আবু তারিক:এইতো ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট ভোর তিনটার দিকে আমার ফোনে দুইবার মিস কল ছিলো এবং একটা মেসেজও। মেসেজে লেখা ছিলো “My son died”.আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় কিছুক্ষনের মধ্যেই এবং মেসেজ দেখে মাথায় কোন কিছুই কাজ করছিলো না, এই মেসেজের মানে কি? আমি চিনি বারী ভাইয়ের দুইজন ছেলে একজন আমার ছোট ছেলেটার বয়সী আরেকজন ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করেছে। দুইটাই খুবই শান্ত এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী । তাছাড়া কয়েকঘন্টা আগেই বারী ভাই একটা লেখাও পাঠালো প্রায় রাত ১১:৪৫ এর দিকে, সেটা পাবলিশ করে ঘুমাতে গেলাম, কৈ ছেলেদের অসুস্থ্যতার কোন গল্পতো করেননি।
অনেক অস্থিরতা নিয়েই কল ব্যাক করলাম। ফোনটা ধরলেন এবং কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন অমর্ত্য নাই। এম্বুলেন্স এসেছে,প্যারামেডিস জানালো অমর্ত্য আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আর কথা বলতে পারলেন না। আমার মাথায় যেনো বজ্রপাত হলো। শুধু জানার চেষ্টা করলাম, অমর্ত্যর জানাজা ও অন্যান্য ব্যবস্থা কেমনে কি করা যায়। উনি বলেছেন ওরা তো অমর্ত্যর ফরেনসিক রিপোর্ট করবে আগে তারপরেই সব জানা যাবে।
২৫ আগস্ট বিকেলে বারী ভাই ও ভাবীর বাসায় গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম। বারী ভাই সারাদিন কারো সাথে একটা কথাও বলেননি, মাথায় কম্বল মোড়ে একটা বিছানায় শুয়ে কেঁদেছেন একা একা।.আমি যাবার পর কথা বলে বাহিরে হাঁটতে নিয়ে গেলাম আর শুনলাম ছেলেটা, গত রাতে তার প্ৰিয় খাবার “রোল কাবাব” কিনে খেয়েছিল রাতে আর সেটাই ছিল শেষ খাবার। এর পরে কম্পিউটার টেবিলে পড়ালেখা করছিলো।
কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটির পরে সন্ধ্যায় আমি ও বারী ভাই যখন বাসায় ফিরছিলাম, তখন রাস্তার পাশ থেকে কাউন্সিলের বিনটি বাসায় নিয়ে যাবার সময় বললেন, এই বিনটি গতরাতে অমর্ত্য রেখে গিয়েছিলো এবং বাসায় নিয়ে যাবার কাজটাও তারই করার কথা, কিন্তু ওতো আর আসতে পারবে না এই বিনটিকে বাসায় রাখার জন্য।
অমর্ত্য চলে গেলো আর পরিবর্তন আসতে থাকলো বারী ভাই, ভাবী ও তাঁদের ছোট ছেলেটার মধ্যে। অমর্ত্য ছিলো পরিবারের প্রাণ। নোবেল প্রাইজ পাওয়া অমর্ত্য সেন যখন বাংলাদেশে আসেন তখন বারী ভাই উনার একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। সেই অমর্ত্য সেনের নাম থেকে উনার ছেলের নাম রাখেন অমর্ত্য এবং ছেলেকে অর্থনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখাতেন বলেই অমর্ত্য সত্যি সত্যি অর্থনীতিতেই পড়ালেখা করছিলো সিডনির ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে।
বারী ভাই অমর্ত্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য গঠন করলেন অমর্ত্য ফাউন্ডেশন। বারী ভাই তার বেতন থেকে শুধু বাসা ভাড়া ও খাবারের টাকা রেখে বাকী সব টাকা এই ফাউন্ডেশনের জন্য খরচ করছেন দেশের গরিবদের সাহায্য করতে। বারী ভাই অনেক বড় মাপের একজন সাংবাদিক যাকে এক নামেই বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের সবাই চিনে অথচ কেউ জানেন না, উনার অস্ট্রেলিয়াতে কোন বাসা বাড়ি নেই, কোন দামী গাড়ি নেই কিংবা নেই কোন বিলাস বহুল জীবন। উনি খুবই কষ্টের একটা চাকুরী করে সংসার চালান। সাংবাদিকতা পেশা এবং নেশা যার রক্তে, অন্যায় দেখলে তার কলম থামানো খুবই কঠিন। জীবন মৃত্যুর পরোয়া করেননি কোনোদিন এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কারো সাথে আপোষ করেননি।
অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের শুরুতেই সেই শুভ নামে এক তরুণ বাংলাদেশ থেকে একদল নতুন প্রজন্মকে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন গরিব শিশুদের বই, পায়ের জুতা , প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাবার পানির জন্য টিউবঅয়েল বসানো, গরিব মহিলাদের জন্য কাপড় সরবরাহ, করোনার সময় অভাবগ্রস্ত মানুষের খাবার দেয়া।
আর এই সকল কাজের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে বারী ভাই সহ আমরা কয়েকজন ( নাদের সুলতানা নদী , আল্ফ়া আরজু )যুক্ত হই। পরে অস্ট্রেলিয়ার অনেকেই অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের পাশে দাঁড়ান।
এরই মধ্যে একটি মসজিদও তৈরী করে ফেলেছে অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের তাহবিল থেকে।
আজ অমর্ত্য ফাউন্ডেশনে সারা পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে অনেকেই যুক্ত হয়েছেন। শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন বারী ভাই অমর্ত্য ফাউন্ডেশন করে।আর দেশের গরিব মানুষকে সাহায্য করতে অনেকেই অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের পাশে।
অমর্ত্য শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে রকউড কবরস্থানে কিন্তু সে বেঁচে আছে বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার মানুষের মাঝে।