গতানুগতিক সিস্টেমের কাছে বন্দী প্রজন্ম

গতানুগতিক সিস্টেমের কাছে বন্দী প্রজন্ম

মেহেদী কাউসার ফরাজী:ভারতবর্ষের মৌলিক সমস্যা শাসনতান্ত্রিক। শিক্ষিত, চতুর ও সচেতন ইংরেজরা একটি “টেকসই আমলাতান্ত্রিক” শাসনব্যবস্থা কার্যকর করে গিয়েছিলেন। এর কাঠামোটি এমনভাবে তৈরী হয়েছে যে, পুরো সিস্টেমটাই স্বৈরাচারী ও প্রবল দূর্নীতিগ্রস্থ। ভারতবর্ষের সম্পদ লুটপাটে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করাই ছিলো সেই সিস্টেমের কর্তব্য।

মূলতঃ সেই শক্তিশালী সিস্টেমের কারণে কোন কোন ইংরেজ অফিসার ভালভাবে কাজ করতে চাইলেও ব্যর্থ হতেন। আর ব্রিটিশ রাজকোষ তরতাজা রাখতে সেরা লুটেরাদেরই ভারত সরকারের দায়িত্বে প্রেরণ করা হতো।
শতবর্ষ আগেকার ভারতীয় তরুণরা প্রধানত সেই সিস্টেমের বিদ্রোহ করেছিলেন এবং প্রাণপণ বিপ্লব-সংগ্রামের মাধ্যমে ইংরেজ লুটেরাদের বিদায় করেছিলেন। কিন্তু, প্রধান সমস্যাটি কিন্তু উৎখাত হয়নি! ইংরেজদের ছেড়ে যাওয়া সিস্টেমের হালগুলো ধরেছিলেন যারা, তারা সেই সিস্টেম বাতিল তো করেইনি, বরং সেটিকে আরও বেশী কার্যকরী করেছেন।
যে কারণে আমরা জানতে পারি যেসব তরুণরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছেন, তারাই সাতচল্লিশের অব্যবহিত পরেই আবার ভারত ও পাকিস্তান সরকারের বিদ্রোহ করে বসলেন! তথাকথিত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী রাজনীতিবিদরা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের রাজনৈতিক কর্মী, ভারতের ক্ষেত্রেও তাই! কেন? ভেবেছেন কখনও?
একাত্তরের আগে স্বাধীন বাংলার আন্দোলনে প্রগতিশীল তরুণরা একজোট হয়ে লড়েছেন সেই পুরনো “সিস্টেম” এর বিরুদ্ধে। সেখানে পাপীস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছিলো খেলার পুতুল, কখনও বা অত্যোৎসাহী ক্রীড়নক -কিন্তু পূর্বতন স্বৈরাচারী সিস্টেমই ছিলো অঘোষিত নিয়ন্ত্রক।
মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেলো। বাঙালি তরুণরা প্রাণপণ যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরী করলো। অথচ, যুদ্ধ শেষে পাপীস্তান সেনাবাহিনী ও শাসকেরা চলে যাবার পরপরই কেন সেই মুক্তিযোদ্ধারাই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বিদ্রোহ করলো? ভেবেছেন কখনও? বঙ্গবন্ধু নিজেই যখন পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী হয়েও স্বাধীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, একাত্তর পরবর্তীতে তো সেই রাষ্ট্রটি তাঁর হাতেই ছিলো -কেন তিনি পারলেন না বিদ্রোহী তরুণদের শান্ত করতে? বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের রাজপথের বিরোধীদল জাসদ তো মুক্তিযোদ্ধা ছেলেরাই গড়েছিলো!
–উত্তর একটিই, সেই সিস্টেম। সিস্টেম বঙ্গবন্ধুকে তরুণদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে দেয়নি। এটা তিনি বুঝেছিলেন, ফলে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ছিলো সেই অপসিস্টেমের বিরুদ্ধে, যে বিপ্লব শুরুও করেছিলেন তিনি -কিন্তু শেষ করতে পারেননি পরমবন্ধু মোশতাকের জন্যই।
সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদ সিস্টেমের সাথে আপোষ করে চললেনই না শুধু, বরং দীর্ঘদিনের ঝড়-ঝাপটায় দুর্বল হয়ে পড়া অপসিস্টেমটির আধুনিকীকরণ ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলেছিলেন। জিয়া ব্যর্থ হলেও, সফল ছিলেন এরশাদ। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের নামে “আমলাতান্ত্রিক শৃঙ্খল” বড় বড় শহরগুলো থেকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়ে শতবর্ষী শাসনকাঠামো আরও মজবুত করে গিয়েছেন। ফলে, স্বাধীন বাংলাদেশের দীর্ঘতম সময় পর্যন্ত সরকার ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
পুরনো স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি তরুণরাই রাজপথে রুখে দাঁড়িয়েছেন। মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। তরুণদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে এরশাদের পতন ঘটিয়ে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেছেন।
একানব্বইয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পারলেন না সিস্টেম পরিবর্তন করতে। তরুণদের রক্তের সাথে বেঈমানী করে সিস্টেমের সাথে আপোষ করলেন তথাকথিত আপোষহীন নেত্রী। শতাব্দীর শেষলগ্নে তরুণদের আরেকদফা রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এলেন। তিনি এসেই পিতার অসমাপ্ত বিপ্লব বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই ঐতিহ্যবাহী শৃঙ্খলের সাথে পারলেন না। ২০০১ সালে সিস্টেমের কোলে চড়ে ক্ষমতায় আসলেন খালেদা জিয়া।
অপ্রাপ্তবয়স্ক এক যুবকের হাতে মাতৃস্নেহে বুঁদ হয়ে একটি গোটা রাষ্ট্রের মালিকানা তুলে দিলেন খালেদা জিয়া। বখে যাওয়া সন্তানের মতো মায়ের দেয়া খেলনাটিকে নিয়ে ভয়ঙ্কর ছেলেখেলায় মেতে উঠলেন তারেক রহমান, দলীয় লোকেরা ডাকে তারেক ভাইয়া। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ও দেশীয় সিস্টেমের সমন্বয় করে ভূখন্ডের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে শতাব্দীর সূচনা ঘটালেন সেই নাবালক খলনায়ক।
সুযোগ বুঝে হত্যা-প্রতিহত্যার লাল রঙে রাঙা মানচিত্রের মালিকানা নিলো সিস্টেমের দাস ফখরুদ্দীন। একজন পাকা ব্যাংকারের মতোই গোটা দেশটি নিয়ে ভয়াবহ ব্যবসা করে ফেললেন তিনি। প্রজন্মের অবরোধে বাধ্যগত নির্বাচন আয়োজন করে কিছুটা কাফফারা করলেন। ২০০৮ সালে আবার হাল ধরলেন শেখ হাসিনা।
সজীব ওয়াজেদ জয়ের উপদেশ মেনে ডিজিটাল বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। প্রজন্ম শান্ত হলো। এবার ভীষণ যুদ্ধ হবে, ভিশন বাস্তবায়নের। কিন্তু নাহ্! হলো না! কোথাও একটু সমস্যা রয়ে গেলো! কোন সমস্যা? -সেই সিস্টেম! শতবর্ষী সিস্টেম! রাজাকারের ফাঁসি না হয়ে জেলহাজত এলো! কী তাজ্জব! রুখে দাঁড়ালো প্রজন্ম, শাহবাগের ধাক্কায় শতাব্দীর প্রথম বিশুদ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো দেশের আনাচকানাচে!
তরুণদের এমন প্রকাশ্য ম্যান্ডেট পেয়ে গা ঝাড়া দিলেন শেখ হাসিনা। আর থেমে যাওয়া নয়, এবার সময় এগিয়ে যাওয়ার। দল থেকে সংসদ, গ্রাম থেকে শহর -শেখ হাসিনা শুরু করলেন পিতার অসমাপ্ত বিপ্লবের পুনর্বাস্তবায়ন। প্রজন্ম খুশী হলো। দেশ শান্ত হলো। কিন্তু কতটা?
প্রথমদিকে হকচকিয়ে উঠলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে সিস্টেম। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সিস্টেম। পাপীস্তানের লালিত সিস্টেম। স্বৈরাচারের পালিত সিস্টেম। দরিদ্রের রক্তচোষা সিস্টেম। ক্রমে একা হয়ে পড়লেন শেখ হাসিনা। ক্রমেই ভয়ঙ্কর একা হয়ে গিয়েছেন তিনি।
সিস্টেমের কবল থেকে মুক্তি নেই। সিস্টেমের আক্রমণ থেকে প্রজন্মের রেহাই নেই। সিস্টেমের সিস্টেমে দিশেহারা -তুমি, আমি এবং আমরা। সিস্টেমের কাছে জিম্মি গোটা দেশ। এই সিস্টেমের কারণেই স্বৈরাচার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় চিরশায়িত হয়। এই সিস্টেমের দাসত্ব করেই রাজনৈতিক নেতা হতে হয়। এই সিস্টেমের কাছে নতি স্বীকার করেই রাষ্ট্রের নাগরিক হতে হয়। এই সিস্টেমের কারণেই দেশজুড়ে অরাজকতা চালায় অপরাধীরা। এই সিস্টেমের কারণেই সবকিছু দেখেও চোখ বন্ধ রাখতে হয়, সিস্টেমই মুখে স্কচট্যাপ সেঁটে দেয়, সিস্টেমই কানে তোলা গুঁজে দেয়।
আমি শতাব্দীর তরুণ হিসেবে, প্রজন্মের দায়বদ্ধতা থেকে, ভবিষ্যতের দায়মুক্তির আশায় -এই পাপিষ্ঠ সিস্টেমের পতন চাই। তারুণ্যের জয় হোক। ❤