ফজলুল বারী: করোনা ভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে চলমান বিশ্বযুদ্ধের এই সময়ে নানা বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধাদের পাশাপাশি এই যুদ্ধের রাজাকার গণশত্রুদের চেহারাগুলো প্রতিদিন চিহ্নিত হচ্ছে।
চট্টগ্রামের একটি ঘটনা দেখে মনে হলো এসব রাজাকার গণশত্রুদের এখন চিহ্নিত করা জরুরি। এটি এখন সময়ের দাবি। অবিশ্বাস্য মর্মন্তুদ একটি ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের বানিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে!
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ রুমি হোসেন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো তাঁকে নিতে একটি এয়ার এম্বুলেন্স এসেছিল। এয়ার এম্বুলেন্সটি গিয়ে নামে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের বহতল কলোনীর মাঠে।
কিন্তু স্থানীয় কিছু পাষন্ড সেই এয়ার এম্বুলেন্সে করে রোগী নিতে দেয়নি! গুরুতর অসুস্থ ডাক্তারের এক ছাত্র ছবিটি সহ ফেসবুকে অমানবিক ঘটনাটি লিখেছেন। তা পড়তে গিয়ে ক্রোধ হয়েছে।
বড় অসহায় লাগছে। আমার কাছে এরাই এই যুদ্ধের গণশত্রু রাজাকার। একজন রোগীকে এয়ার এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে একটি এলাকায় করোনা রোগ ছড়ায়না। করোনা ছড়ায় এদের আচরনে তৎপরতায়!
যারা সামাজিক দূরত্ব না মেনে সেই এয়ার এম্বুলেন্সকে ভিড় করে ঘিরে রেখেছিল। যারা ভিড় করে ঈদ শপিং করছেন তাদের ঠেকাবার মুরোদ নাই! এক রোগীকে হাসপাতালে নিতে বাধা দিচ্ছেন! এই কর্তৃ্ত্ব তাদের কে দিয়েছে?
আশা করি পুলিশ এদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেবে।
আরেক পক্ষ বলছেন করোনা রোগী শুনে এয়ার এম্বুলেন্সই সেই রোগী নেয়নি। এমন হয়ে থাকলে সে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশটা কিন্তু এমন নির্দয় নিষ্ঠুর ছিলোনা। এ দেশটায় সব সময় মানুষ একজন আরেকজনের বিপদে এগিয়ে যেতো।
একটি এলাকায় আগুন লাগলে লোকজন হাতে হাত লাগিয়ে হিউমেন চেইন বানিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায় দমকলের পানির পাইপ। এখানে এমন মানুষের বিপদে নিত্য ছুটে যায় মানুষ।
এই মহামারীর বিপদেও মানুষ বাড়ি বাড়ি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার দিচ্ছে। কিন্তু এখানে একজন রোগীকে হাসপাতালে নিতে বাধা দিতে আসা নির্দয় নিষ্ঠুর গণশত্রুদের দেশ কিন্তু আমাদের চেনা দেশ নয়।
এর আগে করোনা যুদ্ধের ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি থেকে নামিয়ে দেবার খবর বেরিয়েছিল। খবর পেয়ে একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাতের বেলা অকুস্থলে গিয়ে তাদের ঘরে তুলে দিয়ে এসেছেন।
এরপর জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে একটা হুমকিও দিতে হয়েছে। মন্ত্রী হুমকি দিয়ে বলেন এমন ঘটনা আর শোনা গেলে সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিকের গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে।
দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদও তখন হুমকি দিয়ে বলেন এসব বাড়ি এরা কী করে বানিয়েছে তা খুঁজে দেখা হবে। এরপর রাজাকার বাড়ি মালিকরা চুপ মেরে যায়। মাঝে মাঝে এমন রাজাকারদের হুমকি দেয়া ভালো।
আমার কাছে যারা দূর্নীতির মাধ্যমে নিম্নমানের পিপিই-মাস্ক দিয়ে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রথম করোনায় আক্রান্ত করেছে তারাও এই যুদ্ধের রাজাকার-গণশত্রুর শ্রেনীতে পড়ে। কোন একদিন তাদেরও বিচার হবে।
যারা ত্রানের চাউল চুরি করেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালোবাসার ঈদ উপহার আড়াই হাজার টাকার প্রকল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তারাও এই যুদ্ধের গণশত্রু। অনলাইনে এই টাকা বিলি নিয়ে ভাইরাল একটি ভিডিও দেখেও চমকে উঠেছি!
গ্রামের অনাথ মায়েরা-মেয়েরা প্রধানমন্ত্রী উপহারের টাকা তুলতে বিকাশ এজেন্টের দোকানে ভিড় করেছেন। সেখানে তাদের সবাইকে পাঁচশ টাকা রেখে দিয়ে দুই হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছিল! পুলিশ যাতে অতিদ্রুত ওই বিকাশ এজেন্টকে গ্রেফতার করে।
বিকাশ যাতে বাতিল করে ওই লোভী এজেন্টের ডিলারশিপ! দেশে এখন কত মানুষ কতভাবে মানুষের উপকার করছে। কিন্তু এই লোভী মানুষেরা তছনছ করছে মানুষের প্রতি মানুষের সমস্ত ভালোবাসা! সমস্ত অর্জনকে এরা ধংস করে দিচ্ছে!
অনেকে মনে করতে পারেন এতো ছোট ছোট লোকজন গণশত্রু হয় কী করে! গণশত্রুর ছোটবড় নেই। একাত্তরের দেইল্লা রাজাকারও বড় কেউ ছিলোনা। সাঈদখালি গ্রামের পাড়েরহাট বাজারে হাটবারে হিন্দুবাড়ির লুটের মাল বিক্রি করতো।
সেই সাঈদি নাম নেয়া সেই গণশত্রুকে এখন ভন্ডরা চাঁদেও ঢোকায়। এখন এই করোনা যুদ্ধে পুলিশের যত সদস্য আক্রান্ত হচ্ছেন এরজন্যে রাস্তায় রাস্তায় ভিড় করা মিথ্যাবাদীরাই আসল দায়ী।
এদের সামলাতে গিয়ে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন। আর তাদের যারা আক্রান্ত করছেন তারা তাদের মৃত স্বজনের লাশ পর্যন্ত দাফন করছেননা। লাশ ফেলে পালিয়ে যাচ্ছেন!
সেই লাশও পুলিশ-উপজেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাফন করছেন! মানুষের সেবা করতে গিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের এত সদস্য এমন মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েছেন এটা এই বাংলাদেশে আর দেখা-শোনা যায়নি।
বিবিসি এই মানবিক যোদ্ধাদের নিয়ে বিশেষ একটি রিপোর্ট করেছে। সেই রিপোর্টে আছে এক তরুন পুলিশ সদস্য বলছে যখনই একটি করোনা রোগীকে ভর্তি করাতে হবে খবর আসে তখনই সে ছুটে যায়।
তাকে ভর্তি করতে করতে আরেক রোগী ভর্তি করতে হবে খবর আসে। তখন তিনি ছুটে যান নতুন রোগীর উদ্দেশে। বাংলাদেশের মানুষ পুলিশের এমন মানবিক চেহারা এর আগে এভাবে কখনো এমন বিপুল মাত্রায় দেখেনি।
এই পুলিশ বাহিনীকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। এরজন্য বন্ধ করতে হবে গণশত্রুদের আগ্রাসন। এখন যত মানুষকে রাস্তাঘাটে দেখছেন, পুলিশ-সেনা সদস্যদের দেখলে অন্য রাস্তায় চলে যাচ্ছেন!
মহামারীর ব্যাপারে অসতর্ক বেপরোয়া এই মানুষজনই পুলিশ-মিডিয়া কর্মীদের আক্রান্ত করছেন। গার্মেন্টস কর্মীরা বস্তিতে থাকে বলে আমরা দুশ্চিন্তা করি। কিন্তু পুলিশের সদস্যরাও থাকেন পুলিশ ব্যারাক নামের আরেক বস্তিতে!
তাদের অস্বাস্থ্যকর থাকার ব্যবস্থার কারনে এখন পুলিশের সদস্যরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এতোদিন এই রাষ্ট্র পুলিশ সদস্যদের এমন মানবেতর জীবনযাপন নিয়ে এভাবে ভাবেনি।
শুধু তাদের সার্ভিসই নিয়েছে! এখন আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের হাসপাতাল-হোটেল সহ নানা জায়গায় রাখা হচ্ছে। পুলিশের বাসযোগ্য ব্যারাক নির্মান ভালো খাবার-জীবনযাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশের মিডিয়ার লোকজন সারাজীবন সবার খবর রাখেন। নিজের সংসার-স্বাস্থ্যের খবর রাখেননা। খুব কম সাংবাদিক নিয়মিত বেতন পান। এই করোনার সময়ে তাদের অনেকে আরও বেশি অসহায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে অবর্ননীয় সংকটে পড়েছে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের জীবন ভবিষ্যত। মিডিয়া কর্মী এই করোনা যোদ্ধাদের পাশেও আমাদের দাঁড়াতে হবে। যে সব মালিক এই দূর্যোগের সময়ে সাংবাদিকদের বেতন ছাড়া কাজ করায়।
আক্রান্ত বিপর্যস্ত সাংবাদিকদের পরিবারের পাশে দাঁড়ায়না গণশত্রুর তালিকায় তাদেরও নাম তুলে তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বেতন ছাড়া সাংবাদিকদের কাজ করাতে মিডিয়া দোকান খুলতে তাদের কেউ হাতেপায়ে ধরেনি।
এই যুদ্ধের সব যোদ্ধাকে স্যালুট। মহাযুদ্ধের এই রণাঙ্গনেকোথাও কোন গণশত্রুকে ছাড় নয়।