ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ ও তাদের অবদানের প্রতি সন্মান জানাতে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সিডনি বাঙ্গালী কমিউনিটির আয়োজনে পালিত হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। অস্ট্রেলিয়ায় বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের শিশু কিশোরদের মধ্যে মাতৃভাষা বাংলা শিক্ষা ও দেশীয় সংস্কৃতি প্রচলন রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় এই আয়োজনে। অনুষ্ঠানটির সার্বিক পরিচালনায় ছিলেন সেলিমা বেগম এবং পরিকল্পনায় ছিলেন অজয় দত্ত।
করোনা ভাইরাসের নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়াতে সরকারি বিধি মেনেই এই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয় সিডনির বারডিয়াতে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই সিডনির অন্যতম সংগঠক ও সমাজসেবক মোহাম্মদ শফিকুল আলম তার উদ্বোধনী বস্তব্যে বলেন,”সম্পূর্ণ ইংরেজি পরিবেশে অস্ট্রেলিয়ায় বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার এই মহান উদ্যোগের জন্য সিডনি বাঙ্গালী কমিউনিটির প্রশংসা করেন এবং বলেন মাতৃভাষা চর্চা না থাকলে মাতৃভাষা হারিয়ে যায় আর তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় শতাধিক আদিবাসীদের মাতৃভাষা আজ বিলুপ্ত। ”
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সেলিমা বেগম কার্যকরী কমিটির সকল সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন ও কৃতজ্ঞতা জানান প্রতিটি সদস্যকে তাদের মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে সংগঠনকে সিডনির একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। এছাড়াও তিনি প্রতিটি অভিভাবকের আন্তরিকতারও প্রশংসা করেন।
সংগঠনের সভাপতি অজয় দত্ত এই অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য প্রতিটি কিশোর সংঘের সদস্যদের মাসব্যাপী রিহার্সেল ও অধ্যবসায়কেই অন্যতম কারণ মনে করেন। তিনি আরো বলেন, এতো কঠিন কঠিন বাংলা শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ দিয়ে কবিতা , প্রবন্ধ পাঠ ও গান পরিবেশনা দেখে একবারও মনে হয়নি আমরা অস্ট্রেলিয়াতে আছি। বিশেষ ধন্যবাদ দেন সীমা আহমেদকে এই ক্ষুদে শিল্পীদেরকের গড়ে তুলার জন্য।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি সিরাজুল হক বলেন,” নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও চর্চা থাকলে অস্ট্রেলিয়ার বুকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সহায়ক হবে। ”
অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী আরেফিনা মিতা, নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বলেন, “অস্ট্রেলিয়ার মূল পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা করার মতোই মাতৃভাষা চর্চা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পারলে অবশ্যই তোমাদের সুন্দর করে বেড়ে উঠার পাশাপাশি মানসিক বিকাশের পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। তাই একটু সময় পেলেই মাতৃভাষার চর্চাটা চালিয়ে যেতে হবে। ”
বাংলা প্রসার কমিটির সভাপতি ড: রফিক তার বক্তব্যে বলেন, ছেলে মেয়েদের বাংলা ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। তিনি অস্ট্রেলিয়াতে হাই স্কুল লেবেলে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার ব্যপারে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলা শিক্ষার সাথে দীর্ঘদিন জড়িত থাকা মিলি ইসলাম সিডনী বাঙ্গালী কমিউনিটির সারা বছর ধরে বাংলা ভাষা এবং বাঙ্গালী চেতনা নিয়ে গঠনমূলক কাজের প্রসংশা করেন।
বিডিহাবের সভাপতি আবুল সরকার বলেন ‘আমরা এইবার সিডনি বিডিহাবে অনুষ্ঠানটি করতে দিতে পারিনি একটি জটিলতার জন্য তবে আগামীতে অবশ্যই এই জটিলতা কাটিয়ে উঠে আবারো নতুন উদ্যোগে এগিয়ে যাবো। ”
সাকিনা আক্তার বলেন, “সিডনি বাঙ্গালী কমিউনিটির জন্মলগ্ন থেকে আমি ছিলাম , এখনো আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকতে চাই। এই সংগঠনে ছোট ছেলে মেয়েদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে থাকতে পেরে সবসময় নিজেকে ধন্য মনে করি। ”
আসমা আলম কাশফী বলেন ,”এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর দুইটি চমৎকার অনুষ্ঠান পরিবেশনা দেখে আমি মুগ্ধ। আমি সিডনি বাঙ্গালী কমিউনিটির উত্তর উত্তর সাফল্য কামনা করি। ”
নৃত্য শিল্পী নুসরাত হুদা বলেন , ” আমি অতীতে সংগঠনের কিছু মেয়েদেরকে নাচের তালিম দিয়েছিলাম ,আবারো দিতে চাই।আজকে উপস্থিত অভিভাবকদেরকে বলছি এই সংঘঠনের যে কোনো মেয়ের জন্য আমি নাচ শিখাতে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবো। সুতরাং আমি আপনাদের পাশে আছি সবসময়। ”
নৃত্য শিল্পী অর্পিতা সোম চৌধুরী বলেন, ” আমি বরাবরের মতোই এবারো সিডনি বাঙ্গালী কমিউনিটির অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার চর্চায় আমি মুগ্ধ। আমাদের মেয়েদের পরীক্ষার কারণে এইবার নাচের দলটি নৃত্য পরিবেশনা করতে পারিনি, তবে শীগ্রই ফিরবে ওরা ।”
কমিউনিটির অতি পরিচিত মুখ, টেলিভিশন উপস্হাপিকা আবিদা আসওয়াদ বলেন, “সিডনি বাঙ্গালী কমিউনিটি ইনক্ এর আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অনুষ্ঠানে যুক্ত হতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছে। বাংলাদেশী আমেজে সুন্দর আয়োজনের ভুয়াসী প্রশংসা করেন আবিদা।
“বাঙ্গালী নারী” বুটিক হাউজের মালিক ওমরানা বলেন সিডনি বাঙ্গালী কমিউনিটি কেবল বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়েই কাজ করছে না, সংগঠনটি সিডনীতে দেশীয় ফ্যাশান এবং ডিজাইনকে উৎসাহিত করার জন্য ঈদ এক্সিভিশনের আয়োজন করছে যা কমিউনিটিতে ভীষন আলোচিত এবং জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সমাজ সেবক শারমীন সূচনা বলেন, “সিডনি বাঙ্গালী কমিউনিটি আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে স্বপরিবারে আসতে পছন্দ করেন কারন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি আয়োজনে থাকে দেশীয় আমেজ, বৈচিত্রময় সাজসজ্জা এবং উৎসব মুখর পরিবেশ।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, অস্ট্রেলিয়ার মহিলা বিষয়ক সম্পাদক বিলকিস জাহান সিডনীর সবাইকে একত্রিত হয়ে একটা প্লাটফর্মে কাজ করার আহবান জানান। তিনি বলেন বাংলাকে অস্ট্রেলিয়াতে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সমষ্ঠিগত কাজের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
অভিভাবকদের মধ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন মুগ্ধ রবি মলয় এবং শাম্মি আহমাদ।
ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে অস্ট্রেলিয়ায় বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্ম প্রথমে সমবেত কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ‘ গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করে। এর পর পর্যায়ক্রমে ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদদের নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ ,কবিতা আবৃত্তি , একক ও দলীয় সংগীত পরিবেশন করে এই নতুন প্রজন্মের শিশু কিশোরদের নিয়ে গড়ে উঠা দল ‘কিশোরসংঘ’। অনুষ্ঠানের শুরুতেই মহান ভাষা দিবস নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করে পুষ্পিতা লুবনা জাহান মিম এবং তাবীয়া জাহিন। তাবীয়া জাহিন এককভাবে একুশ নিয়ে একটি আবৃত্তি করে।
কিশোর সংঘের পরিচিতি পর্বে উপস্থাপনা একক গান ও কবিতায় অংশ নেয় আনুভা আহমাদ। আরও আবৃত্তিতে অংশ নেয় আরিবা ও জাফরি আহমাদ। এছাড়া একক গানে অংশ নেয় রায়া খান ও সেহরিশ সাইফ। সম্মিলিতভাবে কিশোর সংঘের অন্যান্য সদস্যদের সাথে কোরাস গানে অংশ নেয় আনুভা, মহিমা বিশ্বাস, রায়া, সেহরিশ, এরিকা, সুবাহ কবির, সাইফান কবির ও শেওতী ।
বড়দের মধ্যে রুমানা হক একটি কবিতা আবৃত্তি করেন।
সংগীত পরিচালনায় ছিলেন সীমা আহমেদ ,বাদ্যযন্ত্রে সহায়তা করেন সাকিনা আক্তার ও সংগীতে সহায়তা করেন নিলুফার ইয়াসমিন।
আপ্যায়নে সহায়তা করেন শারমিন সূচনা , ফাইজা কালাম রুবা , ফ্রেসিয়া ফারুক ও সুমী । মঞ্চ সজ্জায় সহায়তা করেন সুজন আদনান ও মাহবুবা ববি।
প্রচার এবং মিডিয়ার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন শাহে জামাল বাদল।
অনুষ্ঠানের সার্বিক শব্দ নিয়ন্ত্রণে ছিলেন বিশিষ্ঠ সংগীত শিল্পী আতিক হেলাল।
সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয়।