মুরাদের বৌ পিটানোর তদন্ত করা যাবে কিনা এর অনুমতি দেবেন স্পিকার!

মুরাদের বৌ পিটানোর তদন্ত করা যাবে কিনা এর অনুমতি দেবেন স্পিকার!

ফজলুল বারী: মুরাদ হাসানের ঘটনার পর ঢাকার পত্রিকায় রিপোর্ট হয় অমুক দিন অমুক ফ্লাইটে তিনি কানাডার টরেন্টো চলে যাচ্ছেন। যেহেতু এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট,  তাই ট্রানজিট দুবাই। ঢাকায় ফোন করে জানতে চাইলাম বিমান বন্দরে তাকে আটকানো হবে কিনা। জবাব পাই, ‘না’।

এর আগে মন্ত্রিত্ব গেলেও মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়নি। মামলার কিছু আবেদন হলেও তা গ্রহন করা হয়নি। বাংলাদেশে কেউ সরকারি দলের নেতা-এমপি হলে এমন সুবিধা পান। স্বরাষ্ট্র  মন্ত্রণালয়ের ওহী ছাড়া নিম্ন আদালতের বিচারকরা কোন মামলা নেননা। তারাও চাকরিকে ভালোবাসেন।

ঢাকা থেকে আমার সোর্সগুলো বলার চেষ্টা করে,  এ পরিস্থিতিতে মুরাদ হাসান কিছুদিনের জন্যে বিদেশে চলে গেলে মিডিয়ার আড়াল হলেই সরকার বাঁচে! কারন তখনও অনলাইনে ভাসছে মুরাদ হাসান আর চিত্রনায়ক ইমন-নায়িকা মাহীর ফাঁস হওয়া ফোনালাপ!

বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে মুরব্বি শ্রেনীর বড়রা ছোটদের সামনে অথবা ছোটরা বড়দের সামনে এমন কথাবার্তা বা অডিও-ভিডিও শুনে-দেখে অভ্যস্ত নন। ব্যক্তিগতভাবে অথবা বন্ধুদের সঙ্গে এমন কিছু নিয়ে আলাপ অনেকে করতে পারেন। মুরাদ হাসান আবার এমপি, ছিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিডিয়াকে বলেন বিদেশ যেতে মুরাদ হাসানকে বাধা দেয়া হবেনা। এক্ষেত্রে মুরাদ হাসান বিএনপির এমপি বা গুরুত্বপূর্ণ কেউ হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়তো এমন কথা বলতেননা। মুরাদ হাসান ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে যাবার সময় দিয়ে গেলেন মাথা নীচু করে হেঁটে চলার একটি ছবি।

এরপর প্রায় চব্বিশ ঘন্টা পর মুরাদ হাসানের নতুন নিউজ আসতে থাকে কানাডা থেকে। তাহলো কানাডায় তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। সে দেশের বর্ডার ইন্টেলিজেন্সের লোকজন দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে দুবাইগামী একটি বিমানে তুলে দেয় তথা তাকে ডিপোর্ট করা হয়েছে।

একদল প্রবাসী বাংলাদেশী, যারা একই সঙ্গে কানাডারও দ্বৈত নাগরিক, তারা মুরাদ হাসানের ফিরিস্তি লিখে কানাডার বর্ডার ইমিগ্রেশনকে ই-মেইল পাঠান। তখন অনলাইনে বাংলা-ইংরেজিতে মুরাদ হাসানকে নিয়ে ফিরিস্তির রিপোর্ট অডিও-ভিডিও’র কমতি ছিলোনা।

ই-মেইলের সঙ্গে তারা এসবের একগাদা লিংকও সংযু্কত করে দেন। কানাডার মতো দেশ এমন ই-মেইলকে গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেয়। কে মন্ত্রী বা সাবেক মন্ত্রী এসব গুরুত্ব দিয়ে দেখেনা। বাংলাদেশ হাইকমিশনের বক্তব্য অনুসারে সাধারনত এসব বিষয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

মুরাদ সাবেক প্রতিমন্ত্রী অথবা নারী সম্পর্কিত অকল্পনীয় ভালগার ফোনালাপ দেখে শুনে কানাডার বর্ডার সিক্যুরিটি ফোর্স হয়তো এবার বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়াই তারা তাকে দুবাইগামী একটি ফ্লাইটে তুলে দিয়েছে। এসব যাচাই-বাছাইর সময় তারা বাংলাভাষী দোভাষীরও সহায়তা নেয়।

কিন্তু মুরাদ হাসানের পাসপোর্টে আরব আমিরাতের ভিসা নেয়া ছিলোনা। দুবাই বিমান বন্দরে অনেক সময় হোটেল বুকিং দেখিয়ে একজন পর্যটক ভিসা পেয়ে যান। মুরাদ হাসানের সঙ্গে আবার কূটনৈতিক লাল পাসপোর্ট ছিল। কিন্তু এবার টরেন্টো থেকে তিনি একজন ডিপোর্টেড যাত্রী হিসাবে দুবাই এসেছেন।

তাকে যখন সেই ফ্লাইটে তুলে দেয়া হয়,  ফ্লাইটটি রওয়ানার আগেই তার ব্যাপারে টরেন্টোর পুলিশ রিপোর্টের তথ্য দুবাই পৌঁছে গিয়েছিল। মুরাদ হাসান তাই চেষ্টা করেও আরব আমিরাতের ভিসা পাননি। অতএব দুই দেশে প্রত্যাখ্যাত সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রীকে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও দেশে ফিরে আসতে হয়।

সাবেক তথ্যমন্ত্রী মুরাদ হাসান তখনও মিডিয়া রিপোর্টিং’য়েই ছিলেন। বিষয়টি সরকারি দলের জন্য আরও বিব্রতকর হয়। এমনিতে বিশেষ একটি ফোনালাপ ফাঁস হবার পর তার মন্ত্রিত্ব গেছে। এরপর আবার কানাডা-আরব আমিরাতের মতো দুটি দেশে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাকে ফিরে আসতে হয়েছে!

বিএনপি সহ বিরোধীদলের নেতারা এর সুযোগ ছেড়ে কথা বলেননি। ‘সকাল বেলার আমীর যে ফকির সন্ধ্যাবেলা’, সাবেক তথ্যমন্ত্রী দেশে ফিরে স্বদেশী পাপ্পারাজ্জিদের কাছ থেকে বাঁচতে বিমান বন্দরের ভিতরে বসে থেকে দেরি করেন! এরপর  অভ্যন্তরীন বিমান বন্দর দিয়ে বেরিয়ে গেছেন।

কিন্তু এখন যে স্মার্ট ফোনের যুগ। ছবি তার মিস হয়নি।  বিমান বন্দরের ভিতরে থাকা লোকজন ছবিগুলো তোলেন। এবার ছাই রঙের হুডিতে মাথা ঢেকে মাস্কে মুখ ঢাকা তার এ যাত্রার নতুন ছবিও  ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই ছবিই পরে দেশের প্রিন্ট-ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রকাশ-প্রদর্শিত হয়েছে।

মুরাদ হাসান আবার মিডিয়ায় এসেছেন বৌ পিটানোর অভিযোগে! তাঁর চিকিৎসক স্ত্রী ৯৯৯’এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা চান। পুলিশ তাঁর অভিযোগ আমলে নিয়ে জিডি নথিভূক্ত করলেও তদন্তে রাজি নয়! একবার বলে তদন্ত করতে আদালতের অনুমতি লাগবে, আরেকবার বলে অনুমতি লাগবে স্পিকারের!

এর মানে দাঁড়ায় এখনও মুরাদ হাসানকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত বা ওহী পুলিশের কাছে নেই! তেমন সিদ্ধান্ত বা ওহী থাকলে পুলিশ বা র‍্যাব কোন একটি পক্ষ এতোক্ষনের মুরাদ হাসানকে গ্রেফতার করে মদের বোতল উদ্ধার দেখাতো! পঞ্চাশ বছর বয়সী বাংলাদেশে আজও সব মানুষের আইনী সহায়তা পাবার বিষয়টি  নিশ্চিত হলোনা!

সভ্য দেশগুলোতে ফ্যামিলি ভায়োলেন্স অথবা পারিবারিক সন্ত্রাসের বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। এমন ফোন পেলে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। অভিযোগকারিনী যদি স্ত্রী বা পরিবারের কোন নারী সদস্য হন, তাহলে পুলিশ সবার আগে স্বামী বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়।

স্বামী এমপি না মন্ত্রী বা গুরুত্ব দিয়ে তা দেখেনা। এমন ঘটনায় আটক ব্যক্তি মন্ত্রী হলে তিনি নিজেই পদত্যাগ করেন। অভিযোগের ধরনের ওপর ভিত্তি করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আটক ব্যক্তিকে থানা থেকেই জামিন দিয়ে আদালতে হাজিরদের দিন তারিখ জানিয়ে দেয়া হয়।

অভিযোগ-মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী এক বাড়িতে বা এক ছাদের নীচে বসবাস করতে পারেননা। অভিযোগকারিনীর নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যেতে পারেননা স্বামী বা যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। নারীর নিরাপত্তা এভাবে নিশ্চিত করে সভ্য দেশের আইন-পুলিশ।

বাংলাদেশের পুলিশ আলীমুদ্দিন-জমিরুদ্দিনকে গ্রেফতারের সময় আদালত বা কারো নির্দেশের অপেক্ষা করেনা। মুরাদ হাসানের চিকিৎসক স্ত্রীও এখানে তাদের কাছে মূখ্য নয়! এসব খবরও বিদেশে যায়। বিদেশে বাংলাদেশিদের নানান মামলায় এসবের তথ্য উপাত্ত ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশের নেতারা তখন এসবে ষড়যন্ত্র খোঁজেন! তবু দেশের আইনের শাসনের উন্নতিতে তারা রাজি নন! মুরাদ হাসানও আলোচনায় থাকবেন। কারন বাংলাদেশের নারী-গৃহবধূদের সিংহভাগ ক্ষেত্রে সংসার রক্ষায় এসব ঘটনা চেপে যান। থানা পুলিশ পর্যন্ত যাননা।

মুরাদ হাসানের স্ত্রী ডাঃ জাহানারা এহসানের সম্ভবত সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছিল।