ফজলুল বারী : একাত্তর টিভির একাত্তর জার্নালে শুক্রবার রাতে বৃক্ষ মানব আবুল বাজানদারকে আবার নিয়ে আসা হয়েছিল। এরজন্য প্রিয় ফারজানা রূপা এবং একাত্তর টিভিকে ধন্যবাদ। আবুলের হাতপায়ের শেকড় আবার প্রায় পুরনো অবস্থায় ফিরে এসেছে দেখে ভয় করেছে। এই অবস্থা তার ভুলের মাশুল। অথবা এটি আমাদের সবার ব্যর্থতা। আবুল হাসপাতালে যতক্ষন ছিল তখন সে চিকিৎসকদের নজরদারিতে ছিল। আমাদের নিষেধ না শুনে সে যখন একক সিদ্ধান্তে হাসপাতাল থেকে চলে যায় তখন একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত
হয় তাকে নিয়ে রাষ্ট্র এবং আমাদের সবার সংগ্রাম। এখন আবুল এবং চিকিৎসকরা চাইলে তার সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। সেটি হবে আরেক নতুন সংগ্রামের সূচনা।
খুলনার সাংবাদিক সুনীল চৌধুরীর কাছে খবর পেয়ে আমরা যখন আবুলকে ঢাকায় নিয়ে আসি তার চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের কারও কোন ধারনাই ছিলোনা। বাংলাদেশের চিকিৎসকদেরও না। কারন এর আগে বাংলাদেশে এমন রোগীর চিকিৎসা হয়নি। নিয়াজ মাহমুদ নামের আমাদের তরুন বন্ধুটির অবদান এখানে স্মরন করছি। আমাদের অনুরোধে নিয়াজ আবুল পরিবারকে ঢাকায় রিসিভ করে চানখাঁরপুল এলাকার একটা হোটেলে তোলে। পরের দিন সকালে তাকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডাঃ সামন্ত লাল সেনের কাছে নিয়ে যান।
আমাদের সঙ্গে আবুলের প্রথম যখন যোগাযোগ হয়, তখন সে ফোনে শুধু চিকিৎসার জন্য কান্নাকাটি করতো। কিন্তু একটি উন্নত জীবন পাবার পর খুব স্বাভাবিক সে মানুষ হিসাবে বদলে যায়। তখন সে শুধু চায় ভালো পরিবেশ। ভালো ব্যবহার। এটি মানুষ হিসাবে যে কারো স্বাভাবিক প্রবনতা। যাবার আগে একদিন বলেছিল অমুক তার স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। গ্রামে ফিরে গিয়ে ভিক্ষা করে খাবে। তবু এই হাসপাতালে সে আর থাকবেনা। অথচ আবুল ছিল হাসপাতালের এক রকম ভিভিআইপি রোগী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটের একটি কেবিনে রেখে দুই বছরের বেশি সময় ধরে আবুলের চিকিৎসা চলে। পঁচিশটি অপারেশন হয় তার হাতে পায়ে। এর সমুদয় খরচ বহন করেছে রাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রীর রোগীর সঙ্গে হাসপাতালে কারা খারাপ ব্যবহার করতো তাদেরকে শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
হাসপাতালের খাবার আবুল খেতে পারতোনা। কারোই হাসপাতাল বা কারাগারের খাবার বেশিদিন খেতে ভালো লাগার কথা নয়। তাকে ডাক্তারদের কেন্টিনের খাবার দেয়া হতো। সেটাও যখন ভালো লাগতোনা তখন বাইরে থেকে খাবার কিনে দেয়া হতো। হাসপাতালে আবুলের স্ত্রী সন্তানও থাকতো। মাঝে মাঝে তার মা বাবাও এসে থাকতেন। এদের খাবার যাতায়াতের ব্যয়ও বহন করা হতো। দুই বছরের বেশি সময় ধরে তার পরিবারের ভরনপোষণের খরচও আমরা সামলেছি। হাসপাতাল জীবনকে স্বাভাবিক রাখতে তার কেবিনে আমরা ডিশ সংযোগ সহ টিভি, খাবার গরম করার ওভেন, হাতে স্মার্ট ফোন দিয়েছিলাম। অপারেশন থিয়েটারে যাওয়া আসার জন্য আবুলের নিজস্ব একটি হুইল চেয়ার ছিল। সেটি কিনে দেন একজন সাবেক ব্যাংকার। আবুলের জন্য লিখলেই দয়ালু মানুষেরা তার জন্য টাকা খাবার পোশাক নিয়ে হাসপাতালে চলে যেতেন। কাজী বাহার নামের একজন সর্বক্ষনিক স্বেচ্ছাসেবক বন্ধু তার ছিল। তার জন্য দু’বছর বাহার ঈদে বাড়ি পর্যন্ত যায়নি। পুরো ব্যবস্থাপনার তদারকি করতেন ডা: শরফুদ্দিন আহমদ নামের আমাদের এক বড় ভাই। ব্যক্তি জীবনে তিনি আবুলের চিকিৎসা মিশনের প্রধান ডা: সামন্ত লাল সেনের ঘনিষ্ঠ। একজন ডাক্তার তার বাড়ি করার জন্য জমি কিনে দিয়েছিলেন। আবুলের বাবা’র ব্যবসা করার পুঁজিরও আমরা ব্যবস্থা করি। ভবিষ্যতে আবুলের পুনর্বাসনের বেশকিছু প্রতিশ্রুতি আমাদের হাতে ছিল। ডা: সামন্ত লাল সেনের ইচ্ছা ছিল একদিন তিনি আবুলকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে যাবেন। তখন হয়তো আবুলের পুনর্বাসনের জন্য বড় অনুদান পাওয়া যেতো। প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটের নতুন ভবনে তাকে একটি চাকরির প্রতিশ্রুতিও তার ছিল। কিন্তু আবুল বাজানদার হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ায় পন্ড হয় সবার সব আয়োজন সব পরিশ্রম।
আবুল হাসপাতাল থেকে চলে যাবার পর অনেকে অনেক কথা লিখেছেন। আবুলের গোষ্ঠি উদ্ধারও করেছেন। কিন্তু এসবে তার শ্রেনী চরিত্র বিবেচনায় রাখা হয়নি। গ্রামের পড়াশুনা না করা ছেলে আবুল। আমাদের সঙ্গে পরিচয়ের আগে বেঁচে থাকার তাগিদে সে ভিক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই আবুল মিডিয়ার কল্যানে পাদপ্রদীপের আলোয় আসার পর সেলিব্রেটি রোগীতে পরিনত হয়। পায় একটি উন্নত জীবন। আবুলকে দেখতে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে গিয়ে দেখি প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটের বারানদায় শতশত রোগী। আর আবুল থাকতো একটি কেবিনে। বাহারের সহযোগিতায় আমরা তার ভালো চুলকাটা সহ দেখতে ভালো লাগবে এমন একটি চেহারা দিয়েছিলাম। আবুল হয়ে উঠেছিল একটি ইতিবাচক গল্পের নাম।
কিন্তু চিকিৎসা নিয়ে এক পর্যায়ে আবুলের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হয়। কারন তাকে নিয়ে আমেরিকার গবেষনা রিপোর্টে বলা হয় তার সমস্যাটি জিনগত। কাজেই এটি পুরোপুরি ভালো হবেনা। নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে। নিয়ন্ত্রন মানে মাঝে মাঝে অপারেশন। এই হতাশার সঙ্গে যোগ একাধিক জুনিয়র চিকিৎসক এবং হাসপাতালের কিছু কর্মীর দূর্ব্যবহার। কারন আবুল প্রধানমন্ত্রীর রোগী হোক যা হোক তাদের কাছেতো সাবেক গ্রাম্য ভিক্ষুক। এবং তারা শহুরে সাহেব! আবুলের সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের খারাপ ব্যবহার শুরু নিয়ে আমার একটা দায় আছে। আজ এখানে তা প্রথম লিখছি। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশাটাই যেন এমন সব সময় অনেকের মনে হয় আমার কাজটা তিনি আমার চেয়ে ভালো পারবেন বা করবেন। অথচ তার কাজ আমি পারবোনা। একদিন আমার একটি রিপোর্ট নিয়ে এক জুনিয়র ডাক্তার আমার ইনবক্সে লিখেন রিপোর্ট এভাবে নয়, এভাবে লিখতে হয়। উনার অভিযোগের আসল বিষয় ছিলো কেনো আমরা সামন্ত লাল সেনকে বেশি বেশি হাইলাইট করছি। তিনিতো এই চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত না। কেনো অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নাম লিখলাম, ইত্যাদি। বিষয়টি আমার ইগোতে লাগে। আমি আর তার জবাব দিয়ে ব্লক করি ফেসবুকে। এতে করে ওই ডাক্তারের পুরো ক্ষোভ গিয়ে পড়ে আবুল বাজানদারের ওপর। সিনিয়র ডাক্তারদেরও তিনি ক্ষেপিয়ে তুলতে পারেন।
সাংবাদিকতার সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত থাকার কারনে এখন দেশের মিডিয়ার নেতৃত্বের বেশিরভাগ আমার বন্ধু-বান্ধব। এর কারনেই বোধ হয় আবুলের প্রায় রিপোর্টে আমার নাম থাকতো। এতে করে ঝামেলা যেতো আবুলের ওপর দিয়ে। ডাক্তারদের একজন তার কেবিনে গিয়ে একদিন এই বলেও শাসিয়েছেন যে আর কোন মিডিয়ায় অমুকের নাম বললে তারা তাকে জেলে পাঠাবেন! একদিন এক ডাক্তার তার কেবিনে গিয়ে টিভি-মাইক্রো ওভেন এসব দেখিয়ে বলেন, তোমাকে এসব দিয়ে উনারা কত লাখ লাখ টাকা কামাই করছেন জানো? অথচ চিকিৎসাতো চিকিৎসরাই দিচ্ছিলেন। তাদের কারো কাছে যেন নেপথ্যের সহায়কদের প্রতিপক্ষ মনে হচ্ছিল!
উন্নত বিশ্বে চিকিৎসায় ডাক্তারদের পাশাপাশি সোশ্যাল ওয়ার্কার বলে একটি চরিত্র আছে। এটিও সরকার থেকে দেয়া হয়। চিকিৎসকরা চিকিৎসা দেন। সোশ্যাল ওয়ার্কাররা রোগীর কাউন্সিলিং এর কাজ সহ নানা সহায়তার ব্যবস্থা করেন। আবুলের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন চিকিৎসকরা। এটি তারা ছাড়া আর কারও পক্ষে দেয়া সম্ভব না। আমাদের ভূমিকাটি ছিল নেপথ্যের সোশ্যাল ওয়ার্কারের। কিন্তু চিকিৎসকদের কেউ কেউ কেনো জানি এই বন্ধনটি কেটে ফেলার ব্যবস্থা করেন।
ঢাকা শহরে যেহেতু আবুলের কোন স্বজন নেই, স্বেচ্ছাসেবক বাহারই ছিল তার স্বজন-বন্ধ সবকিছু। হঠাৎ করে বাহারকে হাসপাতালে নিষিদ্ধ করা হয়! বেচারা বাহার যেখানে টাকার অভাবে প্রায় দিন ভলোবাসার টানে হেঁটে হাসপাতালে আসা যাওয়া করতো, নিষিদ্ধ হওয়াতে আর হাসপাতালে ঢুকতে পারেনা। হাসপাতালের বাইরে এসে ফোন দিলে আবুল নেমে এসে দেখা করতো চা খেত তার সঙ্গে। বাংলাদেশের চিকিৎসায় যেখানে কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা নেই, উল্টো এভাবে ক্রমে ক্রমে হাসপাতালে আবুলকে একা করে দেয়া হয়। রাষ্ট্র যেখানে তার জন্যে এতোকিছু করলো সেখানে রাষ্ট্রের সমগ্র অর্জনের সুতোটিও এভাবে কেটে দেন এরকিছু কর্মচারী।
আবুল প্রতিদিন তার নানা সমস্যা-দূর্ব্যবহারের ঘটনাগুলো বলতো। তাকে থামিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হতো যে সব সহ্য করে হাসপাতালে পড়ে থাকতে হবে। এরমাঝে আবুলের কেবিন বদলানো হয়। নতুন কেবিনে বলা হয় এখানে এই করা যাবেনা, সেই করা যাবেনা, বাচ্চা কাঁদতে পারবেনা। পুরনো রোগী হিসাবে তার আদরযত্নও কমে এসেছিল। একদিন তার স্ত্রীর সঙ্গে একজন দূর্ব্যবহার করলে সে চূড়ান্ত বিদ্রোহ করে বসে। সে আর হাসপাতালে থাকবেইনা। কোনভাবে সে আমাদের তার পক্ষে নিতে পারছেনা দেখে একদিন আমাদের না জানিয়েই সে চলে গেলো। এমনকি বাহারকেও সে জানিয়ে যায়নি।
আবুল যখন হাসপাতাল থেকে চলে গেলো তখন তার হাতে কিছু টাকা ছিলো। এ টাকা ফুরিয়ে গেলে সে টাকার জন্যে যোগাযোগ করতে থাকে। কিন্তু আমরা তাকে রেসপন্স করিনা। তাকে বলি চিকিৎসায় না ফিরলে তাকে আর কোন টাকা দেয়া হবেনা। ঢাকা মেডিক্যালে যেহেতু সে আর ফিরবেনা সেহেতু অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে শমরিতা হাসপাতালে রেখে তার একটি চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়া হয়। উদ্যোগটি ছিল শমরিতা ফ্রি বেড দেবে। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী অপারেশনের কোন টাকা নেবেননা। শুধু খাবার ও ওষুধের খরচ দিতে হবে। কিন্তু আবুল কবিন ছাড়া থাকবেনা। বলা হলো তোমার স্ত্রীর জন্যে একটা বাসা দেখবো। দিনের বেলা সে হাসপাতালে থাকবে। রাতে থাকবে বাসায়। কিন্তু আবুল কেবিন ছাড়া থাকতে শমরিতা ফ্রি কেবিন দিতে রাজি হলোনা। অতঃপর আবার সে ফিরে গেলো বাড়ি।
এরমাঝে সাংবাদিক শিশির মোড়লের মাধ্যমে একটি চেষ্টা চলতে থাকে। বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠান আবুলের রোগের জিন আবিষ্কারের গবেষনা করতে চাইলো। কথা ছিল এরজন্যে আবুলকে এনে রাখা হবে ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। কিন্তু এরপর আর এ উদ্যোগটিও এগোয়নি। এরপর একই উদ্যোগে আবুলের জিন গবেষনার জন্যে ফ্রান্স নিয়ে যেতে তার পাসপোর্ট বানানো হয়। কিন্তু তহবিল সংকটে এ উদ্যোগটিও থেমে আছে। এই পক্ষেরর ইচ্ছা ছিলো বিদেশে আবুলকে নিয়ে গবেষনা, তার যাবতীয় খরচ বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। কিন্তু এই উদ্যোগটি আর এগোয়নি। অতঃপরর হাতের যন্ত্রনা আর ক্ষুধার জ্বালায় আবুল আবার ফিরে এসেছে হাসপাতালে। কিন্তু এখানে সে আর অপারেশন করবেনা। সে তার হাত কেটে ফেলতে বা বিদেশে পাঠাতে বলছে। চিকিৎসকরা কারও হাত কেটে ফেলেননা। হাতের চিকিৎসা করেন। আবুলের সব অস্ত্রোপচারের সময় চিকিৎসকরা বলতেন তার কোন শিরা যাতে কেটে না যায় এরজন্যে তারা সতর্ক থাকেন। শিরা কাটলে তার হাত কর্মশক্তি হারাবে। যারা তার কর্মশক্তি ধরে রাখতে একটা শিরা কাটতে নারাজ, তারা হাত কাটবেন কেনো। আর আবুলতো কোন হার্টের রোগী না যে বিদেশে নিয়ে গেলেই ভালো করে নিয়ে আসা যাবে। আবুল যদি ঢাকা মেডিক্যালে আর চিকিৎসা করাতে না চায় তাহলে তারাও তাকে বেশিদিন রাখবেনা। সবাই মিলে তার কাউন্সিলিং করাতে হবে। চিকিৎসায় থাকলে সে ভালো থাকবে। চিকিৎসা না করলে গ্রামে ফিরে গিয়ে মরতে হবে ক্ষুধা আর যন্ত্রনায়।