ফজলুল বারী: আজ ১৭ মার্চ। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন পিতা। আজকের দিনে তোমাকে অভিবাদন। কারন তোমার ত্যাগী নেতৃত্বের কারনে আমরা এই স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। দেশে-বিদেশে আমরা তাই মাথা উঁচু করে চলা বাংলাদেশের বাঙালি।
আজ কিছু কঠিন কথা লিখবো প্রিয় জাতির পিতা। কারন তোমার স্বপ্নের মতো করে এই বাংলাদেশ চলছেনা। বাংলাদেশ স্বাধীন হবারও আগে কারাগারে তৎকালীন বামপন্থী তরুন ছাত্রনেতা রনেশ মৈত্রকে তুমি বলেছিলে, তোমার নানান লোকজন নানান সেক্টরে কাজ করছে। আমরাও তা জানি।
তখন ছাত্র আন্দোলন ছাত্র নেতৃত্ব ছিল দেশের অগ্রসর রাজনৈতিক শক্তি। শ্রমিকরাও সংগঠিত ছিল। তাজউদ্দিনদের মতো একটি নিবেদতপ্রান টিম কাজ করছিল। সেখানে ছিল খন্দকার মোশতাকের মতো ষড়যন্ত্রীরাও। কিন্তু স্বাধীকার আন্দোলনের সবকিছু চলছিল তোমার নামে ও নেতৃত্বে।
স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকরাও তাদের এক নম্বর শত্রু অথবা প্রতিপক্ষ হিসাবে তোমাকে চিনতো জানতো। এরজন্য বারবার গ্রেফতার আর জেল জীবন তার প্রায় নিত্যসঙ্গী ছিল। তোমার অবর্তমানে আমাদের প্রিয় বঙ্গমাতা বেগম মুজিব হয়ে যেতেন আওয়ামী লীগের অঘোষিত নেত্রী-ছায়া নেত্রী।
তিনি জেলখানায় দেখা করতে গিয়ে তোমার নানান নির্দেশনা নিয়ে আসতেন। এখন তোমাকে অনাবশ্যক বড় বানাতে গিয়ে অন্য সবাইকে অস্বীকার করার একটি প্রবনতা শুরু হয়েছে! যেন তোমার আর কেউ কোথাও ছিলোনা! যেন আর কেউ কিছু করেওনি বা ভাবেওনি!
এটা আদতে তোমাকে কিন্তু ছোট করছে। একটা দেশের স্বাধীনতার জন্যে কিছু কুলাঙ্গার বাদে সবাই কাজ করেছে। এবং সবকিছু হয়েছে তোমার নামে। তুমিই সেখানে মূল নেতা। মহীরুহ। এরজন্যে মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান হয়েছিল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
মুক্তিযোদ্ধারা শপথ বাক্য উচ্চারনের পর গগনবিদারী উচ্চারনে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলতো। অপারেশনে যাবার আগে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে যাত্রা শুরু করতো। অপারেশন থেকে ফিরে বলতো জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরও মানুষ বিজয়ের আনন্দে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলতে বলতে রাস্তায় নেমে এসেছিল। সেদিন যারা বিজয় উল্লাস করতে রাস্তায় নেমে আসেনি তারা মূলত ছিল রাজাকার। তুমি জাতির পিতা পাকিস্তানের কারাগার থেকে না ফেরা পর্যন্ত কিন্তু আমাদের বিজয় সম্পূর্ণ হয়নি।
মহামানবের আগমনের সেদিনও পুরনো বিমান বন্দর থেকে শুরু করে রেসকোর্স ময়দান সবখানে আকাশে বাতাসে ছিল একটাই বিজয় ধ্বনি, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। যে মুক্তিযোদ্ধা আজ আর জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলেনা সে-তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-গন্ধ বিচ্যুত হতভাগ্য।
তাদের কারনে তুমি কখনো ছোট হওনি। একটা জাতির পিতা কখনো ছোট হয়না। সবাইকে নিয়েই জাতির পিতা শুধুই বড় মহীরুহ হয়। জাতির পিতা, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানকে যারা মানেনা, শ্রদ্ধা করেনা তারাই শুধু হয় ছোট। আবার তোমার অনুসারীদের অবদানকে অস্বীকার করতে গিয়ে তোমাকেই ছোট করা হচ্ছে। কারন তাদের নিয়েইতো তুমি বড়।
তোমার কালজয়ী বক্তৃতাগুলো পচাত্তরে তোমাকে হত্যার পর থেকে বেতার-টিভিতে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। খালেদা জিয়ার ক্ষমতার সময় পর্যন্ত এসব নিষিদ্ধ ছিল। এখন এই বক্তৃতাগুলো আমরা অবাক হয়ে শুনি। এসব বক্তৃতার প্রতিটি বোধ-বক্তব্যে স্পষ্ট দেশের প্রতি মানুষের প্রতি তোমার ভালোবাসা।
‘কার টাকায় আমরা এমপি সাব, মন্ত্রী সাব, অফিসার সাব, ডাক্তার সাব, ইঞ্জিনীয়ার সাব, কার টাকায় আমাদের এসব গাড়ি চড়ি, এসব তাদের টাকায়, তারা আমার দেশের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ। তাদের সম্মান দিয়ে কথা বলেন, ইজ্জত দিয়ে কথা বলেন। তারাই দেশের মালিক’।
বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আজ কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ দূরে থাক, কোন মানুষেরই ইজ্জত-সম্মান নেই। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতি-কালোবাজারি-মজুতদারির বিরুদ্ধে কথা বলেন। এরা সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। এরা সবাই মিলে আওয়ামী লীগকে একুশ বছর রাস্তায় রাস্তায় রেখেছে।
এখনও দেশের বেশিরভাগ অফিসে ঘুষ ছাড়া কোন কাজ-চাকরি হয়না। এখনও অনেকে সরকারি চাকরি পেয়ে গেলে নিজেদের মনিব মনে করেন। শেখ হাসিনা এবার ক্ষমতায় এসে অনেক বেশি নারী কর্মকর্তার পদায়ন করেছেন। কিন্তু গত করোনার সময়ে এদের অনেককে দেশের মানুষ নিষ্ঠুর চেহারায় দেখেছেন!
দেশের সিনিয়র সিটিজেন শ্রমজীবী বৃ্দ্ধ ব্যক্তিদের নারী কর্মকর্তার মাধ্যমে কান ধরে উঠবস করানোর ছবি ভাইরাল হয়েছে। রিপোর্ট পছন্দ না হওয়াতে মধ্যরাতে সাংবাদিককে মারধর করে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ভূয়া সাজানো মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এসব ঘটনার সময় বারবার মনে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর কথা। বঙ্গবন্ধু এই বাংলাদেশে চেয়েছিলেন কি? তাঁর স্বপ্নের দেশে এখনও চলছেটা কি! স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও এই হয়েছে সেই হয়েছের দেশে আজ মানুষ দেখছে যেন কিছুই হয়নি! হয়েছেতো অনেক কিছু। কিন্তু মানুষ যদি শান্তিতে না থাকে এসব কার জন্যে?
টিসিবির গাড়িকে কেন্দ্র করে ক্ষুধার অন্নের জন্যে মানুষের দূঃখ-কষ্ট-আহাজারি দেখলে বঙ্গবন্ধু কাঁদতেন। রাজনীতিবিদদের গেট-আউট করে দিয়ে আমলা এখন মহাশক্তিশালী। কিন্তু এই শক্তিধররা করছেনটা কী? আজ পর্যন্ত দেশটা যেন সঠিক পরিকল্পনাহীন।
ছয়মাস পর দেশের কোনটা কি পরিমান দরকার সেটা জেনে বুঝে পরিকল্পনা-বুঝলে দেশের এ অবস্থা হয়না। ৫০ বছর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শক্ত উচ্চারনে কালোবাজারি-মুজতদারির বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠে বক্তব্য রাখতেন। দেশে আজ তাদের বিরুদ্ধে কোন উচ্চকন্ঠই নেই!
দেশ এখনও অসৎ মুনাফাখোরদের হাতে জিম্মি বন্দী! তারাই সংসদ সদস্য-মন্ত্রী! একেকবার একেকটি ধুয়া তুলে মানুষের পকেট থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা কেটে নেবার পর যেন সরকার তৎপর হয়। প্রধানমন্ত্রী কিছু গুচ্ছ নির্দেশ দেন। কিন্তু ততোক্ষনে দেশের মানুষ আরও ফতুর!
মন্ত্রী ভিক্ষুক চোখেনা। কিভাবে দেখবেন। দেশে যে এখন মধ্যবিত্ত ভিক্ষুক বেশি। যারা বাইরে এসে হাত পাততে পারেনা। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর বিড়বিড় করে তাকে অভিশম্পাত করতে পারে। গালি দিতে পারে। ‘জীবন যাদের নিত্য পরিহাস’।
বঙ্গবন্ধু একটি ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাংলাদেশ এখন আর আচরনে চেহারায় কোন ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ নয়। বাংলাদেশের হিন্দুরা-বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুরা বঙ্গবন্ধুকে দেখে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। বঙ্গবন্ধুকে দেখেই তারা ভারতের শরণার্থী জীবন থেকে ফিরে এসেছিলেন।
এখন বঙ্গবন্ধুও নেই, দেশটাও আর কোনদিন ধর্ম নিরপেক্ষ হবেওনা। তার দলের নেতারা মুজিবকোটের সঙ্গে একটা গোলটুপিও পরেন! মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দেশের চেহারা আর এখনকার চেহারায় হাজার গুন তফাৎ! দেশের সংখ্যালঘুরাও এখন আর আওয়ামী লীগকে তাদের জন্যে নিরাপদ দল মনে করেনা।
নানান বাহানায়, সর্বশেষ গত দূর্গাপুজায় যত পুজা মন্ডপে হামলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে তা কল্পনায় ভাবা যেতোনা। সারা বছর ধরে চলে সংখ্যালঘুর নিরাপদ দেশত্যাগ! দেশত্যাগ করতে এখন অবশ্য আর সংখ্যালঘুও হওয়া লাগেনা।
আওয়ামী লীগ প্রতিদিনের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলে! কিন্তু এখন দলটির ৯৯ ভাগ নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ-কর্মসূচি জানেনা। তাদের এসব জানানোও লাগেনা। যাদের দায়িত্ব এসব জানানোর তারা সারাক্ষন নানান ধান্ধায় ব্যস্ত। অথবা তারাও এসব এখন ভুলে গেছে!
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ ছেড়ে কেনো দেশের হাজার হাজার যুবক প্রতিবছর ভূমধ্য সাগরে ডুবে মরতে যায় তা ওবায়দুল কাদের বা হাসান মাহমুদদের ব্রিফিং’এ স্থান পায় না কোন দিন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি উপহাস করে বলেন যারা ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরে তারা নাকি গুম হওয়া ব্যক্তি!
প্রিয় জাতির পিতা, জন্মদিনে আপনাকে আবারও অভিবাদন। আপনার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক। টুঙ্গিপাড়ার মাটি আপনাকে ধারন করতে পেরে ধন্য। আপনার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই। কিন্তু আপনার মেয়ে শেখ হাসিনাও দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেননি।
দেশের সিংহভাগ মানুষের কত ছোট ছোট চাহিদা! তারা ভিক্ষা চায় না। শুধু চায় আপনাদের কুত্তাগুলো সামলান। নির্ধারিত সহনীয় মূল্যে চাল-ডাল-তেল-চিনি কিনে খেয়ে কোনমতে দিন পার করতে চায় দেশের সিংহভাগ মানুষ। কিন্তু এটাই তাদের দেবার ব্যবস্থা নেই।
আমাদের ক্ষমা করবেন প্রিয় জাতির পিতা। এখনও বলি, আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমেই দেশে শান্তি আসবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।