ফজলুল বারী: কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে দেশে নতুন একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। দেশের আগামী সাধারন নির্বাচন হবে এই নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখতে চায়। বিএনপির এমন নির্বাচনে আগ্রহ-লাভ কোনটাই নেই।
খালেদা জিয়া অসুস্থ এবং সাজাপ্রাপ্ত হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুপোযুক্ত। তাঁর পারিবারিক রাজনীতির উত্তরাধিকার তারেক রহমানও সাজাপ্রাপ্ত হিসাবে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিদেশে পলাতক ও অনুপোযুক্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
বিলাতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের স্বার্থে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট সমর্পন করেছেন তারেক রহমান। বাংলাদেশের আইনে সম্ভবত এমন ব্যক্তিদের রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকতে বাধা নেই। তেমন বাধা থাকলে সরকার নিশ্চয় এতদিনে বিষয়টি নিয়ে আদালতে যেতো।
হোয়াটসআপে, স্কাইপেতে ভিডিওকলে লন্ডন থেকে এখন পরিচালিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। তারেককে নিয়ে ইতোমধ্যে লন্ডনে আইন শৃংখলা সম্পর্কিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় ০সেখানে তার চলাচলও নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের একটি দলও সেখানে তাকে অনুসরন করেন।
সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই বিএনপি নিরুৎসাহ দেখিয়েছে। রাষ্ট্রপতির সংলাপেও তারা যায়নি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে যে শুদ্ধ নির্বাচন কমিশন করেছে তাও নয়। বিচারপতি আজিজের মতো কথাবার্তায় অসুস্থ টাইপের সিইসিও তারা বানিয়েছে।
বিএনপি বলেছে সরকারের পতন ঘটিয়ে তারা নির্বাচন করবে। কিন্তু সে সামর্থ্য যে এই বিএনপির নেই তা দেশের মানুষ জানেন। সর্বশেষ বিএনপি খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবিতেও একটি অসফল আন্দোলন করেছে। দেশের মানুষকে প্রতিদিন বলা হচ্ছিল ‘খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত।
দেশে তাঁর কোন চিকিৎসা নেই। তাই চিকিৎসার অভাবে যে কোন দিন খালেদা জিয়ার মৃত্যু ঘটতে পারে। এমন কিছু ঘটলে দায়ী হবে সরকার। এই অপরাধে শেখ হাসিনাকে হুকুমের আসামী করা হবে’ইত্যাদি। কিন্তু অবশেষে দেশের মানুষ দেখলো দেশের চিকিৎসায় খালেদা জিয়া বাসায় ফিরেছেন।
কানাডা থেকে জোগাড় করা দুই বছরের পুরনো একটি পুরস্কার মির্জা ফখরুল খালেদা জিয়াকে হাতে তুলে দিতে বাসায় গেলে যে ছবি প্রকাশ করা হয়েছে সেটিও বিএনপির দাবিকে দূর্বল করেছে। ছবিতে ৭৬ বছর বয়সী সাজুগুজু সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বেশ সপ্রতিভ মনে হয়েছে।
একদম অসুস্থ মনে হয়নি। অনেকদিন ধরে বিএনপির কোন নেতার বক্তব্যেও খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কথা নেই। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে বিএনপির আন্দোলনও নতুন নয়। সুপ্রিমকোর্টে একবার খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদনের শুনানি নিয়ে বিএনপির আইনজীবীরা বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন।
তখন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন অমুক দিন জামিনের আবেদনের শুনানি হবে। ‘এর আগে যদি খালেদা জিয়ার কিছু হয়ে যায়’ এই চিৎকারে বিএনপির আইনজীবীরা আপীল বিভাগে বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। পরে অবশ্য শাস্তির ভয়ে তারা ক্ষান্ত হন।
সুপ্রিমকোর্টও চিকিৎসা ইস্যুতে খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়নি। বিএনপির চেয়ারপার্সন এখন গুলশানের বাসা ফিরোজায় আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুকম্পায়। খালেদা জিয়ার পরিবারের অনুরোধে দন্ড স্থগিত রেখে বাসায় থেকে পছন্দের হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হয়।
দন্ড স্থগিতের মেয়াদ ফুরোলে পরিবার আবার মেয়াদ বাড়াবার আবেদন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন আবার সে মেয়াদ বাড়ান। মোশতাক ও এরশাদ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এখন বিএনপি নেতা শাহ মোয়াজ্জেম একবার এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে পরে ক্ষমা চেয়েছেন।
বিএনপির দাবিকৃত ‘অবৈধ সরকার’, ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’ এভাবে বারবার দন্ড স্থগিত রেখে খালেদা জিয়াকে বাসায় থেকে চিকিৎসার সুযোগ দিচ্ছেন। এর আগে জেলখানায় নজিরবিহীন ভাবে তাঁর সঙ্গে গৃহপরিচারিকা ফাতেমাকে থাকার সুযোগ দেয়া হয়।
এসব নানান কারনে খালেদা জিয়ার সেই আপোষহীন ভাবমূর্তিও আর নেই। এই বিএনপি আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম, এটা বিশ্বাস করার লোকজনও দেশে এখন কম। প্রশাসন-বিচার বিভাগকে দলীয়করন করে তাদেরকে দমিয়ে রাখার অভিযোগ করে বিএনপি। কথা অসত্য নয়।
আবার প্রশাসন-বিচার বিভাগ সবকিছুকে দলীয়করন করেই একুশ বছর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছে। যার নামে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-খালেদা আমলে বাংলাদেশের বেতার-টিভিতেও নিষিদ্ধ ছিলেন।
এত পাপ বিএনপির আপাদমস্তকে। এখনও তাদের চলেছে প্রায়শ্চিত্ত কাল। এখন বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইলে সরকারও বসে থাকবে সেটা ভাবার কোন কারন নেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুটোই রাজনৈতিক দল। এর একটাও কোন সেবা সংস্থা নয়।
এখন আন্দোলন গড়তে না পারলে নির্বাচনের বাইরে থেকে কি করবে বিএনপি? বিএনপি নির্বাচনে আসুক বা নির্বাচনে এলেও শেষ পর্যন্ত থাকুক, এটা কি আওয়ামী লীগ চায়? এটা বিশ্বাস করার মতো বিশ্বাসী মানুষও দেশে কম আছেন।
অনেকে মনে করেন বিএনপি নির্বাচনে না এলেও রেজা কিবরিয়া-নুরুর দলটি নির্বাচনে আসতে পারে। কিন্তু এই দলটিও কোন সাড়া ফেলতে পারেনি। বাংলাদেশের রাজনীতিকে আওয়ামী লীগ-এন্টি আওয়ামী লীগ এই দুই ধারায় বিভক্ত বলা হয়। এন্টি আওয়ামী লীগ ধারার রাজনীতির এখনও মূলধারা বিএনপি।
কিন্তু দুই যুগের বেশি ক্ষমতার বাইরে থেকে দলটি হতশ্রী। সাজাপ্রাপ্ত খালেদা-তারেকের নেতৃত্বের পক্ষে দেশের আমজনতা মাঠে নামছেননা। দেশের মানুষ নানা কারনে সরকার দলীয় লোকজনের ওপর বিরক্ত। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিকল্প তারা তারেক রহমানকে ভাবতে পারেননা।
এই সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম প্রকাশের পর বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্য নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী দাবি করে বলেন ‘সিইসি হিসাবে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম তিনি প্রস্তাব করেছিলেন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল ভালো লোক। সবাই যাতে তাকে সহায়তা করেন’। তাঁর এই বক্তব্যের চটেপাঘাত এসেছে বিএনপির তরফে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন ‘ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির কেউ নন’। ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিএনপির তারেক রহমানের ক্ষোভ অন্য কারনে।
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিভিন্ন সময়ে তারেক রহমানকে সরিয়ে তার মেয়ে জাইমাকে নেতৃত্বে আনতে বলেছেন। কাজেই ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্য তারেক রহমানের ক্ষোভের কথাগুলো হিজ মাস্টার্স ভয়েস মির্জা ফখরুলের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে।
নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রতিদিন অনেক কথা বলছেন। খুশিতে অথবা নতুন দায়িত্বের কারনে তিনি এসব বলতে পারেন। কিন্তু তিনি কথা একটু বেশি বলে ফেলছেন কিনা সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।