বিমানের ৪ কোটি টাকার বিনোদন ভ্রমন !

বিমানের ৪ কোটি টাকার বিনোদন ভ্রমন !

ফজলুল বারী:দেশে যখন টিসিবির গাড়ির লাইনের দাঁড়ানো নিয়ে মানুষের আহাজারি তখন বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, তার স্ত্রী-মেয়ে সহ ১৪০ জন বিমানের চার কোটি টাকা খরচ করে টরেন্ট ফ্লাইট চালুর নামে কানাডায় প্রমোদ ভ্রমনে গেছেন! আমলারা কিভাবে মন্ত্রীদের চারপা যুক্ত বানান, এ ঘটনা এর দৃষ্টান্ত!

কারন তারা তাদের নিজেদের বা স্ত্রী-সন্তানদের সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমন, বিশেষত কানাডার বেগমপাড়ার প্লট দেখাতে নিয়ে যাবার পথ করতে মন্ত্রীর স্ত্রী-কন্যার নাম সেখানে যুক্ত করে ফাইল পাশ করান! এই দলে  বিমান প্রতিমন্ত্রী ছাড়াও গেছেন, তার স্ত্রী শামীমা জাফরীন, মেয়ে তাহরিমা রাহবার,বিমান মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী ও তার স্ত্রী ফাহিমা খাতুন, বিমান পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান সাজ্জাদুল হাসান, তার স্ত্রী লায়লা আর্জুমান্দ, তার ছেলে আহমদ শাবাব হাসান, বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন,প্রধানমন্ত্রীর সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, বিজিএমইএ’র প্রেসিডেন্ট ফারুক হোসেন, তার স্ত্রী শারমীন ইসলাম হাসান, বিমান প্রতিমন্ত্রীর এপিএস মোহাম্মদ মোসাব্বির হোসেন, উপসচিব সৈয়দ শরিফুল ইসলাম, পিআরও তানভীর আহমদ সহ মন্ত্রণালয় ও বিমানের ৪৭ জন!

এই প্রতিমন্ত্রীর একটা সত্যি গল্প নিশ্চয় অনেকের মনে আছে। ঘটনাটা সর্বশেষ বিমান ছিনতাইর ঘটনার সময়কার। ওই ঘটনার সময় প্রতিমন্ত্রী একটা টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রকাশ করেন তার কোন কাজ নেই! প্রতিমন্ত্রী বলছিলেন, ছিনতাইর ঘটনা শুনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সামনে চলে যান।

সেখানে গিয়ে দেখেন প্রধানমন্ত্রী টেলিভিশনের সামনে বসে সব নিউজ দেখছেন আর ফোনে নানান নির্দেশনা দিচ্ছেন। প্রতিমন্ত্রী বললেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন চমৎকার সবকিছু সামাল দিলেননা! আমার আর কিছুই করা লাগেনি!’ এমন এসব মন্ত্রীর আসলেই কিছুই করা লাগেনা।

কিন্তু বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের পর সবার আগে যে মামলাটি হয় তা বিমান কেনাবেচা সম্পর্কিত! এরশাদ খালেদা সহ সব আমলেই এটা ঘটেছে! খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার তখন বিমানে চাকরি করতেন। তার অনুমতি ছাড়া তখন বিমানের কোথাও গাছের পাতাও নড়তোনা!

তখন অবশ্য দেশের অর্থনৈতিক ভলিয়্যুমটা এত বড় ছিলোনা। তাই বিমান সংক্রান্ত কেনাকাটা ছিল সবচেয়ে বড়। মিগ কেনাকাটা ছিল আরও বড়। এখন দেশের অর্থনৈতিক ভলিয়্যুম অনেক বড় হওয়ায় নানান বড় কেনাকাটার প্রকারও বেড়েছে।

করোনার কারনে স্বাস্থ্যখাতের মোটা দাগের দুর্নীতি সব সামনে এসেছে।  বিদেশ থেকে বিমানে করে শূন্য কার্টন এসেছে, ভিতরে কোটি কোটি টাকার মেশিন-যন্ত্রপাতি ছিলোনা, এসব ওয়াকিফহালরা জানেন। করোনা ভ্যাকসিন কেনাকাটা নিয়ে আসলে কী ঘটেছে, এসব নিয়ে বাতাসে প্রশ্ন আছে। উত্তর নেই।

বাংলাদেশটা গত ৫০ বছরে অনেক বদলেছে। ডিজিটালাইজেশন হয়েছে দেশের অনেক কিছু। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অনেক দায়িত্বে এখনও অনেক এনালগ লোকজনের পদায়ন হচ্ছে। এরজন্যে প্রায় জানা যায় সরকারি টাকায় ঘাস কাটা থেকে শুরু করে নানান কিছু দেখতে লোকজন যাচ্ছেন বিদেশে!

বিদেশে অনেককিছুতে প্রশিক্ষনের দরকার আছে। বাংলাদেশের মন্ত্রী থেকে শুরু করে দায়িত্বশীলদের বিদেশ গেলে তারা অন্তত নিজেদের ওজন করতে শিখবেন। দেশে অনেকে নিজেদের হামবড়া ভাব দেখান। কিন্তু দেশের বাইরে পা রাখলেই তারা টের পান ঘটিতে তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কী আছে!

অনেক কিছুতেই আজকাল আর বিদেশ না গেলেও চলে। ভার্চুয়ালি অনেক প্রশিক্ষন কম্পিউটারে সামনে বসিয়েই নেয়া যায়। মন্ত্রী কম্পিউটার চালিয়ে ক্যামেরা অন করে বসতে না জানলে তার ছেলেকে বললেই তা শিখিয়ে দেবে। বাংলাদেশের অনেক মন্ত্রী-সচিবদের চাইতে তাদের  প্রিয় প্রজন্ম অনেক স্মার্ট!

মন্ত্রী-সচিব বা আমলাদের অনেকে বেশি স্মার্ট টাকা মারাতে! টাকা মারার এমন সব কায়দা কানুন এরা জানেন বা কায়দা কানুন উদ্ভাবন করতে পারেন, পৃথিবীর আর কেউ তাদের সঙ্গে পারবেনা। এরজন্যে নানা কিছুতে বাংলাদেশের নানান প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি।

অথচ বাংলাদেশের শ্রমিকদের ডলারে বেতন দেয়া হয়না। শ্রমিকদের বেতন কম বলে এখানে গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ হয়েছে। চা শিল্পে মুনাফার গল্প শোনানো হয়। সেখানকার শ্রমিকদের জীবন যে এখনও দাসযুগের। সে গল্পটি মিডিয়ায় আসে খুব কম। মিডিয়ার যোগ্যতাও এখন কাঠগড়ায়।

বিদেশে প্রশিক্ষনে এমন লোকজনকে পাঠাবেন যারা ওই শাখায় কাজ করেন। ফুল সংরক্ষনের প্রশিক্ষনে পাঠাবেন গদখালীর ফুল চাষীদের। মন্ত্রী-সচিবদের নয়। খিচুরি রান্না শেখার প্রশিক্ষনের খবরও ছাপা হয়েছিল! এই প্রশিক্ষন ঘরের স্ত্রী-কন্যার কাছে নেয়া যায়। পৃথিবীর সেরা সেফও তাদের চাইতে সুস্বাদু খিচুড়ি রান্না করতে পারবেননা।

৫০ বছর একটা দেশের বয়স। ছোট একটা দেশে ১৭-১৮ কোটি লোকের বসবাস। এর কমপক্ষে এক কোটি মানুষ এখন বিদেশে থাকেন। এরজন্যে বাংলাদেশের এয়ারস্পেস যে কোন বিমান কোম্পানির জন্যে লাভজনক। এবং বিদেশি সব কোম্পানি এখান থেকে লাভ করেই যাচ্ছে।

ঢাকার সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ান বা সৌদি এয়ারলাইন্সের অফিস ঘুরে আসুন। ৩০-৪০ জন লোকবল নিয়ে এদের অফিস চলে। এই লোকবল নিয়েই বছরের পর বছর ধরে এরা মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের ব্যবসাই শুধু করে গেলো! আর জাতীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমান দেশ স্বাধীন হবার পর যে আকাশে শান্তির নীড় বলে চলা শুরু করেছিল, তাদের শুধু লোকসান আর লোকসানের গল্প!

বাংলাদেশের সরকারি বড় দুর্নীতির মাধ্যম হচ্ছে বিদেশে কেনাকাটা! এর মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচারও হয়। বিদেশি কোম্পানি বা তাদের এজেন্টদের সরকারি চোর-ডাকাতরা বুদ্ধি দিয়ে বলেন ক্রয়াদেশ কিভাবে বেশি দেখাতে হবে! বিদেশিরা এভাবে মুনাফাও বেশি পায়। আর দেখে যায় এই দেশটার দায়িত্বশীল লোকজন চোর-ডাকাত! দেশপ্রেমের অভাব।

রাশেদ খান মেননের মতো নেতা যিনি সারাজীবন এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তিনিও বিমান আনতে অমুক দেশে চলে গেলেন! বিমান কিনলে বিমান আনতে মন্ত্রীকে যেতে হয়! তার দলের লোকেরা বললেন, খরচতো সংশ্লিষ্ট বিমান কোম্পানির! এসব যে ঘুষ তা নিশ্চয় রাশেদ খান মেননও জানেন।

এবার কানাডায় যে ‘মর্যাদার ফ্লাইটের’ নামে অমুক অমুকের স্ত্রী-সন্তানরাও গেছেন, এরসঙ্গে তাদের সেখানে কাজ কী? অস্ট্রেলিয়ায় এমন ঘটনা অকল্পনীয়। কালেভদ্রে যদি কোন অভিযোগও যদি ওঠে, সক্রিয় হয়ে যায় রয়েল কমিশন। আর বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্যে ওহী নাযিল জরুরি!

একবার অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের একাংশের এক নেতা অনুরোধ করে বললেন, আমি যাতে বিমানের সিডনি ফ্লাইট চালুর জন্যে লিখি। আমি তাকে বলেছিলাম, সিডনি ফ্লাইট লাভজনক হবেনা। কয়জন মানুষ সিডনি বা অস্ট্রেলিয়ার শহরগুলো থেকে দেশে যাতায়াত করেন?

বিমানের নিউইয়র্ক ফ্লাইটের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। নিউইয়র্ক ফ্লাইটের নামে চলতো দুর্নীতির মচ্ছপ! কাউন্টারে টিকেট পাওয়া যেতোনা! কিন্তু আসন খালি নিয়ে ফ্লাইট যেত! সরকারি দলের লোকজন-আমলারা  উপহারের টিকেটে ফ্রি নিউইয়র্ক যাতায়াত করতেন!

এরজন্যে একবার নিউইয়র্ক যেতে আসতে বিমানের ৯০ লক্ষ টাকা ক্ষতি হতো। পরবর্তীতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্রটি দেখিয়ে মার্কিন কর্তৃপক্ষ ফ্লাইট বন্ধ করে দিলে দেশের রক্ষা হয়। এত বিশাল অংকের লোকসান থেকে রক্ষা পায় দেশ। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে দাবি করে আবার নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর ফন্দিফিকির চলছে!

টরেন্টো ফ্লাইটের নামে এই বিনোদন ভ্রমনের আসল কাহিনী জানা যাবেনা।  কারন দলে সাংবাদিক যারা গেছেন তারা এ নিয়ে লিখতে বলতে পারবেননা। এভাবে বিদেশ গেলে সবাই স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে পারেননা।   তবে আসল কাহিনী আসবেই। কারন দেশের অনেক মেধাবী সাংবাদিক এখন থাকেন কানাডায়।