ফজলুল বারী: আমরা বাংলাদেশের এক গুরুত্বপূর্ন সময়ে সাংবাদিকতায় এসেছি। পোড় খাওয়া একটি প্রজন্ম বলতে যা বোঝায় তাই। আমাদের আগের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পোড় খাওয়া প্রজন্ম। আমাদের প্রজন্মটি সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্ট।
আজকের নেতৃত্বের অনেকের বিকাশ ঘটেছে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। আমরাও সেই আন্দোলনের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে এগিয়েছি সাংবাদিকতায়। এরপর আর বাংলাদেশে সে রকম রাজনৈতিক আন্দোলন হয়নি। নতুন পোড় খাওয়া প্রজন্মেরও সৃষ্টি হয়নি। এখন মূলত সহমতভাই প্রজন্মের যুগ।
আমাদের প্রজন্মের সাংবাদিকতার সময়ে দেশে প্রথম যে শ্রদ্ধার রাষ্ট্রপতিকে দেখি তিনি প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা পাইনি। এরপর যারা হত্যাকান্ড অথবা অভ্যুত্থানের সূত্রে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তাদের নিয়ে ছিল নানান বিতর্ক।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি হন খুনি খন্দকার মোশতাক আহমদ, বিচারপতি সায়েম, জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিচারপতি সাত্তার, বিচারপতি আহসানন উল্লাহ, জেনারেল এরশাদ এসব চরিত্র। বঙ্গবন্ধুর আগের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ এরশাদ আমলে উপজেলা চেয়ারম্যানও হয়েছেন।
আর বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের পর রাষ্ট্রপতি হয়েছেন বরিশালের রাজাকার আব্দুর রহমান বিশ্বাস! ইয়াজ উদ্দিন অথবা ইয়েস উদ্দিন! ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতনকে কেন্দ্র করে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন। এর আগে তিনি সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
এরশাদের স্বৈরশাসন নয় বছর দীর্ঘ হবার কারনও ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য। ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতনের সময়ও এরশাদ একটা চাল খেলেন! তিনি আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোকে বলেন এমন একজনের নাম বলেন, যার কাছে তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন।
কারন এরশাদ ও তার দোসররা তখনও ভাবছিল রাজনৈতিক দলগুলো তার উত্তরসূরী প্রশ্নে ঐকমত্যে আসতে পারবেনা। এরশাদের দোসর এখনকার বিএনপি নেতা শাহ মোয়াজ্জেম বলেছিলেন, ক্ষমতাতো এমন নয় যে আমরা তা এসে জিরো স্কোয়ারে এসে ছেড়ে দেবো।
কিন্তু তখন দেশের ছাত্র-শ্রমিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি পেশাজীবীদের ঐক্য ছিল আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ন শক্তি। মূলত আইনজীবী ঐক্যের কারনেই প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে রাজি করানো সম্ভব হয়।
তিন জোটের রূপরেখায় এই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের কথা উল্লেখ করা ছিল। কিন্তু এমন একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার কোন ধারনা বা অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ছিলোনা। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন অবশ্য তখন শর্ত সাপেক্ষে তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে রাজি হন।
তাঁর শর্তটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন শেষে তাঁকে আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরতে দিতে হবে। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য ছিল শাসন বিচার বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরনের যে কাজটি তিনি করছিলেন, এর কাজ শেষ করতে তাঁর আবার সুপ্রিমকোর্টে ফেরা দরকার।
তাঁর আবার সুপ্রিমকোর্টে ফিরতে সংবিধান সংশোধনের দরকার ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সেই সংশোধনীরও প্রতিশ্রুতি দেয়। তাঁর কোন রকম রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস ছিলোনা। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো তাঁকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দায়িত্বে নিয়ে আসে।
কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর নোংরামি তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তাঁকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিতে প্রথম নোংরামি করে এরশাদের দল। তারা বলে তাকে প্রথম উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে নিয়োগ দেয়া হবে। এরপর এরশাদ পদত্যাগ করার পর তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবেন।
এরশাদের এই ফর্মূলায় মওদুদ আহমদ প্রথম উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলে এরশাদ তাকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। এরপর এরশাদ পদত্যাগ করলে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। এরজন্যে জাতীয় পার্টি পরবর্তীকে তাকে এরশাদ নিযুক্ত উপরাষ্ট্রপতি দাবি করে।
আসল সত্য এরশাদতো সখ করে পদত্যাগ করেননি। গণঅভ্যুত্থানের মুখে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদের দলের সব নেতাকর্মী পালিয়ে গিয়েছিলেন। আবার পদত্যাগের পর সেনানিবাসের বাড়িতে বসে এরশাদ বিবিসিতে সাক্ষাৎকার দিলে দেশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
এরশাদকে তখন গুলশানের একটি বাড়িতে গৃহবন্দি করা হয়। এরশাদ এবং জাতীয় পার্টির নেতারা এটিকে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে উল্লেখ করেন। আদতে তখন এরশাদকে আটক না করলে ছাত্র-জনতা তাকে খুঁজতে ছুটতো। ডিসেম্বর ৪ তারিখ থেকে মানুষ তাদের খুঁজছিল।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের মতো আসন পায়। কিন্তু তখন সরকার পদ্ধতি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তিন জোটের রূপরেখায় দেশকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফেরানোর প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পারবেন কিনা এই সংশয় থেকে বিএনপি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতিতে থেকে যেতে চাইছিল।
তখন বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের এক রকম হুমকির মুখে বিএনপি তাদের মনোভাব বদলায়। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন মনে করিয়ে দিয়ে বলেন রাজনৈতিক দলগুলো তিন জোটের রূপরেখায় সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের সংসদে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের সুপ্রিমকোর্টে ফিরে যেতে সংবিধান সংশোধনীর বিল পাশ হয়। একজন ব্যক্তির জন্যে সংবিধান সংশোধন নিয়ে সমালোচনা আছে। কিন্তু এটাই ছিল রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিশ্রুতি।
প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন শেষে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন নিভৃতের জীবনে ফিরে যান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে ক্ষমতায় ফিরলে তাকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। তখন তাকে নিয়ে মিডিয়ায় আলোড়নও হয়। সংসদীয় ব্যবস্থার রাষ্ট্রপতি প্রায় নিষ্প্রান এক চরিত্র।
কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দিন তখন নানা ইস্যুতে জাতির বিবেকের মতো কথা বলতেন। তাই মিডিয়ার লোকজন তাঁর অনুষ্ঠানের এসাইমেন্ট মিস করতে চাইতোনা। তাঁর রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন নেলসন ম্যান্ডেলা সহ আন্তর্জাতিক অনেক ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে আসেন।
অবশ্য এসব উদ্যোগ ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। দেশের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতিরও পরিবারের সবার রাহা খরচ রাষ্ট্রের। কিন্তু এসব বিষয়ে খুব কঠোর নিয়ম মেনে চলতেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন। এরজন্যে তার বিরুদ্ধে কোন দিন কোন দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠেনি।
রাষ্ট্রপতির ছেলেমেয়ে কে এসব দেশের মানুষ কখনও জানতেনওনা। তাঁর স্ত্রীও থাকতেন মিডিয়ায় ফোকাসের আড়ালে। রাজনৈতিক সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁর শেষটা ভালো যায়নি। কিন্তু এসব নিয়ে তিনি কখনো প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি।
এরপর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নীরবে নিভৃতেই কাটে তাঁর। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসাবে, দেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান, দু’দফায় রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁর দিনগুলোর লেখালেখি দেশের মূল্যবান দলিল হয়ে থাকবে। ভালো থাকবেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ।