শেখ হাসিনার পরে কে 

শেখ হাসিনার পরে কে 

ফজলুল বারী :আওয়ামী লীগের সিংহ ভাগ নেতাকর্মীর কাছে এ মূহুর্তে এ প্রশ্নটি অসহ্য মনে হতে পারে। এবং এটি যথার্থই যে এই মূহুর্তে আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু শেখ হাসিনাওতো রক্তেমাংসের মানুষ এবং তিনি  বুদ্ধিমতি বলেই মাঝে মাঝে তাঁর বিকল্প খুঁজে নিতে বলেন। তাঁর আকাংখা  জানিয়ে বলেন অবসরের পর তিনি  টুঙ্গিপাড়া চলে যাবেন। সেখানে বসে আওয়ামী লীগের ডাটাবেজে ক্লিক করে জেনে নেবেন দলের নানা তথ্য। শেখ হাসিনার এই বক্তব্যে মনে হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরে গেলেও তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকতে চান। আসল সত্য বা তথ্যটা কী সেটা জানেন শুধু শেখ হাসিনাই। কারন প্রকৃতপক্ষে এই মূহুর্তে দেশে শেখ হাসিনাই একমাত্র ফুল টাইমার রাজনীতিবিদ। তার দলের বা প্রতিপক্ষ দলের ছোটবড় নেতাকর্মী সবার রুটি-রুজির সংগ্রাম সহ নানান ধান্ধা আছে। কিন্তু দেশ পরিচালনা আর আওয়ামী লীগ দেখা ছাড়া তাঁর আর কোন ধান্ধা নেই। কিছুদিন আগে বিমানের একটি অনুষ্ঠানে সে কথাটি তিনি নিজেই বলে দিয়েছেন।  

সেই অনুষ্ঠানে দলের মন্ত্রী-এমপিদের সতর্ক করে তিনি বলেন, বিদেশে গেলে সবাই যেমন সব নিয়মকানুন মেনে চলেন দেশে বিমানের ক্ষেত্রেও যেন সেটি মেনে চলা হয়। নতুবা আমার যেহেতু অন্য কাজ নেই তাই সব খবর যেমন আমার কাছে চলে আসে, তেমন খবর পেলেই তার বিমানে ওঠা বন্ধ করে দেবো। আবার মাঝে মাঝে যখন কথা ওঠে শেখ হাসিনাই কেনো সবকিছু করবেন। প্রধানমন্ত্রীর যদি সবকিছু করতে হয় তাহলে মন্ত্রিসভার আর সদস্যদের কাজ কী। যেমন বিমান ছিনতাইর ঘটনার পর টেলিভিশনে বিমান প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য বিরক্তিকর মনে হচ্ছিল। বিমান প্রতিমন্ত্রী বলছিলেন, বিমান ছিনতাই হয়েছে শুনে আমি গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টেলিভিশনের সামনে বসে নানান নির্দেশ দিচ্ছেন আর চমৎকারভাবে সামাল দিচ্ছেন সব পরিস্থিতি। এ নিয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্য হলো সবকিছু তাঁকে করতে কেউ বলেনা। তিনি নিজে নিজেই এসব করেন। যতক্ষন জেগে থাকেন ততক্ষনই কাজের মধ্যে থাকেন। আর তিনি কাউকে কিছু বললে যেহেতু দ্রুত কাজ হয় সে জন্যেই এসব করেন। এরপর কী এ নিয়ে প্রশ্ন করা সাজে? আপনি পছন্দ করেন আর না করেন দেশ আর দল পরিচালনায় শেখ হাসিনা নিজস্ব একটি স্টাইল গড়ে নিয়েছেন। এরজন্যে তিনি এত সচল-চলমান এবং তাঁর জায়গায় তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। 

অথচ শেখ হাসিনাকে যখন আওয়ামী লীগের প্রধান করে রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয় তখন অনেকের ভিন্ন চিন্তা ছিল। তখন যারা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করে দেশে আনার উদ্যোগ নেন তাদের একজন ছিলেন ডক্টর কামাল হোসেন। আব্দুল মালেক উকিল সহ অন্য নেতাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের মুখে ডক্টর কামালদের ধারনা ছিল শেখ হাসিনা যেহেতু রাজনীতিতে নবীশ তাই তাঁর ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করা যাবে। আওয়ামী লীগের বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের একাধিক সদস্য তখন শেখ হাসিনাকে দলের নেতৃত্বে নিয়ে আসার বিরোধিতাও করেন। দেশে ফিরে সবাইকে সামলে দলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে বেশ হিমশিম খেতে হয়। কারন বিবদমান নেতাদের অনেককে আগে তিনি চাচা ডাকতেন। শেখ হাসিনাকে ছোটবড় সব নেতাদের কমন সম্বোধন শুরু হয় সভানেত্রী। কিন্তু এই সভানেত্রী সম্বোধনে শুরুতে জিল্লুর রহমান, মোহাম্মদ হানিফের মতো অন্যরা কতোটা আন্তরিক ছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।  

সবকিছু দেখেশুনে নিজের মতো করে দল পরিচালনার উদ্যোগ নেন শেখ হাসিনা। তখনো তিনি ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বার রোডের বাড়িতে থাকতেন। এ বাড়ি ভিত্তিক একদল সর্বক্ষনিক তরুন কর্মীদের নিয়ে গড়ে ওঠে দল এবং অঙ্গ সংগঠন সমূহ পরিচালনার নিজস্ব এক নেটওয়ার্ক। বলতে গেলে সবকিছু তাঁকে তাঁর মতো করে শুরু করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর নেতৃত্ব-কর্তৃ্ত্ব মানতে অনিচ্ছুক ডক্টর কামাল হোসেন, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক একে একে দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে পৃথক দল করেন। ডক্টর কামাল হোসেন গড়েন গণফোরাম, মিজানুর রহমান চৌধুরীর আওয়ামী লীগ (মিজান), আব্দুর রাজ্জাকের বাকশাল। এরশাদের সঙ্গে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীও হন মিজানুর রহমান চৌধুরী। তবে মৃত্যুর আগে তিনি আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। আব্দুর রাজ্জাক তাঁর বাকশাল নিয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জোটে ছিলেন। পরে বাকশাল বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। এভাবে নানান চড়াই উতরাই পেরিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার একুশ বছর ১৯৯৬ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। সেই ঐক্যমত্যের সরকারে আ স ম আব্দুর রব, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও মন্ত্রী ছিলেন। 

 ২০০১ সালের নির্বাচনে সবাই মিলে আবার আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেয়। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২০০৬ সালের ১/১১ এর সরকার শেখ হাসিনাকেও গ্রেফতার করে সংসদ ভবন এলাকার বিশেষ সাবজেলে বন্দী করে রাখে। আবার ধারনা সেই বন্দী জীবনে পূর্ববর্তি নানান ভুলক্রটি শুধরে নতুন আরেকটা শুরুর জন্যে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেছেন শেখ হাসিনা। চিকিৎসার জন্যে তিনি যখন আমেরিকায় যান,  ওই সময়েও তাঁর বিস্তর হোমওয়ার্ক-গ্রাউন্ডওয়ার্ক করার সুযোগ হয়েছে। সেই নির্বাচনে ভূমিধবস বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় ফেরার পর শক্তহাতে শাসনদন্ড পরিচালনা সহজ হয়। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায়।  

নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও দল ধারাবাহিক ক্ষমতায় থাকায় শেখ হাসিনার মতো নিরলস পরিশ্রমী একজন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃ্ত্বে থাকায় বাংলাদেশের নানাক্ষেত্রে অগ্রগতি এখন জাতীয়-আন্তর্জাতিক সকল সূচকে স্বীকৃত সত্য। এ নিয়ে আমি একটা কথা প্রায় বলি ও লিখি তাহলো এই যে আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় এর পুরো কৃ্তিত্ব শেখ হাসিনার। নেতাকর্মীদের অনেকে এর সুযোগে নানান চুরিচামারি করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। সরকার সমর্থক সাংবাদিক-সম্পাদক থেকে শুরু করে নানান পেশার নেতৃত্বের লোকেরাও বনেছেন টাকার কুমির। শুধু শেখ হাসিনার সম্পদ বাড়েনি। দলীয় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু হয়েছিল তাও এরমাঝে বন্ধ হয়ে গেছে। এবার আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে এমন কিছু লোকের প্রমোশন হয়েছে তাতে এই অভিযান আর আশানুরূপ হবে মনে হয়না। আমার ধারনা অসত্য হোক। 

শেখ হাসিনার বিকল্প নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম। বিকল্প যে বঙ্গবন্ধু পরিবার থেকেই আসবেন তা বলতে জ্যোতিষ হবার দরকার নেই। কিন্তু শেখ হাসিনা যে নেতৃত্বের মাত্রা সৃষ্টি করেছেন তাঁর মাপের বিকল্প পাওয়া কঠিন। আমি সব সময় তাঁর কথাবার্তা, বডিল্যাঙ্গুয়েজ খেয়াল করি। যিনি নিজে দুর্নীতির উর্ধে থাকেন তার বডিল্যাঙ্গুয়েজই এমন হয়। দেশের নানা প্রান্তের লোকজন বলে দেবে আওয়ামী লীগের অমুক চোর অমুক ডাকাত, কিন্তু শেখ হাসিনা চোর এটা কেউ বলতে পারবেনা। দলের দেশের নানা সংকটে-জটিল সময়ে তিনি যে সাহসী বক্তব্য দেন, এরপর থেকে সে পথেই সবকিছু চলতে থাকে। এটাই নেতৃত্বের গুন-দৃঢ়তা।  

কিন্তু তাঁর বয়সও যে ৭৩ হয়েছে। যেহেতু জীবন নিয়ে তাঁর নিজস্ব একটি রুটিন আছে, তাঁর মাঝে একজন শিশুসুলভ চপল হাসু বাস করেন, সে কারনে এই বয়সেও তিনি এতোটা গতিশীল। কিন্তু এরপরও মাঝে মাঝে তাকে ক্লান্ত দেখায়। বয়স যে ৭৩। শেখ হাসিনার পর কী শেখ রেহানা? বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবিত ওপর সদস্যা হিসাবে তাঁরও অধিকার আছে। একপক্ষ এ নিয়ে পারিবারিক সংকটের গল্পও ছড়ায়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর ক্ষণগননার অনুষ্ঠানে শেখ রেহানার পাশাপাশি মঞ্চে মুজিবকোট পরিহিত সজিব ওয়াজেদ জয়ও ছিলেন। তাঁকে শ্লোগান দিতে বলায় অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে তিনি মায়ের সঙ্গে কন্ঠও মিলিয়েছেন। এখানে কোন বার্তা আছে শেখ হাসিনার? একপক্ষ বলে একটা দেশ নাকি জয়ের বদলে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে চায়। সবই হাওয়াই কথাবার্তা। কোন প্রমান নেই। তবে আসল সত্য শেখ হাসিনার বিকল্প কেউ হবেন কিনা বা কে হবেন এটাও কিন্তু ঠিক করবেন শেখ হাসিনা। এর আগ পর্যন্ত আমরা আদার ব্যাপারিরা জাহাজের খবর নিতেই থাকবো। আরও দীর্ঘদিন সুস্থ-সক্রিয় থাকুন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  

ফজলুল বারী
fazlulbari2014@gmail.com