ফজলুল বারী:খালেদা জিয়ার মুক্তির আগে বিএনপি চেয়ারপার্সনের মুক্তির বিষয়টাকে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্ত হিসাবে চিত্রিত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আরেকটি কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাহলো এই সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর মানবিক গুনাবলীকেই সবার ওপরে তুলে ধরেছে। কিন্তু দেশের পুলিশ মন্ত্রী বিষয়টিকে যেভাবেই বলুননা কেনো বিএনপির নেতাকর্মীদের বুধবার যেনো ঈদ লেগেছিল। যেখানে এখন সারা দুনিয়াজুড়ে করোনা মহামারীর এক ভীতিকর অবস্থা, তখন খালেদার শর্ত সাপেক্ষ মুক্তিকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাসের যে ছবি সৃষ্টি হয়েছে, এ ছবি বিশ্বজুড়ে যারা দেখবে তারাই ভয় পাবে। আর হয়তো ভাববে বাংলাদেশ কী বেকুবদের দেশ! যেখানে অস্ট্রেলিয়া বুধবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন বিয়েতে ৪ জন, শেষকৃত্যে ১০ জনের বেশি মানুষ উপস্থিত থাকতে পারবেনা।
অথচ বুধবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও গুলশানের ফিরোজার সামনে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তাতে বিএনপির নেতাকর্মীরা যেন খালেদা জিয়া এবং নিজেদেরও স্বাস্থ্য ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিলেন! তারা কী এখন হোম কোয়ারিন্টানে যাবেন? গেলে ভালো করবেন। ওই পরিস্থিতি সামাল দিতে নিয়োজিত পুলিশের সদস্যদের পাশাপাশি কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ন। কে যে কোথায় কিভাবে সংক্রামিত হয়ে যায়! বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাস অবশ্য এ ব্যাপারে গুলশানের ফিরোজার সামনে বলেছেন, যারা খালেদা জিয়ার ভালো চায় না তারাই মহামারীর এই সময়ে তাদের নির্দেশনা না মেনে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
মুক্তির পর বাড়ির উদ্দেশে যাবার সময় গাড়িতে খালেদা জিয়াকে যেভাবে বসে থাকতে দেখা গেছে তাতে তাঁকে সে রকম অসুস্থ মনে হয়নি। কারামুক্তির আনন্দের এটিই যেন উজ্জিবনী মহৌষধ! বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের কথা মনে আছে? জিয়ার মৃত্যুর সময় তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দাঁড়ানোর শক্তিও তার তখন ছিলোনা!
কিন্তু তাকে যখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ পড়ানো হলো, তিনি হঠাৎ করে যেন তরতাজা হয়ে গেলেন! শুধু হাঁটাচলা না, সারাদেশ ঘুরে তখন তিনি নির্বাচনও করেছিলেন। এখন মুক্তি পাবার পর খালেদা জিয়ার মন ভালো হবে। তাঁর চিকিৎসায়ও নাটকীয় অগ্রগতি হবে। খালেদা জিয়ার যে সব শারীরিক সমস্যা এসবের উন্নত চিকিৎসা বাংলাদেশেই আছে। তবে তাঁর যে বয়স, এই সময়ে তাঁকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন থেকে রক্ষাই হবে তাঁর চিকিৎসকদের মূল চ্যালেঞ্জ।
চলতি ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পরিবার ও দল তাঁকে যত দর্শনার্থী থেকে দূরে রাখতে পারবে, তত নিরাপদ থাকবেন বিএনপির চেয়ারপার্সন। মুক্তির সময়ও তাঁর খুব প্রিয় গোলাপী জর্জেটের শাড়ি তাঁর পরনে থাকলেও তাঁকে খুব ক্লান্ত মনে হয়েছে। তাঁর মাথার কাপড় যেভাবে পরা ছিল তাতে মনে হতে পারে জেল জীবনে তাঁর চুল পড়েছে। এসব যাই হোক না কেনো, মুক্তি যেভাবেই হোক না কেনো, খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়ে তাঁর ফিরোজায় ফিরে গেছেন এটিই সত্য। তাঁর এই মুক্তি তাঁর দল আইনগত অথবা আন্দোলনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে পারেনি। বিএনপি দলটির জনসমর্থন স্বত্ত্বেও এর নেতাদের অক্ষমতার আত্মসমালোচনা নেই। মানুষ তারা কেনো নামাতে পারলোনা, মানুষ কেনো তাদের কথায় নামেনা, এর আত্মসমালোচনা তারা যত তাড়াতাড়ি করবে তত তাদের জন্যে মঙ্গল।
মঙ্গলবার হঠাৎ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক হাটে হাড়ি ভাঙ্গার পর জানা গেলো খালেদা জিয়ার ভাই-বোনেরা গোপনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মানবিক বিবেচনায় তাঁর মুক্তির জন্যে আবেদন করেছিলেন। এর আগে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের উপাচার্যের কাছে একটি আবেদন করেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলেনা এটি নিশ্চয় তারাও জানতেন। কিন্তু এভাবে তারা হয়তো একটি প্রক্রিয়া এগিয়ে রাখার কথা ভেবে রেখেছিলেন। প্রক্রিয়াটি হলো খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্যে বিদেশে নিতে চাইলে দেশের মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশ লাগবে। কিন্তু যেভাবে শর্ত সাপেক্ষে তাঁর মুক্তি নেয়া হয়েছে তাতে করে আপাতত তাঁকে চিকিৎসার জন্যে বিদেশে নিয়ে যাবার পথ বন্ধ। খালেদা জিয়ার যে সব শারীরিক সমস্যা এরজন্যে বিদেশ যাবার দরকারও নেই।
এর আগে একটা কথা আমি বিভিন্ন সময়ে লিখেছি। তাহলো, আইনে অথবা আন্দোলনে বিএনপি খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পারলে মুক্তি নিতে হবে সরকারি চিন্তার মতো করে। বুধবার সেভাবেই খালেদাকে মুক্ত করে বাড়ি নিয়ে গেছেন তাঁর ভাই-বোন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে এতে সাড়া দিয়েছেন এতে তাঁর মানবিক গুনাবলীর পাশাপাশি রাষ্ট্র নায়কোচিত প্রজ্ঞাও কাজ করেছে। যে মানবিক বিবেচনা শেখ হাসিনা কোনদিন খালেদা জিয়ার কাছে পাননি, শেখ হাসিনা সেটিই খালেদা জিয়াকে দিয়েছেন। দুর্নীতির মামলায় খালেদার কারাজীবনে যারা হায় হায় করতেন তারা ভুলে গিয়েছিলেন, খালেদা জিয়ার আমলে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এরপর সে ঘটনা ধামাচাপা দিতে খালেদা সাজান জজ মিয়া নাটক! শেখ হাসিনার সবচেয়ে স্পর্শকাতর কষ্টকর দিন ১৫ আগষ্ট, জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার দিনটিকে হঠাৎ করে জন্মদিন হিসাবে পালন শুরু করেন খালেদা জিয়া। পচাত্তরের খুনিদের তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে সংসদের বিরোধীদলের নেতৃত্বে বসিয়েছিলেন! বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার আটকে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এসব বিষয় মনে রাখলে খালেদার সাময়িক মুক্তি প্রশ্নে শেখ হাসিনা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারতেননা।
খালেদা জিয়ার যে বয়স তাতে করে কারাগারে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছিল। ব্যক্তিগত জেদাজেদিতে দেশের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধার হাসপাতালের চিকিৎসা তিনি নিচ্ছিলেননা। এই বয়সে বিশেষ করে করোনা মহামারীর এই সময়ে কারাগারে খালেদা জিয়ার যদি কোন ঘটনা ঘটতো সেটিও কিন্তু সরকারের জন্যে বিব্রতকর হতো। এরজন্যে আমার ধারনা খালেদা জিয়াকে আপাতত মুক্তি দেবার মতো একটি পথও খুঁজছিলেন শেখ হাসিনা। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা এ ধরনের একটি আবেদন নিয়ে এগিয়ে আসায়, অথবা তাদের এ ব্যাপারে উদ্ধুদ্ধ করতে পারায় শেখ হাসিনার জন্যে সাপে বর হয়েছে। এরজন্যে দেশের মানুষের প্রশংসা পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রনায়কোচিত। রাষ্ট্রনায়কদের জানতে হয় কোথায় গিয়ে থামতে হয়। মানুষের হৃদয়গ্রাহী সিদ্ধান্তটির জন্যে শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা। খালেদা জিয়াও নিশ্চয় কৃতঘ্ন হবেননা।