ফজলুল বারী : রুদ্র’র সংগে এই ছবিটা পোষ্ট করেছেন তসলিমা নাসরিন। ময়মনসিংহের ছবি। তসলিমা তখন ১৯। রুদ্র ২৫। আমরা প্রথম তসলিমাকে চিনি চিত্রালীর চিঠিপত্র বিভাগ ‘আপনাদের চিঠি পেলাম’এ। তসলিমা নাসরিন, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ’ পরিচয়ে তিনি চিঠি লিখতেন। এরপর বিচিত্রার ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনে তাকে নিয়ে বেশ হৈচৈ হয়।
ফেনীর একজন লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সব মেয়েরাই চরিত্রহীনা’। তসলিমা এর জবাবে লিখেন, ‘….সাহেব, এতদিনে আপনার একটা ভালো পরিচয় দিলেন, নিশ্চয় কোন চরিত্রহীনা মায়ের গর্ভ থেকে….’! প্রতি শব্দ ৫০ পয়সা হিসাবে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দিতে হতো বিচিত্রায়। এখন ফেসবুক আসায় সারাদিন ফ্রি কতকিছু লেখা যায়!
১৯৮৭/৮৮ সালে টিএসসিতে তসলিমা-রুদ্রকে দেখতাম। তখন তাদের সম্পর্কের শেষ সময়। একসংগে টিএসসিতে এলেও দু’জন দু’দিকে তাকিয়ে যারযার বন্ধুদের সংগে আড্ডা দিতেন। এরপর আসে নাইমুল ইসলাম খান, মিনার মাহমুদ যুগ। খবরের কাগজের লেখা নিয়ে আলোচনা বাড়লে এর জবাব দিতে পুর্বাভাসে হুমায়ুন আজাদকে দিয়ে ‘নারী’ লেখার আয়োজন করেন মোজামমেল বাবু।
খবরের কাগজের পেস্টিং শেষ করে প্রতি সপ্তাহে ময়মনসিংহ চলে যেতেন নাইমুল ইসলাম খান। সেখানে একটা হোটেলের একটি রুম, নিজস্ব কাপড় চোপড়, টুথপেস্ট, ব্রাস সব সেখানে থাকতো। নাইমুল ইসলাম খানের যুগে ঢাকায় ডাক্তার হিসাবে বদলি নিয়ে আসেন তসলিমা নাসরিন। এই সম্পর্ক ভেংগে গেলে জীবনে আসেন মিনার মাহমুদ।
মিনার মাহমুদকে বিয়ের পর পূর্বাভাসে ‘তসলিমা নাসরিন মরে গেছে’ শিরোনামে একটা লেখা তিনি লিখেন। এতে বলা হয় তিনি এখন মাগুর মাছের ঝোল রান্না করে স্বামীর অপেক্ষায় বসে থাকেন। মহসিন শাস্ত্রপানি এর জবাবে লিখেন ‘তসলিমা নাসরিনের অনিবার্য মৃত্যু’! শান্তিনগরে বাসায় তখন অনেক দুপুরে মিনার ভাইর সংগে আমি খেতে যেতাম।
এই সম্পর্ক ভেংগে গেলে আমেরিকা চলে যান মিনার মাহমুদ। আমান উদ দৌলা ভাই আমাদের প্রিয় প্রজন্মে লিখেন, ‘আমার এক বান্ধবী সম্প্রতি চতুর্থ স্বামী গ্রহন করেছেন।’তসলিমা আমাকে ফোন করে বলেন, ‘বদরুল আমার হাতের রান্না এই ঢাকা শহরে আপনার চেয়ে কে বেশি খেয়েছে বলেনতো। সেই আপনার পত্রিকায় আমান এ ধরনের কথা লিখলো!’আমি তখন তাকেও লিখতে অনুরোধ করি। তসলিমা লিখতে শুরু করেন, ‘আমার মেয়েবেলা’। প্রিয় প্রজন্ম বন্ধ হয়ে গেলে ‘আমার মেয়েবেলা’ কলকাতা থেকে বই আকারে বেরোয়।
তসলিমা নাসরিন যখন মোল্লাদের হুমকির মুখে আত্মগোপনে তখন তাকে দেশ থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে ডক্টর কামাল হোসেন, তাঁর মেয়ে সারা হোসেন, ডাক্তার জাফর উল্লাহ চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী শিরিন হক প্রশংসনীয় সহায়তা দিয়েছেন।
সারা বিশ্বে তসলিমা নাসরিন যখন আলোচিত তখন বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক লেখকরা তার উৎস বৃত্তান্ত খুঁজতে এসে আমাকে খুঁজে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতেন। আমি তাদেরকে যতোটা সম্ভব নির্মোহভাবে বলার চেষ্টা করেছি আমার দেখা তসলিমা নাসরিন। মিশরে নাগিব মাহফুজ আমাকে বলেছিলেন তিনি বাংলাদেশকে চেনেন তসলিমার কারনে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে কলকাতায় গেলে সেখানে অবস্থানরত একজন তার পক্ষে তদবিরের জন্য তসলিমাকে ফোন করে আমাকে ধরিয়ে দেন। বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে তখন তসলিমার সুপারিশ কাজে লাগতো। আমি ফোনে কথা বলতেই বিব্রতকর একটা অবস্থায় পড়ি। তসলিমা আমাকে চিনতেই পারছিলেননা! কোন ফজলুল বারী? আমি কি তাকে চিনি? আপনার সংগে আমার কি আগে কখনো কথা হয়েছে? কিন্তু ক্রমশ কথার মধ্যে ডুবে গেলেন তসলিমা নাসরিন। তখন তিনি আর ফোন ছাড়তেই চাইছিলেননা। তসলিমা নাসরিন সেই তদবিরটি করে দিয়েছিলেন।