আমরা যারা বিদেশে থাকি

আমরা যারা বিদেশে থাকি

ফজলুল বারী:প্রিয় প্রজন্ম, আমরা যারা বিদেশে থাকি তারা করোনা মহামারীর এই সময়ে দেশের মানুষের জন্যে কী করতে পারি তা নিয়ে কিছু প্রস্তাবনা নিয়ে এ লেখায় আলোকপাত করবো। আমি যেহেতু অস্ট্রেলিয়ায় থাকি অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতাগুলো এ লেখায় শেয়ার করবো। বিদেশে যে যেখানে আছেন তারা যার যার অভিজ্ঞতা শেয়ার অথবা নিজস্ব চিন্তার প্রস্তাবও করতে পারেন। মোট কথা সবাই যে যার অবস্থান থেকে এ পরিস্থিতিতে কাজ করতে চাই। মানুষ বড় বিপদে এই সময়ে। মানুষ হিসাবে মানুষের কাজে লাগার এটাইতো শ্রেষ্ঠ সময়।

বিদেশ থেকে আমরা এমনিতে প্রতি মাসে আমাদের পরিবার-পরিজনের জন্যে টাকা পাঠাই। এ অবস্থায় আমার মনে হয় এখনকার করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের যার যার যা সামর্থ্য সে অর্থ দেশে পাঠানোর দরকার নেই। দেশে দুঃস্থ এবং কষ্টে মানুষজনকে সরকার এবং নানান ব্যক্তি উদ্যোগ সাহায্য করছে। এসব কাজে বাংলাদেশের সামর্থ্যও বেড়েছে। কাজেই দেশে এ ইস্যুতে অর্থ সাহায্য না পাঠিয়ে বিদেশে আমাদের আশেপাশে যে সব বাংলাদেশি যারা বিপদে আছেন,  কিন্তু তারা মুখ খুলে সাহায্য চাইতে পারেননা, তাদের জন্যে কিছু করার চেষ্টা করতে পারি। বিদেশে থাকা বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করা মানে তাদের দেশের উদ্বিগ্ন বাবা-মা’কে সাহায্য করা। প্রিয় প্রজন্ম এই সময়ে এমন সহায়তা আমরা যদি করতে পারি, এই বাবা-মা’ও আমাদের জন্যে হাত তুলে দোয়া করবেন।

আর দেশে যদি কোন সাহায্য দেশে পাঠাতেই হয় সে ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। যেমন আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি দূর্গম এলাকা যেখানে হামে বাচ্চারা মারা যাচ্ছে সেখানে কিছু সাহায্য পাঠিয়েছি। প্রিয় প্রজন্ম,  বিদেশ থেকে দেশে অর্থ সাহায্যের চাইতে আমরা বিদেশের নানা তথ্য দিয়ে দেশের মানুষের লড়াইয়ে সহায়তা করতে পারি। দেশে নানান তথ্য ঘাটতি-গুজব এসব এখন বড় একটি সমস্যা।

যেমন অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতা হচ্ছে এদেশের সরকার বলছে এখানে সোশ্যাল ডিসটেন্স তথা সামাজিক দূরত্ব কড়াকড়িভাবে মেনে চলার সাফল্য আসতে শুরু করেছে। এতে করে কমে আসছে করোনা সংক্রমনের হার। উল্লেখ্য সামাজিক দূরত্ব অস্ট্রেলিয়ায় নিশ্চিত করতে এখানে এক হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানাও করা হয়।

অবস্থার উন্নতি দেখে বৃহস্পতিবার অস্ট্রেলিয়া সরকার ঘোষনা করেছে যে সব বাবা-মা’ কাজে যান তাদের বাচ্চাদের চাইল্ড কেয়ার সুবিধা ফ্রি। উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ায় এতোদিন চাইল্ড কেয়ার খরচের একটি অংশ সরকার বহন করতো। এখন এই খরচের পুরোটা বহন করবে সরকার। এরমাধ্যমে সরকার কর্মজীবী বাবা-মা’কে কাজে ফিরে যেতে উৎসাহিত করছে। যদিও এই পরিস্থিতিতে যেখানে সিংহভাগ স্কুল বন্ধ করা হয়েছে, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও বাড়ি বাড়িতে থেকে অনলাইনে পড়াশুনা করছেন সেখানে চাইল্ড কেয়ারে বাচ্চারা কতোটা নিরাপদ এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

প্রিয় প্রজন্ম, সব দেশ যেমন শুধু তাদের নাগরিকদের কল্যান চিন্তা করে, অস্ট্রেলিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। এরকারনে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে এ দেশের সরকার এখন পর্যন্ত যত অর্থনৈতিক সহায়তা কর্মসূচি ঘোষনা করেছে এর কোথাও বিদেশি ছাত্র তথা বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীর অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করা হয়নি। সর্বশেষ যখন জব হারানো পার্ট টাইমারদের প্রতি দু’সপ্তাহে পনেরশ ডলার করে সহায়তার ঘোষনা করা হয় তখনও অপেক্ষায় ছিলাম যদি এই তালিকায় বিদেশি ছাত্রদের নাম আসে। কারন বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা এখানে মূলত পার্ট টাইম জবই করেন এবং তারা সরকারকে এরজন্যে করও দেন।

কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে এই তালিকায় নিউজিল্যান্ডের নাগরিক ছাড়া আর কোন বিদেশিকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। এখন এ বিষয়টি আমরা আমাদের ঘনিষ্ঠ সরকার ও বিরোধীদলের নেতা-এমপিদের নজরে আনার চেষ্টা করছি। ই-মেইল করে অনুরোধ করছি সরকারকে। আপনারাও যার যার অবস্থান থেকে অনুরোধটি করবেন। কারন করোনা পরিস্থিতির কারনে তারাও চাকরি হারিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। এই সমস্যায় পড়া ছাত্রছাত্রীদের অনেকে বিনামূল্যে খাবার দেবার কথা অনেকে ভাবছেন। কিন্তু আমার ধারনা এভাবে সহায়তা বাস্তব সম্মত নয়।

অস্ট্রেলিয়ায় বাসা ভাড়া, ভ্রমন ব্যয়, ফোন-ইন্টারনেট ব্যয় এসবের তুলনায় খাবারের খরচ কম। কারন বিদেশেও আমরা রান্না করে খাই। আমার পরামর্শ এই বিপদে পড়া ছেলেমেয়েদের আমাদের উচিত যতটা সম্ভব হয় সময় দেয়া। তাদের ফোনে এটেন্ড করা অথবা সম্ভব হলে সামনা-সামনি তাদের সঙ্গে বসে কথা বলা। কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে তাদেরকে সাহস দিতে হবে।

যার যেখানে সম্ভব কোথা কাউকে জব পেতে সহযোগিতা করা গেলে সেটাই হবে বড় সহায়তা। যতোক্ষন জব পাওয়া না যায় তার জরুরি প্রয়োজন মেটাতে সহায়তা করতে হবে। আরেকটা প্রস্তাব আছে আমার। আমরা সাধারনত কারও বাসায় যাবার সময় মিষ্টি-দই এসব নিয়ে যাই। এখন খুব সমস্যায় যারা আছেন তাদেরকে তাদের জরুরি বাজার সদাই করে দিয়েও সহায়তা করতে পারি। আমাদের ছেলেমেয়েরা সহজে এমন সহায়তাও নিতে চাননা। তখন দরকার হলে তাকে বকাও দিতে হবে। বকা দিয়ে বলতে হবে, আমি তোমার ভাই-বন্ধু অথবা অভিভাবক, তোমার এখন এ সহায়তাগুলো নেয়া দরকার। যখন তোমার সমস্যা মিটে যাবে তুমিও তখন এমন সমস্যাগ্রস্ত কাউকে সহায়তা করবে।

আমদানি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়ায় অস্ট্রেলিয়ায় এখন চালের দাম বেশ বেড়েছে। লবন, তেল, টয়লেট টিস্যু এসব সব শপিংমলে পাওয়া যায়না। এক্ষেত্রে আমি যেটা করি তাহলো যখন যে শপিংমলে ঢুকি, যেখানে লবন, তেল, টয়লেট টিস্যু জাতীয় পন্য যা পাই তা কিনে আমার গাড়িতে রাখি, যার যেটা দরকার, সে সেটা নিতে না চাইলেও জোর করে গছিয়ে দেই। আপনারাও এটা করতে পারেন। আমাদের কোন একজন ছাত্রছাত্রী ভাই বা বোনকে যদি পাঁচ কেজির এক ব্যাগ চাল, কিছু আলু, ডাল, পিয়াজ, এক-দুই কেজি মাংস এসবও যদি একেকবারে দিতে পারি তাঁর বেশ কয়েকদিন চলে যাবে। এরমাঝে আমরা তাঁর-তাঁদের চাকরির জন্যে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাবো। অথবা এই সময়ে তারাও চাকরি পেয়ে যাবে। প্রিয় প্রজন্ম, কারও কোন পরামর্শ থাকলে আমাকে লিখতে পারো। আমরা দূর্যোগ সামাল দেয়া জাতি। এই দূর্যোগও আমরা সামাল দেবোই। জয় বাংলা।

ফজলুল বারী
fazlulbari2014@gmail.com