ফজলুল বারী:ব্রাহ্মনবাড়িয়ার মন্দভাগে ট্রেন দূর্ঘটনা ঘটলো। এরপর দূর্ঘটনার কারন নিয়ে যে গল্পগুলো বেরুলো তাতে স্পষ্ট বাংলাদেশে রেলওয়ের অগ্রগতির অবস্থা সেই তিমিরেই। অথচ দুনিয়া জুড়ে ট্রেন মানে বিশেষ কিছু। কত রকমের ট্রেন এখন দেশে দেশে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সিগনাল ব্যবস্থা ডিজিটাল করা হয়েছে। কিন্তু রেল চলছে সেই এনালগ লোকজন দিয়েই। একটা খবর বেরিয়েছে অটো ব্রেকে ইট রেখে ঘুমাচ্ছিলেন তূর্ণা নিশিথা ট্রেনের চালক এবং তার সহকারী! অতঃপর পরপর তিনটি সিগনাল অমান্য করে তূর্ণা নিশিথা ট্রেন গিয়ে সজোরে উদয়ন এক্সপ্রেসকে ধাক্কা মারলে ঘটেছে দূর্ঘটনা। রেলের লোকজনের গাফিলতির এই দূর্ঘটনায় প্রান গেল ১৬ জনের। আহত শতাধিক। এরমাঝে কয়েকজন সারাজীবনের জন্যে পঙ্গু হয়ে যাবেন। মন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে বললেন যারা মরেছে তাদের জন্যে লাখ করে টাকা দেবো! আহতদের জন্য ১০ হাজার! কী প্রহসন! মানুষের জীবনের মূল্য কত এখন বাংলাদেশে? রেলওয়েরও কী যাত্রী জীবনবীমা করা নেই? একজন লোক আহত হলে চিকিৎসা বাদে পরিবারের লোকজন কত খরচে পড়ে? রেলমন্ত্রী বা তার পরিবারের লোকজনের কী কখনো চিকিৎসা নিতে হয়নি? না বিদেশে চিকিৎসা নেন বলে তিনিও দেশের চিকিৎসা ব্যয় জানেননা! যারা মরেছেন তারা অবশ্য শুধু এক লাখ না, আরও পঁচিশ হাজার টাকা করে পেয়েছেন! লাশ দাফনের জন্যে জেলা প্রশাসক বরাদ্দ দিয়েছেন লাশ প্রতি পঁচিশ হাজার টাকা! এ টাকা বাংলাদেশে সড়ক দূর্ঘটনা অথবা অপমৃত্যুর ঘটনায় দেয়া হয়।
অথচ এই রেল কত মেধা আর স্বপ্ন নিয়ে এক সময় ব্রিটিশ আমলের বাংলাদেশ তল্লাটে যাত্রা শুরু করেছিল। বলা হতো ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের সম্পদ পাচার আর বিদ্রোহ দমনের নিয়তে রেল গড়েছিল। কিন্তু এর পেশাদারিত্বেতো কখনো কোন ঘাটতি ছিলোনা। রেল উঠে এসেছিল সাহিত্যে। ‘রেলগাড়ি ঝমঝম বৃষ্টি, গ্রাম থেকে এলো ইষ্টি’ এমন কত কবিতা-ছড়া রেলকে ঘিরে। আমজাদ হোসেনের ‘দ্রোপদী এখন ট্রেনে’ থেকে কালজয়ী ‘গোলাপী এখন ট্রেনের উপজীব্যও রেল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেঘালয় থেকে সিলেটে আসবেন। জাফলং এর ওপার থেকে আসবেন সিলেটে। তখন তাঁর মতো বনেদি লোকজন মানুষের ঘাড়ে চড়ে পাহাড়ি ঝর্না পেরিয়ে এদিকে আসতেন। কিন্তু মানবিক কবি এভাবে অমানবিক কায়দায় মানুষের ঘাড়ে চড়তে রাজি হলেননা। অতঃপর কবি চড়লেন ট্রেনে। করিমগঞ্জ-কুলাউড়া হয়ে কবি পৌঁছেন সিলেটে। সেই কুলাউড়া-লাতু (উত্তর শাহবাজপুর) হয়ে ট্রেনে ভারতে যাবার পথটি দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ট্রেনে করে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
সেই ট্রেন লাইনটির মতো রেলওয়ের আরও অনেক লাইন অলাভজনক বিবেচনায় গত বিএনপি আমলে বন্ধ করে দেয়া হয়! বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে ট্রেন সার্ভিস অলাভজনক হয় কী করে? পৃথিবীর সব বিমান সংস্থার কাছে বাংলাদেশে ফ্লাইট চালনা লাভজনক। ঢাকায় ছোট ছোট অফিসে চালিয়ে ২৫-৩০ জন স্টাফ নিয়ে বছরের পর বছর লাভ করে চলেছে। আর ‘আকাশে শান্তির নীড়’, ‘ছোট হয়ে আসছে’ শ্লোগান দিয়ে জন্ম থেকে অলাভজনক বাংলাদেশ বিমান! বিমানের কথা আরেক লেখায় বলা যাবে। এ লেখায় শুধু রেলের সালতামামি আলোচনা করি। পাশের দেশ ভারতে রেল লাভজনক। বাংলাদেশে অলাভজনক! এর পিছনে রাজনীতি, অর্থনৈতিক চক্রান্ত আছে। চক্রান্তকারীরা রেলকে বসিয়ে দিয়ে নিজেদের পরিবহনের ব্যবসার পসার ঘটিয়েছে। এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন দাতা সংস্থাও।
বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর কথা মনে করতে পারেন। দাতা সংস্থা প্রথম দিকে ওই সেতুতে রেল সেতুর সংযুক্তিতে আপত্তি জানিয়েছে। কারন ট্রেনের বগিতো প্রতিদিন বিক্রি করা যায় না। বাস-ট্রাক এসব প্রতিদিন বিক্রি করা যায়। বাংলাদেশের অসাধু-দূর্বল নেতৃত্ব নানাকিছুতে দাতা সংস্থার শর্ত মানতে গিয়ে স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ীদের চক্রান্তে দিনে দিনে রেলকে পরিণত করেছে বিকলাঙ্গ সংস্থায়। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে রেলের ভিতরের দুর্নীতি। ট্রেনের সুন্দর সুন্দর কাব্যিক নাম হয়েছে। কিন্তু রেল দেশের মানুষের হয়নি। এটি দিনে দিনে অপেশাদারিত্বের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের আখড়া হয়েছে। গত পঞ্চাশ বছরে যতজন রেলমন্ত্রী-সচিব হয়েছেন, যত লোক রেলওয়েতে চাকুরি করেছে তাদের নিয়োগ থেকে শুরু করে আয়-ব্যয় আর অর্জিত সম্পদের ময়না তদন্ত করে দেখুন। ১০০ জনের এক-দু’জন পাবেন যারা সৎ জীবন-যাপন করেছেন। বাকিগুলো সব চোর-ডাকাত।
অথচ রেল নিয়ে যাত্রীদের প্রথম অভিযোগ টিকেট কাউন্টারে পাওয়া যায়না। পাওয়া যায় কালোবাজারে। টিকেট কেটে একজন যাত্রী তার আসনে নিরাপদে গন্তব্যে যেতে পারবেন এর কোন গ্যারান্টি নেই। অথচ পাশের দেশ ভারতেও এ সার্ভিসগুলো তুলনামূলক কম দুর্নীতিগ্রস্ত। ঈদের সময়গুলোতে ট্রেনের একটি টিকেট হয় সোনার হরিন। টিকেট না পেয়ে হাজার হাজার মানুষ ট্রেনের ছাদে চড়ে যাতায়াত করে। অথচ রেল অলাভজনক! ভারতে একজন বিদেশি পর্যটক রেলের কাউন্টারে পাসপোর্ট দেখিয়ে ফরেনার্স কোটায় টিকেট পান। বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত এ ব্যবস্থার কথাও ভাবেনি! নিজের দেশের লোকজনের বৈধভাবে টিকেট কাটার গ্যারান্টি নেই। আবার ফরেনার্স কোটা কোটা!
বাংলাদেশের কোন সার্ভিস নিয়ে কথা বলার বিপদও অনেক। চট করে বলে দেবে লোকবল সংকট! কিভাবে বলি বিদেশে আমাদের লোকাল স্টেশনগুলোয় একজন মাত্র স্টাফ। ইনিই টিকেট বিক্রি করেন। ইনিই স্টেশন ঝাড়ু দেন। আজকাল এসব দেশে বাসে-ট্রেনে-ফেরিতে যাতায়াতে কার্ড ব্যবস্থা গড়ে ওঠাতে স্টেশনের কাউন্টার থেকে টিকেট বিক্রির চলও উঠে গেছে। এসব কার্ড স্টেশন লাগোয়া কোন দোকান বা যে কোন পত্রিকা বিক্রির দোকানেই পাওয়া যায়। স্টেশনের বুথ বা সেই দোকানগুলোতেই মোবাইল ফোনের মতো সেই সব কার্ডও রিচার্জ করা যায়। টিকেট বিক্রি হয় মূলত দূর পাল্লার ট্রেনের বুথে। অনলাইনেও টিকেট কেনা যায়। আমাদের যে সব স্টেশনে একজন মাত্র স্টাফ, ঠিক বাংলাদেশে এমন একটি স্টেশনে কমপক্ষে তিরিশ-চল্লিশজন স্টাফ! এরপরও স্টেশনগুলো নোংরা-অস্বাস্থ্যকর! ক্ষেত্র বিশেষে এদের সবাই মিলে দুর্নীতি করেন! যাত্রীদের জিম্মি করেন! দুনিয়া জুড়ে এখন যেখানে কম লোকবলে বেশি কাজ করানোর রেওয়াজ, বাংলাদেশেও যেখানে হাতের মোবাইল ফোনেই ব্যাংকিং থেকে শুরু করে নানাকিছু করা সম্ভব সেখানে অথর্ব বেশি লোকবলের আওয়াজ বন্ধ করতে হবে। সবকিছু করতে হবে রেলের আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।
এরশাদ আমলের একটা ঘটনা বলি। এরশাদ ভোলায় গেছেন নাজিউর রহমানের সঙ্গে। তখনকার যুগের বাসে চালকের আসনের পাশে তার সহকারীর বসার ব্যবস্থা ছিল। বাসের সামনের আসনে পাশাপাশি দু’জন বসা দেখে এরশাদ মজা করে নাজিউর রহমানকে জিজ্ঞেস করেন, এখানে বাস দু’জন চালায় নাকি! তূর্ণা নিশিধা ট্রেনেও দেখা গেলো চালক এবং তার সহকারী দু’জন বসা ছিলেন ইঞ্জিনে। এবং ব্রেকে ইট রেখে তারা দু’জন মিলে ঘুমাচ্ছিলেন! বাংলাদেশের রেল বাঁচাতে এসব অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে এর পুরো খোলনলচে বদলাতে হবে। আজ পর্যন্ত একজন রেলমন্ত্রী পাওয়া গেলোনা যারা রেলওয়ের সালতামামি বোঝেন!
ক্রিকেটে যেম বিদেশ থেকে কোচ আনেন, বিমান-পাঁচতারকা হোটেল পরিচালনায় যেভাবে বিদেশ থেকে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা হায়ার করে আনা হয়, প্রয়োজনে রেলওয়েকে পরিচালনার খোলনলচে পাল্টাতেও এমন উদ্যোগ নিন। অযোগ্য সনাতন চিন্তার লোকজন সব ছাটাই করুন। আধুনিক নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সেখানে রিক্রুট করুন। রেল বদলে যাবে। এখন যারা আছেন তাদের সিংহভাগ রেলকে বেচে দুর্নীতি ভালো বোঝেন। রেলকে লাভজনক করা, আধুনিক-গতিশীল করা এদের পক্ষে সম্ভব না।
গত কয়েক বছরে ভারতের সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ চালু সহ রেলের নানান উন্নতি যোগ ঘটেছে। কুলাউড়া-শাহবাজপুর-করিমগঞ্জ লাইন সহ বন্ধ করে দেয়া অনেক লাইন পুনঃনির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এমন সব নতুন নতুন লাইন চালু হলে ভারতের সঙ্গে যাত্রী এবং মালবাহী ট্রেন বাড়ালে রেলের আয় আরও বাড়বে। পদ্মা সেতু চালু হলেও বেড়ে যাবে রেলের নতুন সম্ভাবনা। সবচেয়ে বড় সত্য হলো যে দেশ এত জনবহুল, যে দেশের সিংহভাগ মানুষ এখনও সড়কপথের চেয়ে ট্রেন ভ্রমনকে তুলনামূলক নিরাপদ মনে করেন সেদেশে রেল কেনো লোকসানী প্রতিষ্ঠান-শ্বেতহস্তী হবে? এরজন্যেই দরকার রেল ব্যবস্থার আমূল সংস্কার। মানুষের আস্থার অমর্যাদা করবেননা। দূর্ঘটনা ঘটলো আপনাদের দোষে। দূর্ঘটনার ক্ষত সারাতে নতুন বগি কিনতে শতশত কোটি টাকার টেন্ডারবাজি করবেন, আর মানুষের জীবনের মূল্য ঠিক করলেন এক লাখ টাকা! আহতের চিকিৎসার জন্যে দিলেন ১০ হাজার টাকা! এসব কী সদকা-জাকাতের টাকা দিলেন? মানুষের সঙ্গে ফাতরামো বন্ধ করেন। রেলকে আরও দ্রুতগতির-নিরাপদ করতে রেললাইনের দু’পাশে কাঁটাতারের বেড়া দিন। রেল ক্রসিংগুলোর নীচ অথবা উপর দিয়ে পথ করুন অন্য যানবাহন চলাচলের। রেলের পিছনে যত খরচ করবেন তত মানুষের আস্থা বাড়বে। যত আস্থা বাড়বে তত লাভজনক হবে রেল। আবার বলছি চলতি পুরনো পচা-গলা-দুর্নীতিবাজ নেতৃত্বৃ দিয়ে রেল লাভজনক হবেনা। নতুন প্রজন্মের স্মার্ট লোকবল আনুন। নতুন প্রজন্মের সিংহভাগ কম দুর্নীতিবাজ।