বাংলাদেশের ভোটের রিপোর্ট পড়তে ভয়ও করে

বাংলাদেশের ভোটের রিপোর্ট পড়তে ভয়ও করে

ফজলুল বারী: ঢাকা সিটি নির্বাচনের খবর দেখতে একসঙ্গে তিনটা নিউজ চ্যানেলের লাইভ প্রতিবেদনকে মাধ্যম করেছিলাম। অনলাইনে কয়েকটি নিউজ পোর্টালের পাতায় ঢু মারছিলাম ঘনঘন। বিদেশে আমাদের দেহটা থাকলেও মনটাতো পড়ে থাকে বাংলাদেশে। আর এখনকার অনলাইনের যুগে আমরা সবাইতো এক গ্লোবাল পৃথিবীর বাসিন্দা। কোন তথ্যই এখন আর লুকোছাপার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে ভোটে এখন ভোটকেন্দ্রগুলো ভোটার খরায় খা খা করে। অথচ একদিন বলা হতো, ভোট বাংলাদেশের একটি উৎসবের নাম। এবার নির্বাচনী প্রচারনা তুমুল জমকালো হওয়াতে আশা ছিল ভোটাররা আসবেন। কিন্তু ‘আশায় আশায় দিন যে গেলো আশা পূরন হলোনা’! কেনো ভোটার এখন আর ভোট দিতে আসছেনা?  এটি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ভাবতে হবে। পরষ্পরকে দুষদুষি না করে প্লিজ বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস হোন। নইলে কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্রের খবর আছে।

আমাদের শৈশবে দেখতাম প্রার্থীরা ভোটার আনতে যাত্রীবাহী বাসের ব্যবস্থা করতেন। অনেকে বাড়ি বাড়ি রিকশা পাঠাতেন। কিন্তু নির্বাচনী আচরন বিধির কড়াকড়ির কারনে দিনে দিনে এসব ভোটার আনার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়। এখন ভোট সন্ত্রাস বন্ধ করতে নির্বাচনের দিন নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন স্টিকার যুক্ত গাড়ি ছাড়া সব গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে একটি শহরে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। নানা কারনে ঢাকার বাসিন্দারা বাসা বদলান। এখন ভোটের দিন যদি গাড়িই না থাকে তাহলে ভোটার ভোট কেন্দ্রে যাবেনই বা কী করে? অনেকে রিকশা-ভ্যান এসবেও উঠতে ভয় পান। ভোট আসলে প্রার্থীরা ভোটাদের পা থেকে শুরু করে সবকিছুই ধরেন। কিন্তু ভোটার ভোট কেন্দ্রে কী করে আসবেন তা নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী কেউ ভাবেননা! ভোটার কম এলে কী সরকারি দলের সুবিধা হয়? ভোটার ছাড়া কিন্তু গণতন্ত্র হয়না। সত্তুর লাখ ভোটারের মধ্যে ১০-১২ লাখের ভোট কাস্ট হয়েছে। এটা খুবই দূর্ভাগ্যজনক।

বিএনপির এত লোকজন দেখা গেলো তাবিথ-ইশরাকের প্রচারনায়, ভোটের দিন কী তারা ভাত ঘুম দিয়েছিলেন? কি ভীষন বক্তৃতা ইশরাকের! তিনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, এই করবেন সেই করবেন! ভোট কেন্দ্র পাহারায় রাখবেন। অতঃপর সেই পাহারার কী হলো? এবার শুধু একটা কথা রেখেছেন বিএনপির তাবিথ-ইশরাক। তাহলো নির্বাচনের দিন দুপুরে অভ্যাসমতো তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষনা দেননি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথামালার কৌশলে কোথায় হেরেছেন বিএনপির নেতারা? তারা বলেছেন, ভোটকেন্দ্র পাহারায় রাখবেন! আওয়ামী লীগ বললো বিএনপি সারাদেশ থেকে সন্ত্রাসীদের জড়ো করছে! তারা ভোটকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রন তাদের হাতে রাখবে! এরপর র‍্যাবের ডিজি বললেন, ঢাকার ভোটার নন, ঢাকার বাইরের লোকজন ঢাকা ছেড়ে চলে যান! ব্যাস এরপর আর শুধু বিএনপির ভোটার নন, সাধারন ভোটারদের অনেকেও সম্ভাব্য গ্যাঞ্জামে যোগ দিতে যাননি। আর বিএনপি নেতারাওতো প্রথম থেকে বলে আসছেন তারা ভোটে গেছেন সরকার আর নির্বাচন কমিশনের মুখোশ উন্মোচন করতে! জিততে নয়! একটি রাজনৈতিক দলের অত পরীক্ষা নিরীক্ষার বেদিমূলে বলিদানের সময় কী আছে আমজনতা ভোটারদের? এরচেয়ে মন্দের ভালো নিরাপদ পছন্দ সরকার দলীয় মেয়র। কাজকর্ম কিছু করতেতো  সরকার দলীয় মেয়র দরকার।

ইভিএমে আঙ্গুলের ছাপ মিলেনি ডক্টর কামাল হোসেন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের! এরচেয়ে বর্বর মনে হয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধী হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীদের ভোট কেন্দ্রে যাবার কোন ব্যবস্থা না দেখে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ভোটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু কিছু মিডিয়া তৃতীয় লিঙ্গ কথাটি বলে আরেকটি বিশেষন ব্যবহার করেছে যা শুনে সাংবাদিক হিসাবে লজ্জা করেছে। কারন ওই বিশেষনটি বাংলাদেশে গালি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের অনেক মিডিয়া এখন অনেক শব্দ ব্যবহারে সতর্ক হয়েছে। বাকিদেরও সতর্ক হওয়া উচিত। খুব ভালো লাগছিল যখন অনেক সাধারন নারী-পুরুষ ইভিএম’এ সহজে ভোট দিতে পারার আনন্দ প্রকাশ করছিলেন। একটি পত্রিকায় একটি কেন্দ্রের একাধিক  ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে ইভিএম’এর ওখানে একজন দাঁড়িয়ে ভোটের বাটনে চাপ দিচ্ছেন অথবা ভোট নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছেন! গুরুতর অভিযোগ। কিন্তু এই একটা অভিযোগ দিয়ে যদি গোটা ইভিএম ব্যবস্থাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, এর কিন্তু অন্য উদ্দেশ্য হয়ে যায়! ঢাকার কোন কেন্দ্রে কী সুষ্ঠু ভোট হয়নি? যে মানুষগুলো নতুন এক যন্ত্রে ভোট দেবার আনন্দ প‍্রকাশ করছিলেন, সেই আনন্দও মূল্যহীন? আপনার মানিব্যাগে থাকা ব্যাংক কার্ডও কিন্তু হ্যাক হতে পারে। এরজন্যে কী আপনি ব্যাংক কার্ড বর্জনের কথা বলবেন? তাবিথ-ইশরাক ভালো দু’জন প্রার্থী ছিলেন। তারা ভোটও কিন্তু কম পাননি। আর আতিক-তাপস কিন্তু কোন ফালতু প্রার্থী নন।

নানান অসম্পূর্নতার মাঝেও ঢাকার নির্বাচনী ফলাফলের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো মুজিববর্ষে এই দুই দু’জন মেয়রের সার্ভিস, সামনে থেকে নেতৃত্ব পাওয়া যাবে। তাবিথ-ইশরাকেরতো জাতির পিতা-বঙ্গবন্ধু বলতেও মানা। এ এক বাংলাদেশের আজব প্রজন্ম! এ অবস্থায় এই সময়ে তারা মেয়র হলে জাতির পিতা-বঙ্গবন্ধু ইস্যুতে তারা নিজেরাও বিপদে পড়তেন, দেশের মানুষকেও বিপদে ফেলতেন। ইনারা নির্বাচন বর্জন করেছেন! তাদের যে সব ভোটার ভোট দিয়েছিলেন তাদেরও বর্জন? তাহলে কী তাদের চারলাখের বেশি ভোটার এই দু’জনকে ভোট দিয়ে অন্যায় করেছেন? এই দলটির রাজনৈতিক খোলনলচে বদল নিয়ে জরুরি চিন্তাভাবনা করা উচিত। খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন শক্তিশালী করতে তারা নির্বাচনে এসেছিলেন। নির্বাচনে পরাজয় মানে কী সেই আন্দোলনের পরাজয়? কোকোর স্ত্রী কোন প্রস্তাব নিয়ে দেশে এসেছেন? কে ঠেকিয়ে রেখেছে সেই প্রস্তাব? বিএনপির ঘরের ভিতরের নানা দ্বন্দ্বগুলোর সুরাহা না করে দলটি সামনে এগোতে পারবেনা।

ফজলুল বারী
fazlulbari2014@gmail.com