কাউসার খান: অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে মধ্যরাত। হঠাৎ সন্তানহারা এক পিতার গগণবিদারী চিৎকার।তাঁর ২১ বছরের সন্তান আর নেই। শোকে মুহ্যমান। নিরব-সুনসান, স্তব্ধ-অন্ধকার, গহীন-ভেঙেপড়া সেখান থেকে শুরু বর্তমানে বাংলাদশের অনেক সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের।
সমাজসেবা কিংবা দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো এমন উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশে হাজারো সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে। তবে সন্তান হারানোর শোক ভুলতে মানুষকে সাহায্য করার নজির হয়তো সাধারণ নয়। আবার সে সেবায় যদি থাকে ব্যতিক্রমী কার্যক্রমও। বাংলাদেশে আদিবাসীদের উন্নয়নে কাজ করা, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, মানসিক ভারসাম্যহীনদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, প্রতিবন্ধী যুবককে উপার্জনের ব্যবস্থা করা, চা বাগানের কর্মীদের জন্য জুতা কেনা দেয়া, বিবাহযোগ্য দরিদ্র পরিবারের বিয়ের খরচ জোগানো, রাস্তার বিড়াল-কুকুরের জন্য খাদ্যসামগ্রী প্রেরণ এমন আরও বহু কার্যক্রম পরিচালনা করছে অমর্ত্য ফাউন্ডেশন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এর নামে নাম হলেও সংগঠনটি তৌকির তাহসিন বারী এর ডাক নাম অমর্ত্যের নামে গড়ে তোলা হয়েছে।
অমর্ত্য অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রখ্যাত সাংবাদিক ফজলুল বারীর প্রথম ছেলে। গেল বছর ২৫ আগস্ট মাত্র ২১ বছর বয়সেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অমর্ত্য। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় চালু রয়েছে অমর্ত্য ফাউন্ডেশন। “নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে”, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এ দুটি লাইনকে মূলে রেখেই যাত্রা শুরু হয় অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের। মানুষের পাশে অমর্ত্য ফাউন্ডেশন যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আদিবাসীসহ দূর্বল জনগোষ্ঠির পক্ষে দাঁড়ানো, তাদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা, দেশের অভাবী পরিবারগুলোর সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, সক্ষম অথবা প্রতিবদ্বী যুবকদের কর্ম সংস্থানে সহায়তা করা, গরিব মানুষদের খাবারের পাশাপাশি কাপড় জুতো, বাচ্চাদের শিক্ষা উপকরন কিনে দেয়া, অমর্ত্য ফাউন্ডেশন এবং অন্যদের সহায়তায় তাকে একটি দোকান করে দেয়া হয়েছিল। গড়ে দেয়া হয়েছে পেঁপে আর আনারসের বাগান পাঁচশ টাকায় এক পরিবারের এক সপ্তাহের খাবার শ্লোগানে নিয়মিত খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কুলাউড়ায় উন্দাল, বরিশালে চালু করা হয় অমর্ত্য ফাউন্ডেশন কমিউনিটি পাকের ঘর। এরকম ঢাকা, ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালু রয়েছে বিনামূল্যে খাবার ঘর। গেল কোরবানির ঈদে ৭টি গ্রামে কোরবানি দেওয়া এবং মাংস বিতরণও করে সংগঠনটি। এছাড়া, ভোলায় একটা মসজিদ বানানো হচ্ছে। গ্রামবাসীরা মসজিদের নামকরণ করেছেন অমর্ত্য মসজিদ।
অমর্ত্যের মৃত্যুর সে শোক এখনও ছুঁয়ে আছে অমর্ত্যের মাকে। তাঁর সাথে কথা বলতে গিয়ে মনে হবে গত পরশুও অমর্ত্য ঘরেই ছিল। শোকের ধোঁয়াশা থেকে খানিক বেরিয়ে ভাঙা-কাঁপা গলায় কথা বললেন। ‘আমি কি বলব, আমি কোনো ভাষা খুঁজে পাই না। পুরাটা মাস ধরে, এই যে একটা বছর, আমি যে কিভাবে যাচ্ছি, আমিই জানি। খাইতে, বসতে, উঠতে প্রতিটা মুহুর্তে তাঁর ছবি ভাসতে থাকে আমার চোখের সামনে। আমার কানে আমার অমর্ত্যের কথা ছাড়া আর কিছু আসে না। আমি আসলে ট্রমার মধ্যে আছি। তাঁর কারণ, সে যখন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে তখন অমর্ত্য আমার কোলের মধ্যে ছিল। আমি কি করে ভুলব সে মুখ। আমি বুঝতে পারতেসিলাম না কি হইসে। আমি তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি, পানি দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিলাম। আর অমর্ত্য শুধু ছটফট করছিল, দম বেরিয়ে যাচ্ছিল, খিচুনি দিচ্ছিল। আমি কোনদিন চোখের সামনে কারো মৃত্যু দেখি নাই। প্রথম দেখলাম তাও আবার নিজের সন্তানের। আমি নামাজ পড়তে গেলে এ দৃশ্যই সামনে ভাসে। আমি নামাজ কয় রাকাত পড়েছি ভুলে যাই, আবার পড়ি। মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি নিজেই আর বেশি দিন বাঁচব না।’
অকালে সন্তানে হারানো এক মায়ের আহাজারি নিথর কর দেয় খানিক সময়ের জন্য। এই ছেলেহারা মাকে সান্ত্বনা দেবার কোনো শব্দ লেখা হয়নি কোনো অভিধানে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানতে চাওয়া হলো অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের শুরুর কথা। তিনি বললেন, ‘অমর্ত্য মারা যাবার পর ওর বাবাকে দেখলাম একদম নীরব হয়ে যেতে। সাধারণত মেয়েরা যেমন ভেঙ্গে পড়ে এমন ঘটনায়, পুরুষেরা কিছুটা নিজের মধ্যে রাখে সব কিছু। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম অমর্ত্যের বাবার অবস্থা। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে তাঁকে বললাম, অমর্ত্য কিছু টাকা-পয়সা রেখে গেছে। এগুলো দিয়েই শুরু করি। ওর নামে সদকায়ে জারিয়া শুরুর উদ্দেশ্যেই অমর্ত্য ফাউন্ডেশন শুরু করল ওর বাবা।
ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যয়নরত ছিল অমর্ত্য। অকালে চলে যাওয়া হস্যোজ্জ্বল চেহারার এ তরুণ প্রাণ আজ শায়িত রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহাসিক এবং সবচেয়ে বড় সমাধিস্থল রকউড কবরস্থানে। তাঁর কবরে খোদাই করা আছে বাংলাদেশের পতাকা। যার বাস পৃথিবীতে নয়, স্বর্গে – তাঁকে নাকি বলা হয় অমর্ত্য। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এর নোবেল বিজয়ের পরপরই জন্মগ্রহণ করেছিল বলে বাবা আদর করে তৌকিরকে অমর্ত্য বলেই ডাকতেন। তবে সে আদরের কোল খালি করে অকালেই চলে যাবে অমর্ত্য, এটা মেনে নেওয়া বুকফাটা কষ্টের। অমর্ত্যের চলে যাওয়ার শোক তাঁর পরিবার এখনও কাটিয়ে উঠতে পারে নি। প্রায়শই অমর্ত্যের কবরের পাশে বসে বিলাপ করতে দেখা যায় তাঁর বাবা-মাকে। উন্নত একটা দেশের এত সুসজ্জিত জরুরি সেবা গ্রহণেরও সময় পেল না অমর্ত্য – এ শোক যেন কুড়ে কুড়ে খায় তাঁদের অন্তর।
তবে ছেলের নামে করা এ সংগঠনের মাধ্যমে সমাজসেবায় অংশগ্রহণ নতুন নয় প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারীর। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এখন যা করছি, এগুলা আমি আগেও করতাম। এখন অমর্ত্যের নামে করছি। আমার ছেলেও মানুষের উপকার করতে খুব পছন্দ করত। সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা এটা অমর্ত্যেরই ইচ্ছা ছিল। আর ও খেতে খুব ভালোবাসত। তাই মানুষকে খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি সাধ্যমতো। আমার কাজে আমার বন্ধু-স্বজন অনেকেই আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি যেকোনো পর্যায় থেকেই সাহায্য করে। সকলে অমর্ত্যের জন্য দোয়া করবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকদিন হলো বাংলাদেশে যাওয়া হয় নাই। কারণ আমার কোনো সঞ্চয় নাই। প্রতি মাসে যা আয় আসে, তাঁর কিছুটা আমাদের জন্য রেখে প্রায় সবই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেই। এর মধ্যে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি ভোলায় একটা মসজিদ বানানো হচ্ছে। যদি সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায় তাহলে সে মসজিদের পাশেই মিলনায়তন তৈরি হবে। ডাক্তার বসবে নিয়ম করে। বিনামূল্যে ওষুধ আর চিকিৎসা দেওয়া হবে গ্রামের মানুষদের। তিনি আরো বলেন বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবগতভাবে দানশীল। পরিবারের কেউ মারা গেলে সে আরও উদারহস্তে দান করে। এমন দান আমাদের কার্যক্রম ও দেশের গরিব মানুষের অনেক উপকার বাড়াবে।’
সারাদেশে অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের পাঁচ শতাধিক সেচ্ছাসেবী কর্মরত রয়েছে। অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছে দেশে-বিদেশে। কেউ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দান করে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত সময় থেকে সমাজের কল্যাণে এগিয়ে এসে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশ থেকে নূরুল আজিম রনি এ নিয়ে বলেন, ‘প্রান্তিক দরিদ্র মানুষজনের পাশে দাঁড়াতে চাই আমরা সবাই। সবাই মিলে সবাইকে কাছে টেনে নিয়েই আমাদের পথচলা। এভাবে হয়তো অস্ট্রেলিয়ার সিডনির মাটিতে ঘুমিয়ে থাকা অমর্ত্যর প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়বে সারা বাংলাদেশের সবার মাঝে সবখানে।’ সংগঠনটির অর্থব্যবস্থাপনার দায়িত্বে কর্তব্যরত রয়েছেন ডা: শরফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ’৯০ দশকে ফজলুল বারী ভাই নিয়মিত একটি কলাম লিখতেন মানুষ মানুষের জন্য। লেখায় থাকত অসহায় দুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর গল্প। আমি পড়তাম আর ভাবতাম মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানুষ এখনো আছে। সেই থেকে বারীভাইয়ের সঙ্গে যুক্ত। অমর্ত্যের শোক আমাদের জানিয়ে গেছে এ জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। যেটুকু সময় পাওয়া যায়, মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই উত্তম। আমাদের একটু ত্যাগ হয়তো কারো জীবন বদলে দিতে পারে। আর সে সুযোগ পেয়েই কাজ করছি। কেউ যদি দান-অনুদান পাঠাতে চান তাহলে বিকাশ করতে পারেন এই নাম্বারে +৮৮০১৭২৭৩৪৭৩৪৫ অথবা ব্যাংকে পাঠাতে পারেনঃ শরফুদ্দিন আহমেদ। এসবি অ্যাকাউন্টঃ ০৩০০৩১০০৭৮৮৬, সুইফটঃ JAMUBDDH 053 ব্যাংকের নাম: যমুনা ব্যাংক লিমিটেড, শাখা: বনানী, ঢাকা’
সংগঠনটিতে সক্রিয় কাজ করছেন কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিও। এরমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে কাজ করছেন আবু তারিক, মেলবোর্ন থেকে নাদেরা নদী এবং ক্যানবেরা থেকে সক্রিয় আছেন আলফা আরজু। তাঁরা যে কথা বলেন তা হল, ‘অমর্ত্যের কথা আমরা এখনও ভুলতে পারি না। ওর চলে যাওয়ার খবরে সেদিন আমাদের সবার মনটা হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠেছিল। বারীভাই আমাদের আপনজনের চেয়েও বেশি। তাঁর গড়া অমর্ত্য ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে অনেক সমাজমূলক কাজ করছে। আমরা অনেকেই দেশের জন্য কিছু করতে চাই। সবসময় তা সম্ভব হয়ে উঠে না। আমাদের অনেক ইচ্ছাই পূরণ হচ্ছে এই অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের মধ্য দিয়ে। আমরা কাজ করছি, অন্যরাও যদি এগিয়ে আসে তাহলে অনেক বড় কিছু করা সম্ভব।’