ফজলুল বারী: বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ও নেতৃত্বে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের মানুষজনকে ছোট করে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
এরপর বঙ্গবন্ধু বিরোধী নানামুখি প্রচারনার ভিতর আমাদের প্রজন্ম বড় হয়েছে। বেতার-টিভি সহ গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিষিদ্ধ এক নাম। মোশতাক থেকে শুরু করে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া সবাই জাতির পিতাকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন।
দেশ স্বাধীন হবার পর গর্তে ঢুকে যাওয়া স্বাধীনতা বিরোধীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আবার প্রকাশ্যে চলে আসে। গ্রামগঞ্জে তারা জাতির পিতাকে নিয়ে এমন সব ঔদ্ধত্যের কটাক্ষ চালু করেছিল তা এই প্রজন্ম কল্পনায় ভাবতে পারবেনা।
আমি আমাদের সেই প্রজন্মের কথা বলছি, যাদের তখন মুক্তিযুদ্ধে যাবার বয়স ছিলোনা। কিন্তু তখনকার চারপাশের অনেক কিছুই আমরা এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারি। দৃশ্যত বঙ্গবন্ধু নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সবকিছুতে আছেন।
বঙ্গবন্ধুকে আমি মূলত ভিন্ন রকম করে দেখার-জানার সুযোগ পাই আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময়। সারাদেশের গ্রামজনপদের মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্টারভ্যু করতে করতে তাদের চোখেমুখে জানতাম বিশেষ এক নেতার কথা।
যার নামে-কথায়-নির্দেশে তখনকার সারাদেশ কিভাবে উত্তাল আলোড়িত হয়ে সেদিন তারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তঅথচ এখনও এমন লোকও আছে, যারা সুযোগ পেলে বলার চেষ্টা করেন বঙ্গবন্ধু নাকি যুদ্ধ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতাই চাননি!
এই সরকারের এক মন্ত্রীর পত্রিকায় আমাদের পড়ানো হয়েছে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতায় যাচ্ছিলেন। ছাত্র নেতাদের বিরোধিতার মুখে তা পারেননি। এরপর তিনি সাত মার্চের ওই ভাষন দেন।
এসব অপপ্রচারের জবাব আমি প্রবীন বামপন্থী নেতা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক রণেশ মৈত্র’র বক্তব্য দিয়ে দেই। বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের বেশ কয়েক জায়গায় এই রণেশ মৈত্র’র কথা রয়েছে।
পাবনার তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতা রণেশ মৈত্র কোন দিন আওয়ামী লীগ করেননি। ১৯৫৩ সাল থেকে বহুবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। বয়সে ছোট হলেও বঙ্গবন্ধু তাঁকে সম্মান দিয়ে ‘আপনি’ সম্বোধন করে কথা বলতেন।
ছয় দফা ঘোষনার পর ১৯৬৭ সালে যখন ঢাকা কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর দেখা-কথা হয় তখনও রণেশ মৈত্র আইনের ছাত্র। তখন তিনি পাবনা জেলা ন্যাপের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক। বয়স তখন তাঁর ৩৪।
বামপন্থী নেতা হিসাবে পাবনায় গ্রেফতার হলে আইন পরীক্ষা উপলক্ষে তাঁকে তখন ঢাকা জেলে আনা হয়। বঙ্গবন্ধু তখন ওই সময় ঢাকা জেলে বন্দী। বঙ্গবন্ধু খবর পেলেন নতুন রাজবন্দী এসেছেন।
খবর পেয়ে তিনি জেলখানার ভিতরে হাঁটতে বেরিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখেন এতো রণেশ মৈত্র। বঙ্গবন্ধু তখন প্রতিদি সকালে-বিকালে জেলখানার ভিতরের খোলা এলাকায় হাঁটতেন। রণেশ মৈত্র তখন থেকে হয়ে গেলেন তাঁর হাঁটার সঙ্গী।
কারাগারের বাইরে তখন বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। ন্যাপ তখনও ঐক্যবদ্ধ থাকলেও ৬ দফার প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপের চীনপন্থী অংশ ৬ দফাকে মার্কিন নকশা বলে এর বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
ছয় দফা ইস্যুতে আইয়ুব খানকে সমর্থন করেন মাওলানা ভাসানী! সীমান্ত গান্ধী নামে পরিচিত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়ালি খান, পূর্বের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে মস্কোপন্থী অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ৬ দফাকে সমর্পন দেন।
রণেশ মৈত্রও মস্কোপন্থী হিসাবে ৬ দফার পক্ষে শুনে খুশি হন বঙ্গবন্ধু। রণেশ মৈত্রকে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘আসলে আমারতো ছয় দফা নয়, এক দফা। স্বাধীন বাংলা’। রণেশ তাঁকে বলেন ‘পারবেননা। কারন আপনার কেবলাতো আমেরিকা।
তারা কোন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেনা। এক্ষেত্রেও করবেনা’। বঙ্গবন্ধু তখন হেসে বলেন, ‘হ্যাঁ আমেরিকা বটে, তবে ভায়া ইন্ডিয়া’। রণেশ বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ইন্ডিয়ার কিছু লবি আছে। তাদের মাধ্যমে রুশপন্থীদের শরণাপন্ন হন’।
বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘দেখা যাক’। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু পাবনা যান। রণেশ মৈত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অভ্যর্থনাকারীদের তৃতীয় সারিতে গিয়ে দাঁড়ান।
বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টার থেকে থেমে অভ্যর্থনাকারীদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছিলেন। রণেশ মৈত্রের দিকে চোখ পড়তেই পুলিশ কর্ডন ভেঙ্গে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘কী বলেছিলাম না? দেশ স্বাধীন করে ছাড়ব?’
উত্তরে রণেশ মৈত্র তাঁকে বলেন, ‘আপনার মার্কিন কেবলার সহযোগিতায় বিজয় অর্জিত হয়নি। হয়ছে আমার বলা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায়’। বঙ্গবন্ধু হেসে দিয়ে বলেন, ‘কথাটি পাঁচ বছর আগে ঢাকা জেলে হয়েছিল।
আজও মনে আছে দেখছি’। রণেশ মৈত্র তাঁকে বলেন, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ আপনি তা মনে করিয়ে দিলেন’। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের এমন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী অনেক তথ্য আমাকে দিয়েছেন।
মীর মোশাররফ হোসেন বিষাদ সিন্ধু উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু তিনিতো কারবালা ময়দানে ছিলেননা। কারবালার ময়দানে তাঁর থাকা লাগেনি। কারবালার বিয়োগান্তক ইতিহাসের পুঁথি-পুস্তক ছিল তাঁর বিষাদ সিন্ধু লেখার ভিত্তি।
ঠিক আমরা যারা বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি তাদের কাছে বঙ্গবন্ধুকে জানার সূত্রতো এমন সব ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের বক্তব্য-ইন্টারভ্যু এবং লিখিত-প্রকাশিত নানান ডকুমেন্টস। হাদিসওতো সাহাবিদের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক সংগ্রহ সংকলন।
দেশের বাইরের আগরতলা-কলকাতার একাত্তরের সাংবাদিক-বাংলাদেশ বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে বলে অনুভব করতে পারি অন্য উচ্চতার এক নেতাকে। একাত্তরে কলকাতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক রাজধানী হয়ে উঠেছিল।
আকাশবানীর কলকাতা কেন্দ্রেই ছিল স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের অফিস-স্টুডিও-সম্প্রচার কেন্দ্র। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবানী কলকাতা কেন্দ্রের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিবিসির বাংলা বিভাগের খবর তখন গ্রামজনপদে গোপনে শোনা হতো।
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের সামরিক রাজধানী। বেশিরভাগ যুদ্ধ নেতা আগরতলায় যাওয়া আসা করতেন। আগরতলার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য বঙ্গবন্ধুর আগরতলা পর্বটি বলবেন বলেছিলেন। বলে যাননি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের বরেন্য বাঙালিদের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো একটি ঘটনা। তাদের অনেকের জন্ম বাংলাদেশে। তারা ভেবেছেন বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আবার জন্মভিটা দেখার সুযোগ পাবেন।
এরজন্যে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা’, ‘শোন একটি মজিবরের থেকে লক্ষ মজিবরের কন্ঠ থেকে ধ্বনি প্রতিধ্বনি, ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরি মেঘনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’ এসব গান-কবিতাগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে লেখা হয়েছে।
একবার সাংবাদিক আবেদ খানের একটি লেখা পড়ে আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলাম। আবেদ খান লিখেছিলেন পনের আগষ্টের খুনিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর তিনি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান পরিকল্পনা নিয়ে লিখেছিলেন। ইত্তেফাকে তা ছাপাও হচ্ছিল।
কিন্তু খবর পেয়ে রাতের বেলা প্রেসে পৌঁছে পত্রিকা ছাপা বন্ধ করে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু রিপোর্টটি তুলে ফেলে দেন। ‘ইতিহাসের কাছে আমার দায়’ শিরোনামে আবেদ খান লিখেছিলেন, ওই রিপোর্ট ছাপা হলে বঙ্গবন্ধু অন্তত তা জেনে সতর্ক হতে পারতেন।
আবেদ খান আমাদের শ্রদ্ধেয় অগ্রজ সাংবাদিক। তাঁর লেখা পড়ে আবেগ প্রবন হয়ে ফেসবুকে লিখেছিলাম। তখন তাঁর বিরোধীরা এ নিয়ে আমাকে তিরস্কারও করেছেন! তাঁদের বক্তব্য ছিল, ওই ঘটনার পরওতো তিনি ইত্তেফাকে কাজ করেছেন।
বা এর প্রতিবাদে ইত্তেফাক ছেড়ে যাননি। এ ছাড়া ওই খবর ছাপা না হলেও আবেদ খানের মতো সাংবাদিকের তখন তা বঙ্গবন্ধুকে জানানোর মতো বিকল্প মাধ্যম ছিল। আবেদ খানের কাজিন তোয়াব খান তখন বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি ছিলেন।
সাংবাদিক বা যে কারও বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত যাওয়াটা তখন এত জটিল বিষয় ছিলোনা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাংবাদিক সখ্যের অনেক গল্প বলেছেন আহমেদ নূরে আলম। যেমন তারা নানা রিপোর্ট নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করতেন।
বঙ্গবন্ধু তখন সংশ্লিষ্ট সম্পাদক বা বার্তা সম্পাদককে ফোন করে বলতেন, ‘নূরে আলম এই রিপোর্ট লিখবে। ফ্রন্ট পেইজে এই হেডিং’এ ডাবল কলাম বক্স করে ছেপে দিস’। ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকরাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর তথ্য পাবার অন্যতম সূত্র।
আবার বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের আগে পরে দৈনিক বাংলা ভবনের বিচিত্রা পত্রিকাটি ছিল খুনিদের মিটিং পয়েন্ট। বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী হত্যাকান্ডের আগে সাংবাদিক আবেদ খানকে খুনিদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এখন আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের অভিভাবক সাংবাদিক হিসাবেই সবাই জানেন মানেন। এখন আব্দুল গাফফার চৌধুরী আওয়ামী লীগের একজন নিরেট শুভাকাংখী-উপদেষ্টাও।
কিন্তু বাকশালের আগ পর্যন্ত তাঁর জনপদ’ পত্রিকার ফাইল এই প্রজন্মের হাতে পড়লে তারা চমকে যাবেন। জাসদের ‘গণকন্ঠ’, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘জনপদ’, মাওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’, এনায়তুল্লাহ খানের ‘হলিডে’, কাজী জাফর আহমদের ‘নয়াযুগ’ এসব তখন ছিল কট্টর মুজিব সরকার বিরোধী পত্রিকা।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক মূলধারার সংবাদপত্রের সমর্থন আর প্রশংসা পড়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্থান-বিকাশ হয়েছিল। যুদ্ধ বিধবস্ত বাংলাদেশে সংবাদপত্রের এমন কট্টর বিরোধিতায় তিনি অভ্যস্ত ছিলেননা।
স্বাধীনতার পর এসব পত্রিকার কট্টর সমালোচনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর শাসনের বিরুদ্ধে মিডিয়ার ষড়যন্ত্রও ছিল। চুয়াত্তরের দূর্ভিক্ষ মঙ্গা পীড়িত কুড়িগ্রামে জালপরানো বাসন্তীর সাজানো ছবিটির আসল কাহিনী প্রকাশ হয়েছে পরে।
যে মানিক মিয়ার ইত্তেফাকের পাতায় পাতায় একজন বঙ্গবন্ধু নামের একজন তুমুল জনপ্রিয় নেতার সৃষ্টি, সেই মানিক মিয়ার ছেলেদের ইত্তেফাকে তাঁকে অবনমনের এমন একটি বাসন্তীকে জাল পরানোর ষড়যন্ত্র হয়েছে!
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই জাল পরা বাসন্তী কাহিনী টেলিভিশনে বেশি বেশি প্রচার করা হতো। আরও বলা হতো কামাল-জামালের বিয়ের কাহিনী! এখন বাংলাদেশের অমুকের তমুকের ছেলেমেয়ের বিয়ে উপলক্ষে কত বড়বড় জমকালো অনুষ্ঠান হয়।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কোন একটি ছেলেমেয়ের বিয়ে উপলক্ষে বড় কোন অনুষ্ঠানও হয়নি। জীবনের বড় অংশ দেশের জন্যে জেল-জুলুম সহ্য করা জাতির জনকেরও যে একটি পারিবারিক জীবন ছিল বা থাকতে পারে সেটিকে কেউ সম্মান দেখায়নি।
আমার বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রামজনপদের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে তাদের অনেক আশা-হতাশা-ক্রোধের কথাও আমাকে বলেছেন। বঙ্গবন্ধুকে তারা নিঃশর্ত ভালোবাসতেন। আবার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাদের আক্ষেপ-হতাশাও ছিল।
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হতাশা সহ নানা অপপ্রচারও কোন কোন ক্ষেত্রে তৈরি করা হয়েছে। এর কোন কোনটি হয়তো ইচ্ছাকৃতও নয়। দেশে স্বাধীন হবার পর মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টি যেভাবে হ্যান্ডেল করা উচিত ছিল তা হয়নি।
নবীন দেশের নেতৃত্বের সময়-সামর্থ্যেরও ঘাটতি ছিল। আকাশ সমান প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছিল। সামর্থ্যের কথা ভাবা হয়নি। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু তখনও ফেরেননি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কিনা তাও কেউ জানেননা।
যুদ্ধ বিধবস্ত নতুন দেশের চারদিকে চাপা এক পরিস্থিতি। বাতাশে তখনও লাশের গন্ধ। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা সহ সবার একটাই প্রার্থনা ছিল, আল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে দাও। তারা বঙ্গবন্ধুর অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন।
মায়েরা-মেয়েরা অনেকে তখন বঙ্গবন্ধুর জন্যে রোজা রাখছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অপেক্ষা ছিল বঙ্গবন্ধু এসে তাদেরকে দেশ গড়ার কাজে লাগাবেন। তখন গ্রামগঞ্জের অনেক বাড়িতে তখন ছেলে যুদ্ধ থেকে ফেরায় আনন্দের হিল্লোল বইছে।
আবার অনেক বাড়িতে চলছে কান্নার রোল। কান্না থামছেইনা। কারন ছেলে যুদ্ধ থেকে ফেরেনি বা আর ফিরবেনা কোন দিন এমন খবর এসেছে। এমন অপেক্ষার শেষে ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তাঁর দেশে ফেরার পর পূর্নতা পায় বাংলাদেশের বিজয়-স্বাধীনতা। যুদ্ধ বিধবস্ত দেশে চারদিকে শুধু নাই আর নাই হাহাকার। সবার তখন বয়স কম। সবার মাথার মণি পাহাড় সমান জনপ্রিয়তা পাওয়া বঙ্গবন্ধুর বয়সইবা কত।
বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার গড় বয়স ছিল পঁচিশেরও কম। বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টা রাজনৈতিক-ছাত্র নেতাদের বয়সও কম। স্বপ্নের মতো সেই সময়। বাস্তবের মাটিতে পা রাখতে অনেকের হোঁচট খাওয়ার বয়স।
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশাসনে থাকা পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্মীকরনেও সমস্যা তৈরি করে। পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের উদার বঙ্গবন্ধু আত্মীকরন করে নিলেও তেলে আর জলে কখনও মেশেনি।
মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি তখন থেকেই। এ নিয়ে আমাকে অনেকে বলতেন মুক্তিযুদ্ধের পর সব মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলা উচিত ছিল! এটাই নাকি যুদ্ধের নিয়ম! তাদের এসব কথা শুনে আমি আমি অবাক হয়ে যেতাম।
এরপর মিলিয়ে দেখতাম যারা এমন কথা বলতেন তারা কেউ যুদ্ধে যাননি। অথবা তারা পাকিস্তান ফেরত! মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনপণ যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর যুদ্ধ না করা বা পাকিস্তান থেকে ফেরতরা তখন ফতোয়াবাজ!
গণহারে মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলে স্বাধীন দেশের সব যশ-রস তখনই আহরন-উপভোগে তারাই মনোযোগী! বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগের বিষয়গুলো বেশি বেশি প্রচার করা হয়।
আবার জিয়া-এরশাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার-জওয়ানদের গণহারে হত্যা করা হয়। একটার পর একটা অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছে আর তখন বেছে বেছে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মেরে ফেলা হয়েছে!
তখনকার এমন নানা কিছুর মিশেল অস্থির সেই সময়কে আজকের সময়ে বসে চটজলদি এখন অনেকে অনেক কিছু ভেবে ফেলছেন। মতামত দিয়ে ফেলছেন। এখন আবার সার্টিফিকেট বিলির মহাধুম! কথা সাবধানে বলতে হয়।
কারন নানান সুবিধাবাদী লোকজন সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে ঘুরছে! মতে না মিললে কে কোথায় কখন আপনাকে রাজাকার বানিয়ে দেবে। যুদ্ধ বিধবস্ত দেশের সেই সময় আর আজকের সময় এক নয়।
আজকের এই ডিজিটাল সময়ে বসা সেই এনালগ সময়ের সবকিছুর সহজ মূল্যায়ন করা যাবেনা। আর বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনকশা বাংলাদেশে তৈরি নয়। সবাই কী সহজে পচাত্তরের আগে পরের জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা স্বার্থ-দ্বন্দ্ব ভুলে যান!
আমেরিকা-চীন-সৌদি আরব সহ বিশ্ব মোড়লদের বিরোধিতা অবজ্ঞা করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর চীন-সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। হত্যার খবরের খুশিতে সাহায্য পাঠিয়েছে পাকিস্তান!
আর বাংলাদেশের পন্ডিতনমন্যরা দেশের অমুকের দোষ অমুকের দোষ এই ভাঙ্গা রেকর্ড এখন পর্যন্ত বাজিয়েই চলেছেন! আমি যখন ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বারের বাড়িতে প্রথম যাই, সবকিছু দেখেশুনে তখন আমি অবাক থমকে গিয়েছিলাম।
প্রথম ভাবনায় এসেছে এমন একটি অনিরাপদ বাড়িতে একজন রাষ্ট্রপতি কী করে ছিলেন বা থাকতেন! এখন সেখানে জাদুঘর গড়া উপলক্ষেও আশেপাশের কিছু বাড়ি সম্পত্তি কিনে বাড়িটিকে অনেক নিরাপদ করা হয়েছে।
কিন্তু ইতিহাসের রাখাল রাজা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কখনও নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেননি। প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি হবার আগে তিনি যেভাবে থাকতেন শেষ দিন পর্যন্ত সেভাবেই ছিলেন। লুঙ্গি গেঞ্জি পাঞ্জাবি পরা সাদামাটা এক মহান মানুষ!
তাঁর নিরাপত্তা দলের লোকজনের পরষ্পরের মধ্যে যোগাযোগের ওয়াকিটকি পর্যন্ত ছিলনা! এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা একবার বলেছিলেন, ‘স্যার আপনি পথে যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে নেমে যান।
আমরা সামনের গাড়ি পিছনের গাড়ির সিক্যুরিটির লোকজন তা ঠিকমতো জানিনা, যোগাযোগও করতে পারিনা। এরজন্য আমাদের সামনের-পিছনের সিক্যুরিটি টিমের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য অন্তত দুটি ওয়াকিটকি কিনে দেন’।
ওয়াকিটকির দাম শুনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার এসব লাগবেনা। আমার জন্যে এত টাকা দিয়ে ওয়াকিটকি কেনার দরকার নেই। আর আমাকে এখানে কে মারবে’। এখন রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা দেখভালের জন্যে স্বাভাবিক আলাদা বাহিনী আছে।
আপনার শুধু ল্যান্ডলাইন, মোবাইল ফোন নয়, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার-ভাইবার-হোয়াটসআপেও আড়িপাততে পারে এই রাষ্ট্র। এরজন্য বরাদ্দ ব্যয়ের পরিমানটিও বিশাল। বাংলাদেশের বিশেষ সংস্থা বিদেশে আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়েও কাজ করছে।
আমি যখন প্রথম টুঙ্গিপাড়া যাই তখন অবাক হয়ে ভেবেছি যার জন্যে দেশের হাজার হাজার মানুষের বাড়িঘর সহ নানাকিছু হয়েছে তাঁর বাড়ি-কবরে যাবার একটি ভালো রাস্তা নেই! কাজেই বঙ্গবন্ধুকে আজকের সময়ের চোখ দিয়ে দেখা হবে ভুল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার অপেক্ষাকে করে দেশ যেমন ঐক্যবদ্ধ অপেক্ষায় ছিল সেই ঐক্য ভাঙ্গতে শুরু করলো কোন তৎপরতায়? একপক্ষ তখন শুধু তাজউদ্দিনদের বিরুদ্ধে নয়, তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও ভুল তথ্য দেয়!
ঢালাও বলা হয়েছে অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে চুরি-ডাকাতি করছে! তাড়াতাড়ি তাদের হাত থেকে অস্ত্র সব সংগ্রহ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ফিরতে না ফিরতে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে এ রকম এক পাক্ষিক তথ্য কে-কারা দিয়েছে?
গ্রাম-জনপদের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে হতাশ কন্ঠে বলেছেন, এসব কথার সত্য-মিথ্যা যাচাই ছাড়াই তাদের সঙ্গে অপমানকর আচরন করা হয়। অস্ত্র জমা দেয়া নিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে হুমকি-বাড়াবাড়ির ঘটনা তাদের অনেককে হতাশ-ক্ষুদ্ধ করেছে।
পিতার কাছে একজন সন্তান হিসাবে বঙ্গবন্ধুর কাছে তারা চাইছিলেন একটু সম্মান করে কথা বলা। একটু মর্যাদা। পিতা এই মর্যাদা দেবার মানুষও ছিলেন। কৃষক-মজুরকে ইজ্জত দিয়ে কথা বলতে সবাইকে বলতেন পিতা।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের মনে হলো কারা যেন পিতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক শিথিল করে দিচ্ছে! মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগ ছিলেন বয়সে তরুন-ঘর পালানো ছেলে, স্কুল-কলেজের বেকবেঞ্চার।
দেশ স্বাধীন করার একটি পবিত্র সংকল্প নিয়ে তারা সেদিন যুদ্ধে গিয়েছিলেন। খুব মেধাবী-বাবা-মা’র অনুগতরা খুব বেশি যুদ্ধে যায়নি। কিছু ব্যতিক্রম হয়তো ছিল। যুদ্ধ থেকে ফিরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে কোন সনদও সংগ্রহ করেননি।
মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট এটা যে সংগ্রহ করতে হয় বা এটা সংগ্রহ করা লাগবে এটাও তাদের অনেকে জানতেননা। দেশ স্বাধীন হলে এটা-সেটা পাওয়া যাবে তা পেতে হবে এই ধারনায় তারাতো যুদ্ধেও যাননি।
কিছু পাবার আশায় অন্তত মরতে যুদ্ধে যাওয়া যায়না। যুদ্ধে থাকতে তাদের অনেককে স্বপ্নের একটি ধারনা দেয়া হয়। তাহলো দেশ স্বাধীন হবার পর নতুন দেশ গড়তে তাদেরকে ক্ষেতে-খামারে কাজে লাগানো হবে।
দেশ গড়তে এটাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ-দ্বিতীয় বিপ্লব বলেও ধারনা দেয়া হয়। কিন্তু দেশে ফেরার পর এমন কোন উদ্যোগ তারা দেখেননি। যুদ্ধ শেষে ফেরার পর বেকবেঞ্চার ঘরপালানো ছেলে মুক্তিযোদ্ধারাই হয়ে ওঠেন লোকাল হিরো।
এতে করে গ্রাম-গঞ্জ-পাড়া-মহল্লার পুরনো প্রভাবশালীদের প্রভাব হারানোর ভয় তাদের পেয়ে বসে। তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লাগেন। তাদের কাজে লাগানোর কোন উদ্যোগ ছাড়াই তড়িঘড়ি করে অস্ত্র জমা নেয়া হলো।
মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন-নিরস্ত্রকরনের কাজটি তখন যথেষ্ট চিন্তাভাবনা ছাড়াই হওয়াতে তাদের অনেককে আশপাশের সমাজের লোকজনের কাছে হঠাৎ করে নিজেদের গুরুত্বহীন- অপাক্তেয় মনে হয়।
আশেপাশের নানা পরিস্থিতি দেখেও তারা হতাশ হয়ে পড়েন। তারা দেখেন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে বা নাম ভাঙ্গিয়ে কিছু লোকজনের এটা-সেটা পাবার-নেবার দখলের প্রতিযোগিতা!
এমন অনেককে তারা অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখেন তারা মুক্তিযোদ্ধা কিনা তা নিয়ে তখনই তাদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের যারা জাসদে-সিরাজ শিকদারের দলে গেছেন তাদের নিয়ে বাংলাদেশে এখনও নির্মোহ গবেষনা হয়নি।
এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঢালাও দোষ দিয়ে গেছেন। একপক্ষ দেখেছেন যত নষ্টের মূল জাসদ আর সিরাজুল আলম খান! কিন্তু তালিতো আর এক হাতে বাজেনি। এই পক্ষ শেখ ফজলুল হক মনি আর মোশতাকগংদের কোন দোষ দেখেননি!
সস্ত্রীক জীবন দিয়ে শেখ মনি পরিবারকে এর মাশুলও দিতে হয়েছে। ঘাতকরা ধরে নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পর তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরী হতে পারেন শেখ ফজলুল হক মনি। এরজন্যে তাঁকেও তাঁরা হত্যা করে পথের কাঁটা সরাতে চেয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে তাজউদ্দিন আহমেদ নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে শেখ মনি সহ ছাত্র নেতাদের, মোশতাকগং এর সম্পর্ক ভালো ছিলোনা। আবার শেখ মনি আর মোশতাকগং আবার এক রাজনৈতিক চিন্তারও নন।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর তাজউদ্দিন বিরোধিতায় তারা এক হয়ে যান। আবার রাজনৈতিক কৌশল-কর্তৃ্ত্ব চিন্তায় সিরাজুল আলম খান-শেখ মনি চলে যান ভিন্নধারায়। অথবা কৌশলী খেলোয়াড়রা একপক্ষকে আরেকপক্ষের বিরুদ্ধে ঠেলে দেন।
তখন ছাত্রলীগের দুই অংশের পৃথক দুটি সম্মেলনেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি করা হয়। শেখ মনি তখন তাঁর অনুসারীদের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যান। তিনি সবার পিতা। কিন্তু মনি বিরোধীদের অভিযোগ, বঙ্গবন্ধু শুনলেন ভাগ্নের কথা!
বলা হয় বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন ছাত্রলীগের কোন অংশের সম্মেলনে না যেতেন সেদিন কী এই সংগঠনের ভাঙ্গন রক্ষা করা যেত? ছাত্রলীগ না ভাঙ্গলে কী সৃষ্টি হতো জাসদের? এসব ‘যদি’ নিয়ে এখন হা-হুতাশ কান্নাকাটি করে লাভ নেই।
আর আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও একজন মানুষ ছিলেন। দেবতা ছিলেননা। রাজনৈতিক জীবনের বড় অংশ তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। কারাগারে বসে বেগম মুজিব তাঁর পরামর্শ নিয়ে বিশাল এই দল চালিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ সহ সব সংগঠনে ছিল বেগম মুজিবের গ্রহনযোগ্য কর্তৃ্ত্ব। স্বাধীনতার আগে-পরের চিন্তা চেতনায় স্বার্থ-দ্বন্দ্বের ফারাক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। নতুন স্বাধীন দেশের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্ত জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত।
কিন্তু তিনিওতো একজন মানুষ নেতা, যিনি নেতা হিসাবে দলের ভিতর কখনও তাঁর বিরোধিতা দেখেননি। দলে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলেনওনা। তিনি সবার ছিলেন পিতা। কিন্তু অনেকের তখন মনে হচ্ছিল ভাগ্নে তাঁর ওপর প্রভাব খাটাচ্ছেন!
ইতিহাস কী বলবে সিরাজুল আলম খান-শেখ ফজলুল হক মনি সহ যুদ্ধফেরত মুজিববাহিনীর সংগঠক ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সেদিন আরও দায়িত্বশীল হলে ছাত্রলীগের ভাঙ্গন রক্ষা করা যেত! আবার সেই অতীত দিনের ‘নিস্ফলা যদি’ প্রসঙ্গ নিরর্থক।
কারন খন্দকার মোশতাক নামের এক ঠান্ডামাথার খুনিতো ঘরের ভিতরই ছিল। বড় এক বিষফোঁড়া। যুদ্ধের সময় আমেরিকা তাকে দিয়ে আপোসের কনফেডারেশন করানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এবার নতুন স্নেহে সক্রিয় মোশতাক।
হাঁসের মাংসের টিফিন ক্যারিয়ার হাতে প্রতারক মীরজাফর খুনি মোশতাক বঙ্গবন্ধুর প্রাণ বধ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। এই স্নেহছায়াতো তাকে জাসদ দেয়নি। রক্ষী বাহিনীর দৌড়ানিতে জাসদ তখন নাকাল। দেশ কেবলা পরিবর্তনের পথেও চলে যায়।
বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফরের আগে মস্কোপন্থী অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে পদত্যাগ করানো হয়। তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম সেই পদত্যাগপত্রের স্বাক্ষর যোগাড় করে আনেন।
হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে এমপিদের বৈঠকে দাওয়াত করা হয় সব এমপিকে। শুধু নাম কাটা ছিল ভাগ্যহীন তাজউদ্দিনের! মুক্তিযুদ্ধকালীন সন্নাসী প্রধানমন্ত্রীর কী পরিণতি! আর এই সুযোগে আরও আপারহ্যান্ডে মোশতাক!
এসবের সোজা-সাপ্টা জবাব, আত্মসমালোচনা ছাড়া সহজ পথটি হলো সবকিছুতে জাসদকে দোষারোপ করা। অথচ জাসদ কোন সফল দৃষ্টান্তের নাম নয়। বড়জোর একটি সময়ের প্রতিবাদের ব্যানারে এর নাম লিখে রাখা যায়।
জাসদ নেতারা তখন আওয়ামী লীগের মূলধারা থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে লাভবান হয়েছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। এতে করে বঙ্গবন্ধুর পর তাঁর একচ্ছত্র কর্তৃ্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এতে দিন শেষে ক্ষতি হয়েছে বঙ্গবন্ধুর। বাংলাদেশের।
ত্যাজ্য পুত্ররা বাবা’র সঙ্গে অভিমান থেকে রাজনৈতিক শত্রুতা করেছে। বাবাও রাজনৈতিক পুত্রদের চেয়ে ভাগ্নেকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে বসে মিটমাটের ব্যবস্থা কেউ করেনি। এমন উদ্যোগ তখন কেউ নিয়েছে তাও কেউ জানেনা।
আপদ সব বিদায় হওয়ায় খুশি খুশি শেখ মনি মতিঝিলে বিশাল ভবন সহ নানাকিছুর মালিক হন। বাংলার বানী-বাংলাদেশ টাইমস সহ নিজস্ব এক মিডিয়া জগত গড়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে। আর কোথাও কিছু না করে দোষ হয়েছে শেখ কামালের!
পিতৃজোর দেখিয়ে দলে বা সরকারের কোথাও নিজেদের প্রভাব বিস্তারের কখনও কোন চেষ্টাই করেননি বঙ্গবন্ধুর দুই সন্তান। অথচ শেখ কামালের বিরুদ্ধে ছড়ানো হলো ব্যাংক ডাকাতির মিথ্যা বানোয়াট গল্প!
বাংলাদেশের অনেক মানুষ এখন পর্যন্ত সেই গল্প বিশ্বাস করে! গল্পকারকে কেউ জিজ্ঞেসও করলোনা রাষ্ট্রপতির ছেলে চাইলেতো ব্যাংক বাড়িতে চলে যায়। পচাত্তরের হত্যাকান্ডের পর জানা গেল কিছুই নেই কামাল-জামাল বা এই পরিবারের।
আবাহনী ক্রীড়া চক্রের মতো খেলার দল-নাটকের দল ছাড়া আর কিছু নেই বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের। আর শেখ জামালতো কোথাও নেই। গোটা পরিবারের সঙ্গে প্রাণ দিয়েছেন তাদের নবপরিনীতা স্ত্রী দুইজন।
শেখ ফজলুল হক মনি’র উত্তরাধিকার শেখ সেলিম পরিবার এখন নানাজন নানান সম্পদ-দাপটের মালিক! রাজাকার মুসা বিন শমসের, ওমর ফারুক চৌধুরী থেকে শুরু করে আন্দালিব রহমান পার্থ সবাই তার আত্মীয়-পরিজন।
শেখ হাসিনার ১৯৯৬’র সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন শেখ সেলিম। ১/১১’র সময় তিনি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দিয়েছেন। এরপর আর তাকে মন্ত্রিসভায় নেয়া হয়নি। এখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক সারাদিন পাবলিকের গালি খান।
কিন্তু ওয়াকিফালরা জানেন এখনও নানাকিছুর নেপথ্যে শেখ সেলিমের দাপট! বঙ্গবন্ধু তাঁর আরেক ভাগ্নে শেখ শহীদকে বাকশালের ছাত্র শাখার সম্পাদক করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ব্যক্তিত্বহীন শেখ শহীদ আশ্রয় নেন এরশাদের পদতলে!
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য সেই ভাগ্নে ব্যক্তিত্বহীন শেখ শহীদ এখনও জাতীয় পার্টির একটি ক্ষুদ্র অংশের মহাসচিব। বঙ্গবন্ধুর নিজের সন্তানরা কোথাও কোন অন্যায় করেনি। এরকোন একটি উদাহরন নেই। তাঁর ভাগ্নেরা তাঁকে বিব্রত করেছেন। এখনও করছেন।
আর লোভী সন্তান সমদের পাপ তাপ ধারন করে যীশুর মতো প্রান দিয়েছেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শাহ মোয়াজ্জেম সহ যে সব তরুন মন্ত্রীদের বঙ্গবন্ধু বেশি স্নেহ করতেন তাদের নিয়েই সে ঘোট পাকিয়েছে খুনি।
বঙ্গবন্ধুর পর যদি শেখ মনি ক্ষমতার হাল ধরেন সেই চিন্তায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁকেও সরিয়ে দেয়া হয়। একই সঙ্গে একে একে টার্গেট হন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাই। শিশু রাসেলকেও বাঁচিয়ে রাখা হয়নি।
খুনিদের পনের আগষ্টের পুরো মিশন বিনা বাধায় সফল হয়। বত্রিশ নাম্বারের বাড়ির সিঁড়িতে পড়ে থাকলো ইতিহাসের রাখাল রাজার লাশ। বিশ্বাসঘাতক সন্তানরা তখন বঙ্গভবনের শপথের লাইনে। ভীরু বাকি সবগুলো পালিয়ে যায়।
পিতার লাশ দাফন বা একটা প্রতিবাদের কেউ কোন চেষ্টাই করেনি। জিয়া-এরশাদ-খালেদা মিলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সহায়তা দিয়েছে। চাকরি দিয়েছে বিদেশি দূতাবাসে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করতে দেয়নি।
এরশাদ বানিয়ে দিয়েছেন তাদের রাজনৈতিক দল ফ্রিডম পার্টি। খালেদা জিয়া খুনিদের বসিয়েছেন সংসদে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিচার আটকে দিয়েছেন। আর বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় ব্যর্থ আওয়ামী লীগাররা প্রতি পনের আগষ্ট উপলক্ষ্যে মুখে মেকি শোক শোক ভাব আনে!
আত্মপক্ষের নতুন নতুন শব্দচয়নে সাফল্য দেখান। আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতার ১২ বছরে এই দলের নামে অনেক উন্নত প্রজাতির দালাল তৈরি হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিষয়ে একজন স্কলারও তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্যে দরকার প্রতি বছর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যথাযথ গবেষনা করা নতুন প্রজন্মের নতুন নতুন স্কলার। কারন স্কলারদের সৃষ্টি থাকে। দালালদের কিছুই থাকেনা।