ফজলুল বারী:বিদেশে আমরাই বাংলাদেশ। প্রিয় প্রজন্ম বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী তারাও বাংলাদেশ বিশ্বের দেশে দেশে। করোনা ভাইরাস মহামারীকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে অন্য সবার মতো বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরাও এখন বড় ধরনের সংকটের সম্মুখিন। তাদের অনেকেই এই পরিস্থিতির কারনে চাকরি হারিয়েছেন। ঘরে খাবার নেই। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকানো যায়না। তাদের মুখগুলোতে আমি উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ, বাংলাদেশে তাদের উদ্বিগ্ন বাবা-মা’র মুখগুলোও দেখি। চোখ ভিজে আসে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন শুক্রবার এই বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কড়া কিছু কথা বলেছেন। রাগ হয়েছে এই কথায়। এটা অস্ট্রেলিয়ানদের ভাষা নয়। স্কট মরিসন বলেছেন যে সব বিদেশি ছাত্রছাত্রী এই সময়কে কঠিন সময় মনে করছেন তারা এখন যারযার দেশে চলে যেতে পারেন। মরিসনের বক্তব্য অস্ট্রেলিয়া সরকার শুধু অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদেরই এই মূহুর্তে দেখাশুনা করতে পারবে।
মরিসনের বক্তব্য আমার পছন্দ হয়নি। আমি জানি তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ হবে। এরজন্যে এবিসি টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যমও তাঁর এই বক্তব্যকে লিড করেনি। কারন ৫ লক্ষ বিদেশি ছাত্রছাত্রীর ওপর ভর করে টিকে আছে অস্ট্রেলিয়ার এডুকেশন ইন্ডাস্ট্রি। এরা অস্ট্রেলিয়া সরকারকেও কর দেয়। এই বিদেশি ছাত্রছাত্রী ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও টিকবেনা। এদের স্থায়ীভাবে লকডাউনে চলে যেতে হবে। মরিসন যা বলেছেন এটি একটি খারাপ সময়ের খারাপ মন্তব্য। কারও মাথা এখন ঠিক নেই। বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের ওপর আমার রাগও হয়েছে। কারন এরা অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে এসেছে কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কি দরকার এ নিয়ে কখনো ভাবেনি। বাংলাদেশে থাকতে ভাবেনি, এখানে আসার পরেও নয়। এখন এই দূর্যোগে নার্সিং এর ২০ হাজার ছাত্রছাত্রীকে অস্ট্রেলিয়া সরকার মূলধারার চাকরিতে নিয়ে গেছে। কিন্তু এই ২০ হাজারে ২০ জনও বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাবেনা। নেপাল-ফিলিপাইনের মতো দেশগুলোর ছাত্রছাত্রীরা নার্সিং পড়তেই অস্ট্রেলিয়ায় আসেন। আর বাংলাদেশের নবাবজাদারা এমন সব বিষয়ে পড়তে আসেন যার কাজের বাজার বাংলাদেশেও নেই, অস্ট্রেলিয়াতেও নেই।
এই যে পড়াশুনা করতে এসে বিপদে পড়া এরজন্যে ছাত্রছাত্রীদের তথ্য গোপনও দায়ী। এরজন্যে অস্ট্রেলিয়া সরকারও এদের নিয়ে ভাবেনা! এখানে আসার জন্যে ভিসা পাবার জন্যে একেকজন বাবার ব্যাংক একাউন্টে এমন পরিমান টাকা দেখিয়েছেন যে যা দেখে যে কোন দেশ ভাববে এই ছাত্র ওই দেশের কোন ধনকুবেরের ছেলে! এই ছেলেকে ভিসা দিলে এই টাকাও আসবে অস্ট্রেলিয়ায়! এত টাকা অস্ট্রেলিয়ার কোন বাবা-মা’র ব্যাংক একাউন্টে থাকেনা। কিন্তু আদতে যে বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের নিরান্নব্বুইভাগেরই ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট ভূয়া তাতো আমরা জানি। ভিসা পাবার জন্যে এখানে এক-দুই সেমিস্টারের টিউশন ফী দিয়ে এসে প্রায় সবাই বাকি খরচ যোগাড় করে কাজ করে। কিন্তু করোনা ভাইরাস মহামারীকে কেন্দ্র করে অস্ট্রেলিয়ার সিংহভাগ রেষ্টুরেন্ট সহ নানান ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সবার সব পরিকল্পনা।
বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক আমলা-কিছু সাংবাদিকের ছেলেমেয়েও অস্ট্রেলিয়ায় পড়ে। তাদের সব খবর বাংলাদেশ থেকে আসে। প্রতি সেমিস্টারে ১৫-২০ হাজার ডলার টিউশন ফী ছাড়াও থাকা-খাওয়া খরচ বাবদ মাসিক তিন হাজার ডলারের বেশি এদের জন্যে দেশ থেকে পাঠানো হয়। কিন্তু এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
করোনা ভাইরাস মহামারী পরিস্থিতি সামাল দিতে অস্ট্রেলিয়া সরকার এরমাঝে তিন দফায় নানান স্টিমুলেজ প্যাকেজ ঘোষনা করেছে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে যারা বেকার হয়ে পড়েছেন তাদেরকে আগামী ছয়মাস দু’সপ্তাহ পরপর ১১ শ’ ডলার করে ভাতা দেয়া হবে। যারা এতদিন পার্ট টাইম জব করতেন, এই পরিস্থিতিতে জব হারিয়েছেন, তাদেরকেও দু’সপ্তাহ পরপর দেয়া হবে ১৫শ’ ডলার।
বাংলাদেশ সহ বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের জবও পার্ট টাইম জব। কারন ছাত্ররা সপ্তাহে ২০ ঘন্টার বেশি কাজ করতে পারেননা। এই স্টিমুলেজ ঘোষনার আগে আমি আশা করেছিলাম, পার্ট টাইমারদের হিসাবে বিদেশি ছাত্রছাত্রী তথা বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরাও থাকবেন, কিন্তু মরিসনের বক্তব্য সে আশায় ছাই দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার সুপার মার্কেটগুলোয় যে সব বাংলাদেশি কাজ করছেন, তাদের কাজ অবশ্য নিরাপদ আছে। রেষ্টুরেন্টে যারা কাজ করতেন তারাই সরাসরি বিপদে পড়েছেন। কারন বার-রেষ্টুরেন্ট-ক্লাব সবকিছুই এই পরিস্থিতির জন্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি, হাঙ্গরিজ্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানে চাকরিকরা আমাদের ছেলেমেয়ের সংখ্যাও খুব বেশি নয়।
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ার উলওয়ার্থ, কোলসের মতো সুপারমার্কেটে নতুন কুড়ি হাজারের মতো নতুন কর্মী নিয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের চেয়ে এই সংখ্যার চাকরি খুবই নগন্য। আমি যাদেরকে এই চাকরির জন্যে ঘনিষ্ঠ ম্যানেজারদের কাছে পাঠিয়েছিলাম তাদের সবার জব হয়নি। এমন ছেলেমেয়েদের এখন ফোনে কথা বলে সামনাসামনি কথা বলে সাহস দেবার চেষ্টা করছি। সবাইকে একটাই কথা বলছি, কোনভাবে সাহস হারানো যাবেনা। আমরা তোমাদের ভাই। আমরা আছি।
এমন একটা কেইস স্টাডি নিয়ে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি। এই ছেলেটি এখন সাইকেলে ফুড ডেলিভারির কাজ করে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সেই কাজও তেমন পাচ্ছেনা। খাবার ডেলিভারি বয়’র মাধ্যমে আবার করোনা জীবানু আসে কিনা এ নিয়ে অনেকেই এখন উদ্বিগ্ন থাকেন। শেয়ারের ভাড়া বাড়িতে থাকে বলে এই ছেলেটির সাপ্তাহিক বাড়ি ভাড়া ১৩০ ডলার। ট্রেন-বাসের ভাড়া লাগে সপ্তাহে ৫০ ডলার, বাসায় শেয়ারে খাওয়াদাওয়ায় সপ্তাহে ৪০-৫০ ডলার লাগে। টেলিফোনের কিস্তি মাসে ৮০ ডলার। এমন ছেলেদের জন্যে আমি আমার গাড়ি ভর্তি বাজার সদাই নিয়ে ঘুরি। চাল-ডাল-তেল-চিনি-লবন এমন নানা কিছু নিয়ে ঘুরলেও এখনও কাউকে দিতে পারিনি।
এই ছেলেটিকে আজ বললাম, তোমার ফোন, খাবার, অপাল এসবের যে কোন একটি খরচ আমি দিতে চাই। লাজুক ছেলেটি বলে দেয়া লাগবেনা ভাই। তাকে বলি, তোমার এখন কঠিন সময়। কিছুদিন পর এই কঠিন সময় থাকবেনা। এই অস্ট্রেলিয়ায় তুমিও একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে। ছেলেটি কেঁদে ফেলে। আমাকে বলে আমার লাগলে আপনাকে বলবো ভাই। পারলে একটা জব দিয়েন। আমাদের এই সোনার ছেলেরা এমন অন্য কিছু চায় না। শুধু একটা জব চায়।
বিদেশে এই ছেলেরাই আমাদের বাংলাদেশ। এরাই আমাদের ভবিষ্যত অক্সিজেন। এই ছেলেদের পাশে দাঁড়ানো মানেই আমাদের বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো। আমি তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। আপনিও দাঁড়ান। তা পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে। আমাদের প্রিয় প্রজন্ম বড় লক্ষী। এদেরকে আমাদের রক্ষা করতেই হবে। প্লিজ।