ফজলুল বারী: দুই হাজার এক সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরতে পারলোনা। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ফিরে আসার আতশবাজি উপলক্ষে তখন সারাদেশের হিন্দু বাড়ি সম্পত্তি মন্দিরে হামলা চালানো শুরু হয়। আমি তখন সারাদেশ ঘুরে ঘুরে জনকন্ঠের পক্ষে সরেজমিন রিপোর্ট করছিলাম।
ঢাকার অদূরে কালিয়াকৈরের এক আক্রান্ত মন্দিরের ভিতর গিয়ে চমকে উঠি। ভাঙ্গা বিগ্রহের সামনে বসে শোকার্ত পুরোহিত গীতা পড়ছিলেন। পাশে তার জনকন্ঠের সেদিনের পত্রিকা। পুরোহিত গীতা পড়ছেন আবার ফাঁকে ফাঁকে জনকন্ঠে ছাপা আমার সরেজমিন রিপোর্ট পড়ছিলেন।
আদাব বলে পরিচয় দিতেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন পুরোহিত। তার বক্তব্য এদেশে এসব এখনও ঘটছে কেনো। আওয়ামী লীগের পরাজয়ের সঙ্গে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সংযোগ কী? সংযোগ যে একটা আছে তা বিএনপি বুঝলেও আওয়ামী লীগ কি বুঝেছে?
না মনে করছে মরুক বাঁচুক এরাতো আমাদের! এরা যাবে কোথায়! নতুবা এতদিন ধরে তারা ক্ষমতায় থাকা স্বত্ত্বেও দেশে কেনো সাম্প্রদায়িক হামলা-আক্রমন বন্ধই হচ্ছেনা? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দল ক্ষমতায়। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার চেষ্টা না আছে দলে না আছে দেশে!
বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে বিজ্ঞানের ক্লাসে যে সব ছাত্র ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করতে করতে ফাঁদ তৈরি করতে চেয়েছে তাদের চেহারা দেখেছেন! এ যেন স্কুলের ভিতরে কিশোর গ্যাং! তাদের লালন করেন আরেক শিক্ষক! আওয়ামী লীগ শাসনের ধারাবাহিক এক যুগে দেশে যেন হিজাব আর নেকাবের বিপ্লব ঘটে গেছে!
বাগেরহাটে নাকি সব আওয়ামী লীগ বাস করে? তাহলে সেখানে কেনো হিন্দু বাড়ি সম্পত্তি আগুনে পুড়ে? গত নির্বাচনের আগে সেখানে দারুন নায়কোচিত এক এমপি প্রার্থীর প্রদর্শনী হয়ে গেলো! সেই নায়ক এখন কোথায়? মানুষের দুঃসময়ে নায়ককে পাশে চায় মানুষ।
নতুবা নায়ক যে ভিলেন হয়ে যেতে কতোক্ষণ! আওয়ামী তল্লাটে আগুন তারা জ্বালিয়েছে কোন দুঃসাহসে? দেশে হিন্দুদের ওপর হামলার একের পর এক ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে দল হিসাবে আওয়ামী লীগ মাঠে নামছেনা কেনো? না গরম কালেও কারও কারও শীত নিদ কাটেনা!
কিন্তু যে যেখানে ঘুমাক না কেনো, আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব দ্রুত ছড়িয়ে যায়। এসব ছড়ানোয় আগুন আরও ছড়ায়, নেভেনা। ফেসবুকের ভিডিওতে শোনা যাচ্ছিল ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ বলে হিন্দু বাড়ি বারবিকিউ করছে একদিন ধর্মীয় উগ্র ষন্ডাপান্ডা।
এরা কোন কিসিমের মুসলমান? তাদের কোন কিতাবে লেখা আছে এভাবে ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ বলে বলে হিন্দু বাড়ি সম্পত্তিতে আগুন দিতে হবে? ভিডিও ক্লিপে শোনা যাচ্ছিল পুলিশ চলে আসছে। এ ঘটনায় একজনকে আটকের কথা বলেছে পুলিশ।
দেশে হঠাৎ আবার কিছু দূর্বৃত্ত অসহায় হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে মুসলমানিত্ব জাহির করতে কেন চাইছে? এটাতো তাদের পুরনো স্টাইল। যা তাদের বাপ-দাদারা পাকিস্তান আমলে করতো। বাংলাদেশ আমলে এসেও তাদের চরিত্র বদলালোনা।
অথচ সব মানুষের দেশ হবে বলে এই দেশটা নিয়ে কতোনা আশা ছিলো। সেই আশায় এই দেশটার জন্যে জীবন দিয়েছে তিরিশ লক্ষ শহীদ। শরণার্থী জীবনের যে কি কষ্ট, তা একাত্তরের সিংহভাগ হিন্দু পরিবার জানে। এখনকার যারা আগুন দিচ্ছে তাদের রাজাকার জ্ঞাতিগোষ্ঠী তা জানেনা।
কি অবাক করা বিষয়- দেশটা স্বাধীন হলো, কিন্তু হিন্দুদের ভাগ্য বদলালোনা! জন্মভূমিটা এখনও হিন্দুদের হলোনা! তখন যারা হিন্দু বাড়ি সম্পদে আগুন দিয়েছে তাদের বংশধররা এখনও তাই দিচ্ছে! তাদের মতো করে হিন্দু বাড়ি সম্পত্তিতে আগুন দিয়ে ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ বলছে তাদের আন্ডাবাচ্চার দল!
এসব দেখেশুনে হতাশ আমাদের মা-জন্মভূমি কাঁদছে। একজন সন্তানও যদি কাঁদে মা যে কান্না ছাড়া আর কিছু করতে পারেনা যা এখন দুনিয়ার আর কোন দেশেই সম্ভব নয়। তারা কি মনে করছে এভাবে ভারতকে উত্তেজিত করা যাবে? বিজেপি-শিবসেনা-বজরং দল এসব নানান নাম নিয়ে গেরুয়া পোশাক পরে ঘুরলেও ভারতীয়দের টাইপ অত বলদ নয়। তাদের দেশীয় স্বার্থ তাদের কাছে।
সংখ্যালঘুর ঘর পুড়িয়ে দেবার পর বাঁশি বাজিয়ে পুলিশ গিয়ে আর কি হবে? না, এটা সাফল্যের সঙ্গে হিন্দু বাড়ি পোড়ানোর সমাপনী বাঁশি! টিপ দেখে মুসলমানিত্ব চলে যায় এমন পুলিশওতো আবিষ্কৃত হয়েছে! এত বক্তৃতা হলো, কিন্তু পুলিশে শুদ্ধি অভিযান হলোনা!
এত মৌলভী নাকি এখন আওয়ামী লীগের! ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এত বেতনভূক্ত মৌলভী, অনুদানভোগী! সারাদেশে এত হাজার হাজার কোটি টাকা প্রক।ল্পের মডেল মসজিদ! এখানকার বেতনভূক্ত সবাই একসঙ্গে আওয়াজ দিলেইতো মহাসুমুদ্রের গর্জন হবার কথা!
না এদের বলে দেয়া হয়েছে শুধু হাদিয়া খাবে, জাকাত-সদকা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকাবে, কিন্তু কোন কথা হবেনা! আমাদের ওবায়দুল কাদের প্রায় দিন কত ভালো ভালো কথা বলেন। তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ পণ্য মূল্যবৃদ্ধি কমাতে চাননা! কারন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে!
মূল্যবৃদ্ধি সব বিএনপির কারসাজি। কিন্তু একবারও তাদের কী এসব আগুনের খবর শুনে অকুস্থলে ছুটে যেতে ইচ্ছে করেনা? আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরও আস্থার প্রতীক। অপশক্তির বিরুদ্ধে তাঁর একটি আওয়াজইতো এনাফ।
কিন্তু এই যে হঠাৎ করে একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে! একজন বিজ্ঞান শিক্ষককে সাজানো মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে হয়রানি করা হলো! কিন্তু সরকার কেনো যে কেউ কোন কথা না বলার পণ করেছে! বিজ্ঞান শিক্ষকের জামিনে মুক্তির পর কথা বলেছেন তথ্যমন্ত্রী। আগে নয়।
আপনাদের এত ক্ষমতা, এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করান। ঝুমন দাশের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করান। এতে আপনাদের ক্ষমতার অপব্যবহার হবেনা। ১/১১’র সময়কার মামলা আপনারা প্রত্যাহার করিয়েছেন। হৃদয় দাশদের কোর্টের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরাবেননা প্লিজ।
সিলেটের গোলাগঞ্জের ভাদ্বেশর নাসির উদ্দিন হাইস্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ সুনীল চন্দ্র দাশ জীবনের ভয়ে আজ তিন সপ্তাহ ধরে সপরিবারে এলাকা ছাড়া! সুনীল চন্দ্র একদিন অক্সিজেনের গুরুত্ব বোঝাতে ছাত্র-ছাত্রীদের মাস্ক খুলে জোরো জোরে শ্বাস নিতে বলেছিলেন।
কিন্তু এই শিক্ষকও ভুলে গিয়েছিলেন এই দেশটার আজকের হিসাবে তিনিও যে একজন হিন্দু শিক্ষক! শয়তানগুলোর হাতে পায়ে আর বেড়ি বাঁধা নেই! তারা এখন দেখে দেখে হিন্দু শিক্ষকদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে! কখন তাদের কোন উক্তিকে কিভাবে অপব্যাখ্যা দেয়া যাবে!
সুনীল চন্দ্রের ক্লাসের এক ছাত্রীর তখন নেকাব পরা ছিল। নেকাব খুলতে সে প্রথমে আপত্তি করেছিল। সুনীল চন্দ্র তাকে বুঝিয়ে বলেন, একজন শিক্ষক তার পিতার মতো। তাই সেই অক্সিজেনের গুরুত্ব শেখার সময় নেকাব খুলতে পারে। সেই মেয়েটি শিক্ষকের কথায় কনভিন্স হয়ে নেকাব খুলেছিলও।
এরপর সে রটনা ছড়িয়ে দেয়া হয় হিন্দু শিক্ষক ক্লাসে এক ছাত্রীর হিজাব খুলতে বাধ্য করেছেন! ইসলাম ধর্ম চলে গেলো রব তোলা হয় চারদিকে! স্কুলের তদন্ত কমিটি, স্থানীয় চেয়ারম্যনের তদন্ত কমিটি তদন্ত করেও ধর্মীয় অবমাননার ধ’ও বের করতে পারেনি। ইসলাম ধর্মও এলাকায় সহি সালামতে আছে।
কিন্তু এরপরও হামলার ভয়ে শিক্ষক সুনীল চন্দ্র দাশ স্কুলে এবং এলাকায় ফিরতে পারছেনা। সুনীল বাবু বলেছেন এলাকার জামায়াত-শিবির ও স্কুলের কিছু শিক্ষকের ইন্ধন আছে এর পিছনে। একদার বাম নেতা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের এলাকা সেটি। ঢাকার কোন ওহী নাই! তিনিও নিশ্চুপ!
চট্টগ্রামের মীসরাইর জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হলো তিনি স্কুল শুরুর আগের শরীর চর্চার সময়ে হিজাব পরা থাকায় এক ছাত্রীকে হেনস্থা মারধর করেছেন! অভিযোগ করা হয় ইউএনও’র কাছে। অভিযোগটি নিয়ে এলাকায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
কিন্তু ইউএনও সিসিটিভির ফুটেজ সহ তদন্ত করে দেখেছেন দেরি করে আসায় সেই ছাত্রী সেদিন শরীর চর্চার ক্লাসেই অংশ নেয়নি। যে সব মেয়েকে ঘটনার স্বাক্ষী মানা হয়েছিল তারা ঘটনা জানেইনা। স্বাক্ষী করতে তাদের অনুমতিই নেয়া হয়নি।
দেশে হঠাৎ করে কেনো ইসলাম গেলো ইসলাম গেলো রব উঠলো, এ নিয়ে সরকারের পক্ষে কেউ একজন কথা বলুন। র্যাব-পিবিআই এত তদন্ত করে! এ বিষয়গুলোর দ্রুত তদন্তের কেনো ওহী নাই? কথা না বললে কি এসব থামবে? অন্ধ হলে কি বন্ধ থাকে প্রলয়।
নগরে আগুন লাগলে কি পোড়েনা মসজিদ! না মডেল মসজিদ সব অগ্নিপ্রুফ? দেশজুড়ে হিন্দুদের ওপর হামলা হয়রানি বন্ধ করুন। জো বাইডেন আপনাদের দরকার না হলেও নরেন্দ্র মোদীর দরকার আছে। সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন এভাবে বাড়তে থাকলে কেউ বাঁচবেননা। অতএব সাধু, সাবধান।