চায়ের আড্ডায় সিগারেটের কাগজে যেভাবে জন্ম হয় ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটির

চায়ের আড্ডায় সিগারেটের কাগজে যেভাবে জন্ম হয় ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটির

ছবিঃ সংগৃহীত

 

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। তারিখটা ১৩ অথবা ১৫।

প্রায় হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায় কালচে-নীল রঙের কালিতে ইংরেজিতে লেখা তারিখটায় লেখক দুবার কলম বুলিয়েছিলেন। গোটা গোটা অক্ষরে নিজের হাতেই গানটা লিখেছিলেন অংশুমান রায়।

তাই ১৩ না ১৫, সেটা নিয়ে একটু ধোঁয়াশা রয়েছে।

তারিখটা যাই হোক, সেই দিন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে রাতে ‘সংবাদ পরিক্রমা’য় বাজানো হয়েছিল একটি গান।

পুরো গানটা একবারে বাজানো হয় নি অবশ্য। একটি ভাষণের মাঝে মাঝে বেজেছিল গানটি।

ভাষণটা ছিল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ।

আর গানটা ছিল ”শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রনি.. বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।”

কালো শক্ত মলাটের খাতাটার পাতাগুলো হলুদ হয়ে এসেছে। অনেক পাতাই আলগা হয়ে গেছে খাতা থেকে।

“এটাই আমার বাবার সেই সময়কার গানের খাতা,” একটা একটা করে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলছিলেন ভাস্কর রায়।

তিনি থামলেন ১৪৭ নম্বর পাতায় এসে।

বাবার গানের খাতার পাতা ওল্টাচ্ছেন ভাস্কর রায়। (ছবি সূত্রঃ বিবিসি বাংলা)

গোটা গোটা অক্ষরে নিজের হাতেই গানটা লিখেছিলেন অংশুমান রায়।

একেবারে নীচে, বাঁদিকে লেখা আকাশবাণী থেকে প্রচারের দিন: দুবার কলম বোলানোর ফলে যে দিনটা ১৩ হতে পারে, আবার ১৫-ও হতে পারে।

“তারিখটা যাই হোক, যেদিন রেডিওতে গানটা বেজেছিল বঙ্গবন্ধুর ওই ঐতিহাসিক ভাষণের মাঝে মাঝে, সেদিন সকালেই গানটা লেখা আর সুর করা হয়েছিল,” জানাচ্ছিলেন অংশুমান রায়ের বড় ছেলে ভাস্কর রায়, যিনি নিজেও একজন লোকসঙ্গীত শিল্পী।

তিনি আরো বলছিলেন: “গানটা লেখা আর সুর করা হয়েছিল যেভাবে, সেটাও একটা গল্প।”

কলকাতার দক্ষিণে যে গড়িয়া এলাকা, সেটা তখনও এখনকার মতো শহরের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়েনি।

ওই শহরতলি অঞ্চলের বেশির ভাগটাতেই গড়ে উঠেছে ১৯৪৭ এর দেশভাগের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা উদ্বাস্তুদের কলোনি।

রামগড়েরর পদ্মশ্রী সিনেমা হলের কাছেই একটা চায়ের দোকানে নিয়মিত আড্ডা বসত ওই অঞ্চলেরই বাসিন্দা কয়েকজন গীতিকার, সুরকার আর গায়কেরা।

বাঁ দিক থেকে: অংশুমান রায়, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, অমিতাভ নাহা, দিনেন্দ্র চৌধুরী। (ছবি সূত্রঃ বিবিসি বাংলা)

“বাবা, গৌরীজেঠু (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার), দিনেন জেঠু (দিনেন্দ্র চৌধুরী) এরা সকলেই নিয়মিত আড্ডা মারতেন। হয়তো সকালে বাজারে বেরলেন বাবা, চায়ের দোকানে আড্ডা মেরে বাজার করে তারপর বাড়ি ফিরলেন।”

“আবার কখনও আমাদের বাড়িতে বা গৌরীজেঠুর বাড়িতেও আড্ডা মারতেন সবাই। ৭১ সালের যে দিনটার কথা বলছি, সেদিনও ওই চায়ের দোকানে আড্ডা বসেছে। বাবা, গৌরীজেঠু, দিনেন জেঠুরা তো ছিলেনই, এসেছিলেন উপেন জেঠুও (উপেন তরফদার),” বাবার কাছ থেকে সেদিনের ঘটনা যেভাবে শুনেছিলেন, সেটাই বলছিলেন ভাস্কর রায়।

সেদিনের আড্ডায় যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার প্রখ্যাত গীতিকার।

দিনেন্দ্র চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসঙ্গীতের অধ্যাপক এবং সেই সময়ের একজন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিক্ষক।

উপেন তরফদার ছিলেন আকাশবাণীর প্রযোজক। পুরনো দিনে যে স্পুল টেপ রেকর্ডার ছিল, সেই একটা নিয়ে এসেছিলেন। তাতে শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটা ওই আড্ডাতেই শুনিয়েছিলেন আকাশবাণী থেকে কেন্দ্র অধিকর্তা হিসাবে অবসর নেওয়া মি. তরফদার।

গোটা গোটা অক্ষরে নিজের হাতেই গানটা লিখেছিলেন অংশুমান রায়।(ছবি সূত্রঃ বিবিসি বাংলা)

ভাস্কর রায়ের কথায়, “ওই ভাষণ আর ওপার বাংলার পরিস্থিতি নিয়েই কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু গৌরী জেঠু একটু অনমনস্ক ছিলেন সেদিন। উনি আর আমার বাবা চারমিনার সিগারেট খেতেন।”

“প্যাকেটের ভেতরে একদিকে সাদা যে কাগজটা থাকে, সেই কাগজটা বার করে গৌরী জেঠু কিছু একটা লিখতে থাকেন। মাঝে মাঝে টুকটাক কথাবার্তাও বলছিলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি বাবা আর দিনেন জেঠুর হাতে ওই সিগারেটের প্যাকেটের কাগজটা দিয়ে বলেন দেখ তো চলবে কীনা এটা।”

অংশুমান রায় ওটা পড়েই বলে উঠেছিলেন – “গৌরীদা এটা আপনি আর কাউকে দিতে পারবেন না। এটা আমি সুর করব, আমি গাইব।”

তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুধু হারমোনিয়াম দিয়ে গানটার সুর বেঁধে ফেলেছিলেন অংশুমান রায়।

“উপেন জেঠু ওই স্পুল রেকর্ডারেই গানটা রেকর্ড করে নিয়েছিলেন। সেটা আকাশবাণীর আর্কাইভে রয়েছে। আমি শুনেছি সেটা,” বলছিলেন অংশুমান রায়ের ছেলে।

“বাবার গলা, হারমোনিয়াম আর তালবাদ্য বলতে একটা শক্ত মলাটের গানের খাতায় দিনেন জেঠুর তাল ঠোকা। সংবাদ পরিক্রমা যতটা সময় ধরে হত, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটা তার থেকে কিছুটা ছোট ছিল।”

“তাই প্রযোজক হিসাবে উপেন জেঠু ঠিক করেন যে ভাষণের মাঝে মাঝে বাবার গাওয়া গানটা বাজানো হবে। এটা প্রণবেশ জেঠুও লিখে গেছেন। ওইভাবেই গানটা বেজেছিল সেই রাতে,” জানাচ্ছিলেন ভাস্কর রায়।

গানটি ‘হিন্দুস্তান রেকর্ড’-এর স্টুডিওতে রেকর্ড করা হয়, ৪৫ আর পি এমের রেকর্ডটির একদিকে ছিল শোন একটি মুজিবরের থেকে গানটি।(ছবি সূত্রঃ বিবিসি বাংলা)

আকাশবাণী কলকাতা থেকে যে ”সংবাদ পরিক্রমা” অনুষ্ঠানটি হত সেই সময়ে (এখনও প্রচারিত হয় অনুষ্ঠানটি, কিন্তু ৭১ এর যুদ্ধের আগে পরে ওই অনুষ্ঠানটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল), প্রণবেশ সেন ছিলেন তারই লেখক। সেই অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করতেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

পরের দিন রোজকার মতোই বাজারে গিয়েছিলেন অংশুমান রায়। ফেরার পথে সেই চায়ের দোকানে ঢুকতেই অনেকে মিলে জড়িয়ে ধরেন তাঁকে।

আবার সেদিন অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়ে যাওয়ার পরের দিন যখন উপেন তরফদার আকাশবাণী দপ্তরে ঢুকেছেন, তখন তার ডাক পড়ে কেন্দ্র অধিকর্তার ঘরে।

“আমাদের বাড়িতে অনেক পরে একটা আড্ডায় উপেন জেঠু বলেছিলেন যে তিনি সরাসরি অধিকর্তার ডাক পেয়ে একটু বোধহয় ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলেন। ঘরে ঢুকে তিনি দেখেন আরও অনেকে সেখানে উপস্থিত। কয়েক মুহূর্ত পরে সবাই বলে ওঠেন এটা আপনি কী করেছেন জানেন?”

“উপেন জেঠু বোধহয় তখনও ভাবছিলেন যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাঝে মাঝে বাবার গাওয়া ওই গানটা বাজিয়ে বোধহয় তিনি অন্যায় করে ফেলেছেন। তবে তার ভুলটা ভাঙ্গতে সময় লেগেছিল কয়েক সেকেন্ড। সবাই বলেন যে ঐতিহাসিক একটা অনুষ্ঠান করে ফেলেছেন আগের রাতে,” বলছিলেন ভাস্কর রায়।

পর পর বেশ কয়েকবার ওই গান আর শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণটা সম্প্রচারিত হয় ওই রাতেই।

আর এপ্রিল মাসের ২২ তারিখ গানটি ‘হিন্দুস্তান রেকর্ড’-এর স্টুডিওতে রেকর্ড করা হয়।

৪৫ আর পি এমের রেকর্ডটির একদিকে ছিল ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি। গানের সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন দিনেন্দ্র চৌধুরী।

ওই গানের একটা ইংরেজি অনুবাদও হয়েছিল: A Milliion Mujiburs Singing নামে।

রেকর্ডের একপিঠে ছিল বাংলা আর উল্টোপিঠে ওই একই দিনে রেকর্ড করা হয় ইংরেজি অনুবাদটিও। অংশুমান রায়ের সঙ্গে ইংরেজিতে গেয়েছিলেন করবী নাথ।

মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই নানা জায়গায় বলেছেন বা লিখেছেন যে আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে যখনই এই গানটা বাজানো হত, তখনই নতুন করে লড়াইতে উদ্বুদ্ধ হতেন তারা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব কলকাতার বেশ কয়েকজন বেতার কর্মী এবং গায়ককে স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

বিশেষ ‘সংবাদ পরিক্রমা’র রেকর্ডিং যেটি অংশুমান রায় আকাশবাণী থেকে এনেছিলেন শেখ মুজিবর রহমানকে দেওয়ার জন্য।(ছবি সূত্রঃ বিবিসি বাংলা)

এঁদের মধ্যে ছিলেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, প্রণবেশ সেন আর অংশুমান রায়।

পদক নিতে যাওয়ার কদিন আগে, কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-রাষ্ট্র দূতাবাসে একটি ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন উপ-রাষ্ট্রদূত।

শনিবার, ১৯ জুলাই, ১৯৭৫ সন্ধ্যা সাতটা থেকে সেই ভোজসভা ছিল।

“কিন্তু যেদিন বঙ্গবন্ধু পদকটা পাওয়ার কথা, তার আগে ১৫ই অগাস্ট তো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হল। সেই ইতিহাস সবাই জানি। বাবা কখনও আর বাংলাদেশে যেতে পারেন নি। পাসপোর্ট করানো ছিল যদিও।”

“বাবা ৯০ সালে চলে গেলেন। কিন্তু এই একটা ইচ্ছা পূরণ হয়নি তাঁর। আমাকে তার পুত্র হিসাবে ময়মনসিংহে একটা অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয় ২০১০ সালে। আমি সেই প্রথমবার বাংলাদেশে যাই। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নিয়ে গিয়েছিল আমাকে,” বলছিলেন ভাস্কর রায়।

তার কথায়, “জাতীয় সঙ্গীতের পরেই আমার বাবার গাওয়া ওই গানটা গাওয়া হয়েছিল। আমাকে বলা হয়েছিল বাবার গাওয়া ওই গানটাকে বাংলাদেশের মানুষ এতটাই শ্রদ্ধা করেন যে জাতীয় সঙ্গীতের পরেই এটা গাওয়া হয় অনেক জায়গায়।”

“অনুষ্ঠানটার কথা ভাবলে এখনও আবেগে আমার গলা বুজে আসে কান্নায়। ওই আবেগ থেকেই বোধহয় সেদিন বলে ফেলেছিলাম যে বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে স্বর্ণপদক না নিতে পারার জন্য বাবার আক্ষেপের কথাটা। পরের দিন সেটা কাগজে বেরিয়েছিল।”

মি. রায় জানান, “তার বেশ কিছুদিন পরে আমাকে জানানো হয় যে মুক্তিযুদ্ধের মৈত্রী সম্মাননা দেওয়া হবে বাবাকে – প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর মরণোত্তর সম্মানটা নিতে আমাকে যেতে হবে। এ এক অদ্ভুত সমাপতন।”

“তার বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পদক দেওয়ার, কন্যা দেশনেত্রী হয়ে সেই সম্মান জানাচ্ছেন আর আমি বাবার হয়ে সেই সম্মানটা নিতে যাব!” বলছিলেন অংশুমান রায়ের ছেলে।

অংশুমান রায়ের মৃত্যুর আগে শেষ অনুষ্ঠানে – সঙ্গে পুত্র ভাস্কর রায়।(ছবি সূত্রঃ বিবিসি বাংলা)

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা ,অমিতাভ ভট্টশালী ( ১৭ মার্চ ২০১৯)