শক্তিশালী টাইফুনের থাবায় তছনছ জাপান! জাপানীরা ঘর গোছানোয় ব্যস্ত ! সিডিউলের রিসিডিউলিং নিয়ে ব্যস্ত জাতিটা । আমাদের মত বিদেশীরা চলমান স্রোতে গা ভাসানোর চেষ্টা করি! আমিও করি তবে স্বদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনায় চলমান স্রোত বিপরীতমুখী হয়! থমকে দাড়াই ভাবলেশহীন ভাবে। মানুষের সৃষ্ট কালবৈশাখীর তান্ডবে খেই হারিয়ে ফেলি আমি! তছনছ হয়ে যাওয়া একটা পরিবারের সদস্যের জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করি ! হাত পা শীতল হয় ! জানপ্রান দিয়ে দৌড়াই আমি । গন্তব্য অজানা ! হাফাতে হাফাতে উঠে পড়ি ঘুম থেকে । হাটুর ব্যাথাটা জানিয়ে দেয় দৌড়ানো হয়েছে অনেক।
দৌড়ানো শুরু করেছিলাম মনে হয় ভুমিষ্ট হবার পর পায়ে শক্তি হবার পর থেকেই। ভাই বোনদের সাথে খেলনার দখল নিয়ে যে দৌড় শুরু করি, সেই লাইফলং ম্যারাথনের ফিনিশিং ফিতা কোথায় জানা হয়নি এখনো ! বই খাতা হাতে নিয়ে স্কুলে যাবার দৌড় ! ফার্স্ট বেঞ্চে বসার মিনি দৌড় ! ফার্স্ট হবার কম্পিটিশনে বিভিন্ন রেঞ্জের দৌড় । গোল্ড মেডেল সবার গলায় জোটে না ! যে দু একজন ভাগ্যবান চ্যাম্পিয়ন হয় তারাই বিশ্ববিদ্যালয় নামক দ্বিতীয় দফা দৌড় কম্পিটিশনে রেজিস্ট্রেশন করে । আমিও করেছিলাম রেজিস্ট্রেশন। শখ ছিল ইন্জিনিয়ার হবার। আমার একটু থাকলেও পরিবারের অন্য সবারই একটু বেশিই ছিল । নিজের এইম ইন লাইফ রচনায় নিজেকে ডাক্তার বানানোর রচনা ঠোটস্থ করেছিলাম ভালভাবেই । রক্ত দেখে মাথা চক্কর দিয়ে জ্ঞান হারানো আমার যে ডাক্তার হবার ইচ্ছে ছিল না, সেটা আমি জানলেও বড় ভাইকে বোঝাতে পারিনি । বাবার স্বল্প আয়ের কিছু টাকার শ্রাদ্ধ করে দিয়েছিলাম ভর্তি পরীক্ষা । ফলাফল এজ এক্সপেকটেড! শুরু হয় ভিন্ন ট্র্যাকের স্টারটিং লাইনে দাড়ানো । দুর পাল্লার দৌড়ে কম্পিটিশন প্রচুর । ফিআমানিল্লাহ বলে শুরু করি দৌড় ! সামনে যে প্রতিবন্ধক হাজারো ছিল সেটার শুরুটা দেখি দৌড়ের শুরুতেই । যমুনা নদী পার হতে যেয়ে, যুমনার চড়ে ফেরি আটকে, জীবন থেকে ১২ ঘন্টা লসের হিসেব দিয়েই শুরু করি কম্পিটিশনে অংশগ্রহন। অন্য কম্পিটিটররা যখন ক্যালকুলাসের রিভিশনে ব্যস্ত, আমি তখন মাঝ নদীতে জীবনের ক্যালকুলাসের হিসেব করি । আবরার ভাল ছাত্র ছিল তাই চান্স পেয়েছে । আমি মিডেলক্লাস ছাত্র, বুয়েট আমাকে জায়গা দেয় নাই!
ভর্তি হয়েছিলাম প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে । অক্সফোর্ডে যে বাসস্থানের অভাব সেটা জানা ছিলনা । ভাগ্যিস গ্রামের এক দয়ালু ভাই জায়গা দিয়েছিলেন ওনার সরু বিছানায় ! হলের এরকম বাসিন্দাদের বলা হয় ভুয়া । আমি নিজেকে সান্তনা দিতে ভাষার মডিফিকেশন করে বলি ডাবলিং থাকি । যদিও শব্দটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ হওয়া আইনগুলোর আওতায় পরে ! তবে আমি সেই নিয়ম মাফিক আবেদনকারী ছিলাম না । আইনের ভাষায় যেটাকে বলে ইললিগ্যাল! জিয়া হল নামক সেই সদ্য বানানো হলটায় তখন ছাত্রদলের জয়জয়কার ! কিছু ছাত্র ইউনিয়ন, কিছু ছাত্রলীগ ও রাতের অন্ধকারে রাজনীতি করা কিছু ছাত্র শিবির ও থাকতো হলে । হল নিয়ন্ত্রনের চাবুক কিন্তু ছাত্রদলের হাতে । ওনারা বিনা পয়সায় কেন্টিনের নাস্তা খেয়ে চাক্ষুস ইললিগ্যাল কাজ করলেও, আমাদের ইললিগ্যাল অবস্থানে ওনাদের চোখ একটু বেশিই পরত । ইললিগ্যাল কাজের জরিমানা হিসেবে কোর্টে হাজিরা দিবার মত মিছিলে যাওয়া লাগত মাঝে মাঝেই! আমাদের সময় ওটাই ছিল টর্চার সেল । আব্বার কড়া নিষেধ ছিল রাজনীতির ধারে কাছেও যেন না যাই । আমারো মন সায় দিত না রাজনীতি করতে! তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিছিলে যাওয়াটাই ছিল আমার কাছে বড় ধরনের টর্চার। এখনকার দিনে টর্চার সেলের বিবরন শুনে নিজেকে ভাগ্যবানদের তালিকায় স্থান দেই!
জানতাম না তখন নিজ দলের মধ্যে গ্রুপিংয়ের কারন । অর্থ মেইন ছিল নাকি পদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেশী ছিল বুঝে উঠার ক্ষমতা তখনো হয়নি । এখন যখন দেখি দলনেতারা বহিস্কার হয় টেন্ডারবাজির কারনে, তখন পরিষ্কার হয় আগের সেই না বোঝা বিষয়গুলি ! অর্থই অনর্থের মূল মনে প্রানে বিশ্বাস করা নেতারা ওটার পিছনেই ছুটতো সর্বদাই । ভাগ বাটোয়ারায় হেরফের হলেই মিনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া দিত হলগুলিতে ।আমাদের নাকগুলো বারুদের গন্ধ নিত প্রানভরে। অভি ইলিয়াছের যুদ্ধ তখন আমেরিকা রাশিয়ার কোল্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারকেও হার মানিয়েছিল । আমরা পড়াচোরারা সেই যুদ্ধের কারনে হল ভ্যাকেন্টের ঘোষনাকে স্বাগত জানাতাম মনে প্রানে । হল ছাড়লেও ঢাকা ছাড়তাম না । বাক্স পেটরা নিয়ে হানা দিতাম বন্ধুদের মেসে না হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে । উদ্দেশ্য টিউশনি নামক পার্টটাইম জবটা রক্ষা করা!
ভুয়ার খাতা থেকে নাম কেটে নিজের বেড পেয়েছিলাম একখানা শহিদুল্লাহ হলে! কোর্টে হাজির দিবার পালা শেষ হলেও নেতা পাতি নেতাদের চোখ রাঙ্গানো তখনো থামেনি ! কমন রুমে সিট না ছেড়ে দেবার কারনে চড় থাপ্পড়ের হাত থেকে বাচিয়েছিল রিপন! টর্চার সেল না থাকলেও বাহির থেকে লোকজনদের ধরে এনে সালিশ বসতো নেতাদের রুমগুলিতে। সালিশের রায়ে অনেকে বেচে গেলেও পরপারের বাসিন্দা হতে হত অন্যরা! তবে আশার বিষয় ছিল সাধারন ছাত্রছাত্রীদের চড় থাপ্পর কিংবা ওড়না টানার মত ছোটখাট নির্যাতনের মধ্যেই সীমাবব্ধ ছিল। আর একটা ব্যাপার ছিল ওপেন সিক্রেট। কিছু কিছু ব্যাপারে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া লাগত। সেটার পরিসমাপ্তি ঘটত প্রতিপক্ষের রুম ভাংচুর করে। মজার ব্যপার ছিল এখানেই। মার মার কাট ভাব নিয়ে রুমগুলিতে গেলেও আমার জানামতে কাউকে মারধর করতে দেখিনি (ব্যতিক্রম ছিল)। করবে কিভাবে? আক্রমনের তথ্য আগেই পৌঁছে যেতে প্রতিপক্ষের কানে। তথ্য পাচার করার দায়িত্বে থাকত আক্রমনকারীদেরই একজন। কেননা প্রতিপক্ষের সেই ছেলেটি যে ছিল তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রাজনৈতিক কারনে শক্রর অবস্থানে থাকেলেও সিগারেটে মোথা শেয়ার করে সুখটান দিত প্রায়ই। ক্যম্পাসে সেই নেতারা নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেই প্রতিপক্ষের বন্ধুরাই দায়িত্ব নিত ফরম পুরনের। উত্তেজনা চরমে উঠলেও প্রানহানির সংখ্যা ছিল না বললেই চলে।
এরশাদ চাচা নিজের চামচা বানানোর টোপ ফেলেছিলেন তখন ক্যাম্পাসে । অনেকেই সেই টোপ গিলেও ছিল পয়সার লোভে। ফলে জীবন দিতে হয়েছিল রাজু ও মিজানদের ! পরবর্তীতে খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি এরশাদ বাহিনী!
মতাদর্শে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল ভিন্ন হলেও এরশাদ হটাও আন্দোলনে এক হয়ে যেত নিমিষেই । তাই অভিরা খুব একটা দখলদারি কায়েম করতে পারে নাই ক্যাম্পাসে । আমাদের সময় টর্চার বা প্রান নেয়ার ঘটনা যে ঘটতো না তা নয় । এখনকার মত সিভিয়ার না হলেও ছিল । তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির কারনে এখনকার দিনের ঘটনাগুলো যত দ্রুত ছড়িয়ে পরে আমাদের সময় ততটা ছড়িয়ে পরতো না। ক্যাম্পাসের গন্ডি পেরিয়ে বের হতে হতেই সেটার রেশ কেটে যেত । আবরারদের ঘাতক তৈরির কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর তাই অনেক আগেই স্থাপন করা হয়েছিল বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে । সেই সময় কারখানাগুলোতে মেসেজ আসতো পতাকা উড়ানো গাড়িতে, এখন আসে ওয়াই ফাইয়ের ডানায় ভর করে!
ছাত্রদের বখে যাবার কারন নিজেরা পুরাপুরি নয়। বয়সটাই রঙ্গিন ডানায় উড়ার সময় । সেটাতে ইন্ধন যোগায় বড় বড় দলের বড় বড় নেতারা ! নেতাদের মনোবাসনাকে চরিতার্থ করতে লেলিয়ে দেয়া হত ছাত্র নামধারী কিছু বখে যাওয়া ছাত্রকে । সময়ের খাতিরে সেটা ব্যক্তি কেন্দ্রিক থেকে দল কেন্দ্রিকে রুপ নিয়েছে । দলকে খুশি করে নিজেদের পজিশন কায়েম করতে এখন দরকার লাশের ! তাইতো আবরারদের বলির পাঠা হতে হয় এখনকার দিনের তথাকথিত ছাত্র রাজনীতিতে…