ফজলুল বারী: আমি যে স্কুলে পড়েছি সে স্কুলের নাম নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়, কুলাউড়া। আমার কলেজের নাম মুরারী চাঁদ মহাবিদ্যালয়, সিলেট। স্কুলে আমাদের শিক্ষকদের অনেকেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু প্রাণেশ কর। এ ছাড়া ননী গোপাল ভট্টাচার্য স্যার, সীতেশ চন্দ্র স্যার, আদিত্য স্যার, করবী স্যার, সুশীল সেনগুপ্ত নাড়ু স্যার, চন্দন স্যার এরা ছিলেন আমাদের শিক্ষক তালিকায়।
আমাদের অনেক মুসলমান শিক্ষকও ছিলেন। কিন্তু তখন কোন দিন ভাবিনি ননী স্যাররা হিন্দু শিক্ষক। তারাও কোন দিন আমাদের মুসলিম ছাত্র হিসাবে আলাদা করে দেখেননি। এক সময় হিন্দু জমিদার অথবা ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই আমাদের তল্লাটে স্কুল-কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। ব্রিটিশ ভারতে অমুসলিমরাই ছিলেন ইংরেজি শিক্ষায় এগিয়ে।
ভারত বিভাগের সময় হিন্দু জনগোষ্ঠীর বড় অংশ ভারতে চলে যান। যারা যাননি তারা মূলত জন্মভূমির মায়ার টানে তখন যেতে পারেননি। পাকিস্তানি শাসকরা মনেপ্রাণে ছিলেন হিন্দু বিদ্বেষী। একাত্তরে বাঙলি জাতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হামলার অন্যতম টার্গেট ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তারা হিন্দুদের চক্রান্ত বলে প্রচার করতো! মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ জুড়ে গুটিকয় বাদে প্রায় সব হিন্দু বাড়ি সম্পত্তিই তখন অগ্নিসংযোগ লুটতরাজের শিকার হয়। রাস্তায় রাস্তায় পথচারীদের থামিয়ে লুঙ্গি খুলে আর কলেমা পড়িয়ে মুসলমানিত্বের পরীক্ষা নেয়া হতো। প্রাণ বাঁচাতে অনেক হিন্দু চার কলেমা শিখেছিলেনও।
তখন ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের বড় অংশ ছিল হিন্দু। ভারত যে তখন বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছে এর অন্যতম বড় কারন ছিল এসব হিন্দু শরণার্থী। ভারতে আশ্রয় নেয়া প্রবাসী নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।
বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রীস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি, বলে গান গেয়ে পোস্টার এঁকে ছাপিয়ে আমরা তখন ভারতীয় নেতৃবৃন্দ আর জনগনের মন জয় করেছিলাম। মনটাও তখন আমাদের অনেক পবিত্র ছিল। ভারতীয়রাও তখন আমাদের বিশ্বাস করেছে।
মনে করেছে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আরেকটা নতুন পাকিস্তান হবেনা। দেশটা স্বাধীন হয়ে গেলে শরণার্থীরাও নিজের দেশে চলে যাবে। কিন্তু আমরা আমাদের কথা রাখিনি। বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। হিন্দু বিদ্বেষী পাকিস্তান আমলেও ব্রাহ্মনবাড়িয়া জাতীয় জনপদের নাম নিয়ে কোন সমস্যা দেখা হয়নি।
কিন্তু বাংলাদেশ আমলে এসে আমরা সেটিকে বলতে শুরু করি বি বাড়িয়া! আমাদের নবীন চন্দ্র স্কুলের নাম এখন এনসি হাইস্কুল! মুরারী চাঁদ মহাবিদ্যালয়কে এমসি কলেজ নামে ডাকা হয় বেশি! সিলেট শহরের আরেক কলেজ মদন মোহন কলেজের নাম হয়েছে এম এম কলেজ!
বরিশালের বিএম কলেজের নাম যে ব্রজমোহন কলেজ তা আজ নতুন প্রজন্মের কয়জনা জানে! বাংলা নামকে আমাদের বেশিরভাগ লোকজন হিন্দু নাম মনে করে! ইংরেজি নামে সমস্যা নেই। এটাকে মনে করা হয় স্মার্ট হওয়া! বাংলাদেশেরও সাম্প্রদায়িক হামলার বড় লক্ষ্য হিন্দু জনগোষ্ঠী।
হিন্দু বিদ্বেষকে অন্তর থেকে লালন করতেন বলে মৌলবাদী ইসলাম ধর্মীয় বাঙালি নেতৃবৃন্দও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা-পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছেন। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা ছাড়াও তারা ঘৃনার গালি দিয়ে তারা শ্লোগান দিতো, ‘জয় বাংলা জয় হিন্দ, লুঙ্গি ছেড়ে ধুতি পিন্দ’!
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে সহজ সীমান্ত না থাকায় তারা এখানে আটকা পড়ে যান! জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তাদের মন আবার খুশিতে চাঙ্গা হয়। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ চিৎকারে তারা মাঠে নেমে পড়েন!
তারাই এখন ছড়িয়ে গেছেন সবখানে। মুরিদানরা শাসক দলেও আছেন বিস্তর! এরজন্যে নারায়নগঞ্জে যখন শ্যামল কান্তি ভক্ত নামের একজন শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করানো হলো, তখন বাংলাদেশে অবাক দেখা গেলো শাসকদলের অনেক নেতাকর্মী এতে সায় দিয়ে বলতে থাকেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে!
সেই শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো সেলিম ওসমান জাতীয় পার্টির এমপি। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির কর্তৃ্ত্ব রক্ষায় নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতার এক সন্তানকে এখন কষ্ট করে আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে স্বৈরাচার এরশাদের দল জাতীয় পার্টিও করতে হয়!
এক ভাই যেহেতু আওয়ামী লীগে দাপটের সঙ্গে আছেন, তাই তার ব্যবসায়তো কোন সমস্যা হচ্ছেনা! স্বৈরাচার এরশাদ যেহেতু রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন, আর আওয়ামী লীগ যখন এক্ষেত্রে এরশাদের অনুসারী, তাই জাপার এমপি একজন হিন্দু শিক্ষককে কান ধরে ওসবস করালে তাতে সওয়াবের কাজই হয়!
শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করানোর সময়েও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলা হয়েছে! মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে জেলে পোরার সময় বলা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার কথা! নওগার মহাদেবপুরের শিক্ষক আমোদিনী পালও ধর্মানুভূতিতে আঘাতে জড়িত!
আমোদিনী পালকে শায়েস্তা করতে যারা হিজাব বিতর্ক তুলেছিলেন তারাও হিন্দু হওয়াতে নাটকটা সেভাবে জমানো যায়নি! বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এমনিতে কত সমস্যা! দেশজুড়ে এত ঘুষ-দুর্নীতি-অনাচার! উচ্চ দ্রব্যমূল্যের ঘানি টানতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে পরিশ্রমী সৎ মানুষেরা।
সে দিকে কারও কোন নজর নেই! বাংলাদেশে কিছুদিন পরপর রিহার্সাল হয় ধর্মানুভূতি ব্যারামের! সৌদি আরব সহ আরব দেশগুলোতে, দুনিয়ার আর কোন মুসলিম দেশে এসব সমস্যা হয়না। ধর্ম চলে যাবার সব বিপদ শুধু বাংলাদেশে!
ধর্মানুভূতিতে আঘাতের দোহাই তুলে কিছু দিন পরপর হিন্দু বাড়ি সম্পত্তিতে আক্রমন না করলে যে তাদের অবশিষ্টদের বাড়ি সম্পত্তি অল্প দামে কেনা যায়না! ফরিদপুরে কত মানুষ গ্রেফতার হন। খন্দকার মোশাররফের ভাই গ্রেফতার হন। কিন্তু হিন্দু সম্পত্তি লোভী খন্দকার মোশাররফ গ্রেফতার হননা!
এদের দাপটে দেশ ছাড়তে ছাড়তে বাংলাদেশে এখন অল্প সংখ্যক হিন্দু বাস করেন। পাশের দেশ ভারত বিজেপি শাসিত হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ায় খুশি খুশি কিছু উগ্র লোকজন তৎপর শুধু ফেসবুকে। বাদবাকি হিন্দুদের ৯৯ ভাগ নিরীহ। আরও নিরীহ শিক্ষকরা।
শিক্ষকরাতো পিতৃতূল্যও। তেমন একজন শিক্ষক হৃদয় মন্ডল কি কল্পনায় ভাবতে পেরেছেন তার সন্তানতূল্য ছাত্ররা বিজ্ঞানের ক্লাসে ধর্ম নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করছে আর রেকর্ড করছে! সেই স্কুলের নামটা এখনও হিন্দু নামে আছে! হয়তো শীঘ্র মুসলমান হয়ে যাবে!
ষড়যন্ত্রী ছাত্রদের সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দাবিমতো এমন রেকর্ড যারা করেছে তারা তার কাছে এসে হৃদয় মন্ডল সম্পর্কে বলেছে আর তিনি তার শিক্ষক সহকর্মীকে শোকজ বরখাস্ত করে ফেলেছেন! একবারও তার বুদ্ধিতে এলোনা ছাত্ররা কিভাবে বেআইনিভাবে ক্লাসে মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে!
আর বিজ্ঞানের ক্লাসে সেটি দিয়ে একজন শিক্ষককে ফাঁসাতে ধর্ম নিয়ে উত্তেজক প্রশ্ন করে করে তৈরি করেছে সোশ্যাল মিডিয়ার উপাদান! না পুরো শয়তানির নেপথ্যে তিনিও জড়িত! না এখানে প্রধান শিক্ষকের মনে কাজ করেছে তার হিন্দু বিদ্বেষী মুসলমান হৃদয়!
চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী যাকে দিয়ে মামলা করানো হয়েছে সেটা বোঝাই যায় পুলিশের হাঁটুর বুদ্ধি! এমন সাজানো প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ জনরোষ থেকে বাঁচানোর কথা বলে একজন হিন্দুকেই গ্রেফতার করে আর তার বিরুদ্ধে মামলা সাজায়। এভাবে যারা আসল কুচক্রী তারা পার পেয়ে যায়।
বাংলাদেশে এমন মামলায় যারা একবার পড়েন তাদের অভিজ্ঞতা হয় তিক্ত। জীবন দুর্বিষহ হয়। কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে তাদের জীবন যায়। হৃদয় মন্ডল কি আর আগের মতো তার সন্তানতূল্য ছাত্রদের ক্লাসে নির্ভয়ে বিজ্ঞান পড়াতে পারবেন? না কোর্টের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরবেন?
একদিন কী টুশ করা এক শব্দে খুন হয়ে যাবেন? না দেশান্তরী হয়ে গিয়ে মাঝে মাঝে সীমান্তে জন্মভূমি বাংলাদেশকে নমস্কার করতে আসবেন! বিনা দোষে ১৯ দিনের কারাবাসে তিনি অন্তত ভুঝতে শিখেছেন এই রাষ্ট্র আর তার নয়। মৃণাল কান্তি দাশদের চেয়ে খন্দকার মোশাররফরাই শক্তিশালী।
শেখ হাসিনা যখন দিনে দিনে এখানে পোড় খাওয়া নেতৃত্বে রূপান্তরিত হয়েছেন, আশেপাশে ভ্যানগার্ডের মতো মৃণাল দাশরাই ছিলেন। দিন শেষে আজকের বাংলাদেশে তিনি বড়জোর একজন হিন্দু এমপি! এরজন্যে মুন্সিগঞ্জের পুলিশও তাকে গোনায় ধরতে শেখেনি। হৃদয় মন্ডলরাও এখানে আর নিরাপদ নয়।