ফজলুল বারী: দেশের স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে। একুশে পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার এসব দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসের আগে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়। কিন্তু প্রায় এই পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। স্বাধীনতা বিরোধী শর্ষিনার পীরকেও স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছে!
আজ পর্যন্ত শর্ষিনার পীর নিয়ে এই জালিয়াতি অথবা ভুলকে সংশোধন করা হয়নি। বারবার চিহ্নিত হয়, জাতির মর্যাদার পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কারন এসবের সঙ্গে আমলা নির্ভরতা। আমলারা দাপ্তরিক কাজে দক্ষ। আবার বঙ্কিম চন্দ্র, মোফাজ্জল করিম অথবা কামাল চৌধুরী এরাও আমলা ছিলেন।
কিন্তু বাংলাদেশের অনেক আমলা দাপ্তরিক কাজকে জটিল, গোলমেলে করে দিতে দক্ষ। দিনশেষে এসবের জবাবদিহিতো রাজনীতিবিদদেরই করতে হয়। যে শাখার পুরস্কার সে শাখার দেশবরেন্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি করে দিলে স্বচ্ছ হয় যাচাই বাছাইর বিষয়টি।
এবার যে আমির হামজাকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। আজকাল গুগলে ফেসবুকে কারও নাম লিখে সার্চ দিলেও অনেকের পাপ পূণ্যের অনেক তথ্য চলে আসে। এই লেখা তৈরির আগে আমি সে রকম একটা চেষ্টা করেছি।
আমির হামজা নামে অনলাইনে সার্চ দিয়ে এক তরুন কবি’র সাহিত্য কর্মকান্ডের প্রমান পেয়েছি। লেখালেখি সহ নানান কর্মকান্ডে তিনি সক্রিয়ও। আর এই আমির হামজা সম্পর্কে আছে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্যে মনোনীত ঘোষনার পর বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট।
দেশের বরেন্য ইতিহাসবিদ সাহিত্যিক মুনতাসীর মামুন, বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বলেছেন তারা এবারে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত আমির হামজাকে চেনেননা। তার কোন বই তারা পড়েননি। মুনতাসীর মামুন অথবা সেলিনা হোসেন এদের বক্তব্য আমলে নেয়া উচিত।
আমির হামজাকে নিয়ে তাদের কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। একজন লেখক অনেকের লেখা পড়েই সমৃদ্ধ হন। কিন্তু যাকে দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হচ্ছে দেশের সেরা লেখকরা তার ব্যাপারে অবহিত নন।
দেশের এই মাপের ব্যক্তিরা যদি স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাহিত্য কর্মকান্ড সম্পর্কে অবহিত না থাকেন তাহলে খুঁজতে হবে এমন ব্যক্তিকে কেন কিভাবে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্যে মনোনীত করা হয়েছে। এই পুরস্কার চিহ্নিত করেছে পুরস্কারের ব্যক্তি নির্বাচনের আমলা পদ্ধতি ভেঙ্গে দিতে হবে।
পুরস্কার দেবার পর বলা হচ্ছে তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! কিন্তু এখন বেরিয়ে আসছে সব তথ্য! এক সময়কার মুসলিম লীগার আমির হামজা মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবন বাঁচাতে তার গ্রাম এলাকা মাগুরার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দল আকবর বাহিনীতে যোগ দেন।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর সাবেক এই মুসলিম লীগার হয়ে যান পিপিপি তথা প্রেজেন্ট গভর্নমেন্ট! বিএনপির আমলে বিএনপি, জাতীয় পার্টির আমলে জাতীয় পার্টিও করেছেন চতুর এই ব্যক্তি। এই তথ্য প্রকাশ করেছেন মাগুরার বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আমিরুজ্জামান বীর বিক্রমের ছেলে মুরাদ।
নব্বুইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা শফি আহমেদ এখন গবেষনা কর্মকান্ডে জড়িত। এই লেখার কিছু তথ্য তাঁর ফেসবুক পোষ্ট থেকে নেয়া। তিনি লিখেছেন, আমির হামজা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনি মাহবুব আলম চাষী ও মজিদ উল হকের অনুষ্ঠানে শহীদ জিয়া বলে গান গাওয়ারও প্রতিভা যুক্ত।
১৯৭৮ সালে সাহাদাত ফকির নামের এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে খুন করে তার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের দন্ড হয়। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে মজিদ উল হকের মাধ্যমে জেল থেকে ছাড়া পায়। বিএনপির নেতার ব্যবস্থাপনায় আওয়ামী লীগের কর্মীকে হত্যার অপরাধ-দন্ডও তার তামাদি হয়।
ছাত্রদলের সন্ত্রাসী ক্যাডার হিসাবে পরিচিত ছিল তার এক ছেলে। উল্লেখ্য এই মজিদ উল হক ছিলেন মাগুরা উপনির্বাচনে জালিয়াতির মূল কুশীলব। এখন প্রকাশ পাচ্ছে প্রেজেন্ট গভর্নমেন্ট পার্টি আমির হামজার বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা সম্পর্কে কবিতা দেখিয়ে তার উপসচিব ছেলে পুরস্কার বাগিয়েছেন।
কিন্তু এসবেরতো বিশুদ্ধ সাহিত্য মান থাকতে হবে। সাহিত্য পুরস্কারের মান নির্নায়ক সাহিত্য বিষারদ নন এমন আমলা হতে পারেননা। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন, আমির হামজা নামের কোন সাহিত্যিকের নাম তিনি শোনেনি।
তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেবার পর তার ‘বাঘের থাবা’, ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ নামের দুটি বই সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। ২০১৮ সালে বাঘের থাবা’ বইটি বের করা হয় আমির হামজার আমলা ছেলের উদ্যোগে। মাগুরার শ্রীপুরের সারথি ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে বইটি বের করা হয়।
ঝিনাইদহের বেগবতী প্রকাশনী ছিল বইটির মুদ্রন ব্যবস্থাপনায়। আমির হামজার মেঝ ছেলে মোঃ আসাদুজ্জামান তখন ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছিলেন। তিনিই বিষয়টির তদারকি করেন। আসাদুজ্জামান এখন অতিরিক্ত সচিব। খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী হিসাবে কাজ করছেন।
প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন ঝিনাইদহে চাকরি করার সময় তিনি ‘বাঘের থাবা’ বইটি বের করেন। বইটির গানের অংশ নিয়ে ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ নামের আলাদা বই বের করা হয়। ২০১৯ সালে ‘বাঘের থাবা’ বইটির দুই ভগ্নাংশ নিয়ে ‘বাঘের থাবা’ ও ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ নামে পৃথক দুটি বই প্রকাশ করে অন্য প্রকাশ।
ঢাকার প্রকাশনী সংস্থাগুলো মূলত বাজার কাটতি আছে এমন লেখকদের বই প্রকাশে নিজেরা লগ্নি করে। আর আমির হামজাদের বই প্রকাশ করে অনুরোধে টাকার বিনিময়ে। পিতার স্বাধীনতা পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে আমির হামজার উপসচিব ছেলে কাজ করছিলেন।
বাবা’র স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্যে লিখিত আবেদনও করেন তার উপসচিব ছেলে আসাদুজ্জামান। এরজন্যে সুপারিশ স্বাক্ষর করেন বানিজ্য মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। ব্যাস, সাহিত্যে দেশের সবচেয়ে মর্যাদার পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার ম্যানেজ হয়ে গেলো!