ফজলুল বারী:কল্পনার বাইরের একটি পরিস্থিতি। হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব স্বরস্বতী পুজার দিন ঢাকা সিটি নির্বাচন করার প্রশ্নে গো ধরেছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন! এটি সেই বাংলাদেশ, সব ধর্মের মানুষকে সমান চোখে দেবার প্রতিশ্রুতিতে এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। বাংলাদেশ অবশ্য সে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গিয়েছে অনেক আগে। এই মূহুর্তে সেটিই যেন সবাইকে আবার সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের চলতি মুসলমান নির্বাচন কমিশন! এ ব্যাপারে হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের অনুরোধকে আমল-পাত্তা তারা দেয়নি! উল্টো কমিশনের সচিব ঔদ্ধত্ব্যের ফতোয়া দিয়ে বলেছেন পুজা-ভোট দুটোই একসঙ্গে করা যায়! দুটিই পবিত্র! সবচেয়ে হতাশার বিষয় উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে দায়েরকৃত একটি রিট খারিজ করে দিয়েছে!
অথচ ক্ষমতায় ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির বানী বর্ষনকারী দল আওয়ামী লীগ। যে দলটিকে এখনও দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদের আশ্রয় হিসাবে ভাবে। আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচনী প্রচারে আছেন। কিন্তু পুজার দিন ভোট নিয়ে তারা চুপ! আর বিএনপিতো হিন্দুদের এসব পুজা-বেদায়াতির বিপক্ষের সাচ্চা মুসলমান দল! ডাকসু-ছাত্রলীগ পুজার দিন নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এ ব্যাপারে কী আওয়ামী লীগের কোন সংকেত আছে? সংকেত যদি না থাকে তাহলে এসব ডাকসু-ছাত্রলীগ কতক্ষন শাহবাগে থাকবে তা বলা মুশকিল। ডাকসুর এই ভূমিকার সঙ্গে আবার নুরু ভিপি নেই। সম্ভবত মান্না সাহেবরা এখনও কোন ওহী পাঠাননি!
মুসলমান নির্বাচন কমিশন বলেছে স্বরস্বতী পুজার সরকারি ছুটির পঞ্জি দেখে তারা ঢাকার সিটি নির্বাচনের তারিখ ঠিক করেছে। সেই পঞ্জিতে ২৯ জানুয়ারি পুজা হবার কথা। এ যেন এক হাফ অন্ধ হাফ বধির নির্বাচন কমিশনের আত্মপক্ষের সাফাই! ঈদ যেমন চাঁদ দেখে হয় পুজা হয় তিথি দেখে। এখন যদি ঈদ-মহররম-এজতেমার বিষয় থাকতো তাহলে কি এমন গাড়লের মতো বলতো আর জেদাজেদি দেখাতো নির্বাচন কমিশন? অথবা প্রধানমন্ত্রী যদি একটা হাক দিতেন! এর মাঝে কাপড় চোপড় নষ্ট হয়ে যেতোনা! নির্বাচন কমিশনের মুসলমান নেতৃত্ব-কর্তৃ্ত্বের মনের মধ্যে পুজা নিয়ে কোন আবেগ নাই জানি, কিন্তু সুবোধ কাপড়চোপড় পরা লোকজনকে দেখতে ভদ্রলোকের মতো দেখালেও এরা যে আসলে অভদ্র ছোটলোক কিসিমের মুসলমান সাম্প্রদায়িক তা এরমাঝে সবাইকে জানিয়ে-বুঝিয়ে দিয়েছেন। এরমাঝে এই অভদ্র সাম্প্রদায়িক লোকগুলো যুক্তি হিসাবে বলার চেষ্টা করেছে দূর্গা পুজার সময় রংপুর সিটি কর্পোরেশনের হয়েছে! কাজেই স্বরস্বতী পুজা করতে কোন সমস্যা হবেনা! এই সাম্প্রদায়িক নির্বাচন কমিশনকে কে বুঝাবে স্বরস্বতী পুজা হয় একদিনে। এবং সেটি পড়েছে তিরিশ জানুয়ারি।
সবচেয়ে বিব্রতকর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাহলো ঢাকার যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সিটি নির্বাচনের ভোট কেন্দ্র হবে সেগুলো পুজা আয়োজনের অনুমতি দেয়া হচ্ছেনা। নিরাপত্তার কারনে আগেভাগে এসব স্কুলের নিয়ন্ত্রন নেয় নির্বাচন কমিশন। সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাত্র শিক্ষক, তাদের অভিভাবকদের কতো যে আবেগ এই স্বরস্বতী পুজা নিয়ে তা এই মুসলমান সাম্প্রদায়িক নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের তা অবশ্য ধারনা করা কঠিন। কিন্তু তারাওতো নানা সুযোগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বক্তৃতা দেন। স্বরস্বতী পুজার দিন নির্বাচন করার জেদাজেদিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা পায় কী?
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদে যারা যোগ দিয়েছেন তাদের সবাই অবশ্য সনাতন ধর্মাবলম্বী নন। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছি অনেক তরুনের প্রতিবাদ। এটাই আমাদের প্রত্যাশার বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। আবার আরেক টিভিতে ঢাকার কিছু পথচারীর মতামত নিতে গেলে তারা যা বলেছেন এটা যেন অচেনা বাংলাদেশ! এরা বলছিলেন, এটা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। ৯৫ ভাগ মুসলমান। ৫ ভাগ হিন্দুদের পুজার জন্যে ভোট পেছানো অত জরুরি কিছু নয়। নির্বাচন কমিশন কী এই পক্ষের?
অথচ আমাদের শৈশবের বাংলাদেশটাও এ রকম ছিলোনা। ধর্ম যার যার উৎসব সবার এটাই ছিল আমাদের শৈশবের বাংলাদেশ। তখন ভোটও সত্যিকারের উৎসব ছিল। এখন ভোটক্ষেত্রে খা খা ঘুঘু চরে! নির্বাচন কমিশন প্রায় বলে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আনার দায়িত্ব তাদের না। এবার পুজার দিনে ভোট করার গো জিদ কী নির্বাচন কমিশনের সে রকম আরেক শপথ? এবার কোন হিন্দু ভোটার ভোট দিতে না আসুক! ভোট হবে শুধু মুসলমানের ভোটে! এমনিতে এখন ভোটক দিতে মানুষ আসছেনা। ভোটার কমানোর আরেক উদ্যোগ কার স্বার্থে? এই নির্বাচন কমিশনকে ধরতে হবে, সাম্প্রদায়িক স্বেচ্ছাচারী ভূমিকার জন্যে তাদের জবাবদিহি হবেই হবে। দিন পাল্টায়।