ফজলুল বারী: গন্ডারের চামড়ার চেয়েও বেশি পুরু এখন আমাদের সবার চামড়া! গন্ডারকে কাতুকুতু দিলে সে নাকি তিন মাস পর টের পায়। তখন সে হাসে। আর দেশের পুলিশ যে আমাদের কুতুকুতি দিয়ে তাদের ক্ষমতা দেখাচ্ছিল তা আমরা টের পেয়েছি তা দুই বছরেরও বেশি সময় পর!
নতুবা একলা এক মা যে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি মাঠ রক্ষার আন্দোলন করে যাচ্ছিলেন তা আমরা এত দিনেও কেনো টের পাইনি! এখন জানা যাচ্ছে কলাবাগানের ওই মাঠ পুলিশ গোপনে ঢাকার জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে পেয়েছে ২০২০ সালে! পুলিশই জায়গাটি পছন্দ করেছে।
সেই থেকে মাঠটি রক্ষার জন্যে এক মা সৈয়দা রত্মা তাঁর বান্ধবীদের নিয়ে আন্দোলন করে আসছেন। কারন মাঠটি নিয়ে তাঁর অনেক স্মৃতি। তাঁর শৈশবে মাঠটি অনেক বড় ছিল। এই মাঠে খেলে তাঁর ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। ২০১৩ সালে তাঁর স্বামী মারা যাবার পর এই মাঠেই তাঁর জানাজা হয়েছে।
এরমাঝে মাঠরক্ষার আন্দোলন করায় পুলিশ গত ৩১ জানুয়ারি কয়েক শিশুকে কান ধরে উঠবস করায়! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে ঘটনা ভাইরাল হলে পুলিশের চার সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু তখনও আমরা টের পাইনি আসল ঘটনা! গন্ডারের চেয়েও এখন এমনই পুরু চামড়া আমাদের!
এরপর সেই প্রতিবাদী মা সৈয়দা রত্মা, উদিচীর সদস্যা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক মানুষের শ্রদ্ধেয়া রত্মা আপা, ফেসবুকে পেজ খুলে পাড়ার ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠ রক্ষার আন্দোলন করে যেতে থাকেন। সর্বশেষ রবিবার এ নিয়ে ফেসবুক লাইভ করতে গেলে পুলিশ তাকে আটক করে।
কারন একটা মাঠ গিলে খাওয়া পুলিশের এই একলা মাকে নিয়েই ছিল যত ভয়। তাঁকে টানাহেঁচড়ায় একটা স্যান্ডেল পায়ে পুলিশ তাকে গাড়িতে তোলে। মাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে খবর পেয়ে বাসা থেকে বেরুলে পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁর সতের বছর বয়সী ছেলে প্রিয়াংশুকে!
মাঠ রক্ষা আন্দোলনের ওয়ান ওমেন আর্মি সৈয়দা রত্মা ওরফে সবার রত্মা আপা তখনও জানেননা তাঁর আন্ডারএজ সন্তান প্রিয়াংশুকে গ্রেফতারের খবর। কলাবাগান থানার পুলিশের মনের মতোই নোংরা গন্ধযুক্ত মহিলা হাজতখানা। পোকামাকড়ের ঘরবসতি! পুরুষ হাজতখানা–মহিলা হাজতখানা মুখোমুখি।
আটক সৈয়দা রত্মাকে থানার মহিলা হাজতখানায় ঢোকানোর সময়ই তিনি দেখেন তাঁর নয়নের মনি সন্তান প্রিয়াংশুকেও ধরে এনেছে পুলিশ! হলুদ টি–শার্ট পরা হিমুর মতো তাঁর সন্তান প্রিয়াংশুকে বন্দী দেখে চিৎকার করে ওঠেন মাঠ রক্ষার মা। এটা কি করেছেন আপনারা?
আমার আন্ডারএজ ছেলে এখানে কেনো বন্দী? তাকে কেনো ধরে এনেছেন। সেতো অপ্রাপ্ত বয়স্ক। এভাবে একটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরকে মা সহ গ্রেফতার করাতেইতো মুখোশ খসে পড়ে পুলিশের। এ নিয়ে এমন চমৎকার ধরা খাওয়ার ব্যবস্থার জন্যে কলাবাগান থানার ওসি পরিতোষ চন্দ্রকে অনেক ধন্যবাদ।
কারন তিনি এই প্রতিবাদী মা, তাঁর সন্তানকে এভাবে আটক না করলে পুলিশের একটি খেলার মাঠ গিলে খাবার বিষয়টি দেশের মানুষের সামনে এভাবে একদম প্রকাশই পেতোনা। অতঃপর জানা গেলো ঢাকার জেলা প্রশাসন থানা ভবন বানাতে ওই মাঠের মালিকানা গোপনে ২০২০ সালে পুলিশকে দিয়েছে!
একটা এলাকার বাচ্চাদের একটি খেলার মাঠ, এলাকার ঈদ জামাত–জানাজার নামাজের মাঠ জেলা প্রশাসন কাউকে লিখে দিয়ে দেবে এ নিয়ে এলাকার মানুষের সঙ্গে আলাপের–গণশুনানির সামান্যতম সৌজন্যও বোধ করলোনা! এলাকার এমপি–ঢাকার মেয়র সবাই মিলে বিষয়টি চেপে গেছেন!
এভাবে পুলিশ–জেলা প্রশাসন মিলে ঢাকার একটি এলাকার মানুষের শ্বাস–প্রশ্বাসের জায়গাটি যে ডাকাতি করেছে তাও জানা গেল এক মায়ের আন্দোলন, সন্তান সহ গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে দেশ হৈচৈ করা সামাজিক আন্দোলনে তাদের মুক্তির পর, পুলিশ মন্ত্রী– স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জবানিতে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যে খেলাধুলা করেছি, সেই অবস্থাটা এখন আর নেই। আমরা সে জন্যে কষ্টবোধ করি পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে’। কিন্তু তাঁর মাথায় এলোনা এমন একটি মাঠ এভাবে সবাইকে অন্ধকারে রেখে গায়ের জোরে ডাকাতি করা যায়না।
সামাজিক সম্পত্তি কাউকে দিতে সমাজের বাসিন্দাদের সঙ্গে গণশুনানি করতে হয়। মাঠ ডাকাতির বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ার পর মন্ত্রী বলেছেন, ‘শিশু–কিশোরদের খেলার মাঠের জন্যে বিকল্প জায়গা খুঁজতে সবাইকে বলা হয়েছে’। মানে এই মাঠ আর এলাকার ছেলেমেয়েরা ফেরত পাচ্ছেনা!
অথচ অনেকে ভুল বুঝে এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অভিনন্দনও জানিয়ে ফেলেছেন! এই মাঠ রক্ষার আন্দোলন যে দেশের মানুষকে এমন নাড়া দিয়েছে তা প্রকাশ পেয়েছে আব্দুল গাফফার চৌধুরীদের বিবৃতিতেও। আব্দুল গাফফার চৌধুরী, রামেন্দু মজুমদার, সানোয়ার আলী, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবীরদের চেয়ে এই সরকারের ঘনিষ্ঠ আর কে আছেন?
আজকাল এই নাগরিকরা সরকারের বিপক্ষে যাবে এমন বিবৃতি সহজে দেননা। তারাও এবার বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘প্রশ্ন জাগে যে কোন প্রকার প্রতিবাদ করলে সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রতিবাদকারীকে এ দেশে গ্রেফতার হতে হয়। এভাবে মতপ্রকাশে বাধা দেশকে স্থবির করে দিচ্ছে’।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বান্ধবী সুলতানা কামাল সহ ৩৬ বিশিষ্ট নাগরিক দিয়েছেন পৃথক বিবৃতি। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘আন্দোলনকারী নারী ও তাঁর কিশোর ছেলেকে আটক ও তুলে নিয়ে যাওয়া এবং মাঠ দখলের প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে যে ‘জোর যার মুল্লুক’ নীতিরই নিন্দনীয় প্রতিফলন ঘটিয়েছে, তা স্পষ্ট।
সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য ভুল বোঝে মন্ত্রী দাবি মেনে নিয়েছেন বলে অনেকে পোষ্ট দিতে থাকেন ফেসবুকে। আদতে মন্ত্রী বলেছেন, খেলার মাঠের জন্যে অন্যত্র জায়গা খুঁজতে বলা হয়েছে। এরজন্যে আন্দোলনের মধ্যে সেই খেলার মাঠে মঙ্গলবারও থানা ভবন নির্মান কাজ বন্ধ রাখা হয়নি।
পুলিশ প্রহরায় মঙ্গলবারও সেখানে সীমানাপ্রাচীর নির্মান চলছিল। অতএব প্রিয়াংশু, মা সহ বন্দী হয়ে যতই তোমরা ভাইরাল হয়ে মুক্তি পাও না কেনো ওই মাঠ তোমরা ফেরত পাচ্ছোনা। কারন তোমাদের খেলার মাঠের চাইতে ওখানে বসে তোমাদের শাসনের জন্যে জায়গাটা পুলিশের বেশি প্রয়োজন!