি-জামায়াত-ঐক্যফ্রন্ট ব্যর্থ। সে কারনে নির্বাচনী ডামাডোলের শুরুর দিকে সরকারি দলকে যতোটা হতভম্ব মনে করা হয়েছিল তা এখন আর নেই। বিপ্লব শুধু কথাবার্তা বাগাড়ম্বরেই হয়না, বিপ্লবীদের অনেক কষ্ট-সংগ্রাম শেষে জয় করতে হয় মকসুদে মঞ্জিল। এসব বিএনপিগং রপ্ত করার দল-সংগঠন নয়। নৈতিক-সাংগঠনিক সমস্যায় ছত্রখান বিএনপির দুরাবস্থাকে কাজে লাগিয়ে তাই নৌকা এগিয়ে চলছে তরতরিয়ে।