ফজলুল বারী:এবার ঈদ যাত্রায় অনেক স্বস্তির গল্প ছিল। মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার মোবাইল ফোনের সিম গুনে গুনে দেখিয়েছেন ঈদে কত মানুষ বাড়ির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন। হয়তো এই সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি ছিল। কারন দেশের অনেক মানুষ এখনও মোবাইল ফোন ব্যবহার করেননা।
তাদের মধ্যে অনেক দাদা–দাদি, নানা–নানি সহ বয়স্ক ব্যক্তি অথবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু সহ অনেকে আছেন। এরপরও অন্য বছরের তুলনায় এবার ট্রেন–বাস–ট্রাক–প্রাইভেট কার–মাইক্রোবাস–লঞ্চে ঈদ যাত্রার অনেক কিছুতে স্বস্তির খবরও কিন্তু সত্যি। ট্রেনের অগ্রিম টিকেট পর্বটি ছিল যথারীতি এনালগ ও অস্বস্তির।
ট্রেনের অগ্রিম টিকেট করতে এসে বাংলাদেশের হতভাগ্য একেকজনের যত সময় লেগেছে, এই সময়ের পৃথিবীতে অস্ট্রেলিয়া–আমেরিকারও দূরবর্তী গন্তব্যে আরও কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। টিকেট কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত ধার্মিক চেহারার এক ভন্ডকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
হেডফোন কানে লাগিয়ে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণরত এক যুবকের সেতুতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে করুন মৃত্যুর ঘটনা প্রমান করে ট্রেনের ছাদে চড়ে বেআইনি ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ শতভাগ বন্ধ করা যায়নি। পর্যাপ্ত যানবাহন না থাকার কথা বলে ঈদ–এজতেমার সময়ে ট্রেনের ছাদে করে ভ্রমণ অনেক ক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্যও।
হাল আমলের পৃথিবীতে মোটর সাইকেলে ভ্রমণ ও দূর্ঘটনায় মৃত্যুর হার দুটোই বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় সাম্প্রতিককালে মোটরবাইক দূর্ঘটনায় জড়িতদের সিংহভাগ বিদেশী ছাত্রছাত্রী। যারা এখানে উবার ইট–স, মনোলোগ সহ বিভিন্ন কোম্পানির হয়ে ফুড ডেলিভারির কাজ করেন।
বাংলাদেশে এক সময় সাতক্ষীরা এলাকায় সাইকেল–মোটর সাইকেলে বাড়তি আসন বসিয়ে অনেকে যাত্রী পরিবহনের কাজ করতেন। এগুলোর স্থানীয় নাম ছিল হেলিকপ্টার। এখন উবার সহ দুনিয়াব্যাপী টেক্সির বিকল্প রাইড শেয়ারিং এর যুগে সেই হেলিকপ্টার ‘পাঠাও’ সহ নানান নামে শহরগুলোতে এসেছে।
যেহেতু বাংলাদেশ দেশটি আর আইনানুগ নয়, তাই সিএনজির মতো মোটরবাইকের রাইড শেয়ারিং’ও বাংলাদেশে এখন আর মিটারে চলেনা। যানজটের শহরে যাত্রী সাধারনও এদের হাতে এক রকম জিম্মি। চলাচলে আইন না মানার কারনে এগুলো প্রায় দূর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।
ঈদের সময়ের যাতায়াতে মোটরবাইক দূর্ঘটনা–বিপুল মৃত্যুর ঘটনাগুলো সব আনন্দকে মাটি করেছে। নানান অভিযোগেরর বাইরে এসে ট্রেনে ঈদ যাত্রার শুরুতে সময় ধরে চলাচলের প্রশংসা করছিলেন যাত্রীরা। কিন্তু বাংলায় যে একটা কথা আছে, ‘সুখে থাকলে ভূতে কিলায়’!
ঈদের ট্রেন জার্নির সব সাফল্যকে ম্লান করেছে মন্ত্রীর স্ত্রীর ভাগ্নে পরিচয়ে বিনা টিকেটে ভ্রমনের ঘটনা। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের প্রথম স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। বিনা টিকেটে ভ্রমনকারী তিনজন মন্ত্রীর প্রথম না দ্বিতীয় স্ত্রীর ভাগ্নে সে তথ্য রিপোর্টে আসেনি।
ঈশ্বরদী স্টেশনে তারা বিনা টিকেটে ট্রেনে চড়ে প্রথম শ্রেনীর কক্ষ দখল করেছিলেন। কারন তারা যে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর ভাগ্নে! সাধারনত ট্রেনের প্রথম শ্রেনীর কক্ষে যাত্রী সেবায় সর্বক্ষণিক এটেন্ডেন্ট থাকেন। বিনা টিকেটের যাত্রী দেখে সেই কক্ষের এটেন্ডেন্ট ডেকে আনেন টিকেট চেকার টিটিইকে।
মন্ত্রীর স্ত্রীর ভাগ্নে পরিচয়ে বিনা টিকেটে ভ্রমণকারী সেই তিন যাত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার আগে টিটিই মোঃ শফিকুল ইসলাম তার উর্ধতন কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে নেন। জরিমানা সহ তাদেরকে সাধারন শ্রেনীর টিকেট করে দেয়া হয়। বিদ্যমান বাংলাদেশে এটা কি দুঃসাহস বৈকি একজন টিটিই’র পক্ষে!
মন্ত্রীর স্ত্রীর ভাগ্নে জেনেও জরিমানা আর প্রথম শ্রেনীর কক্ষ ছাড়তে বলা! এ নিয়ে তারা মন্ত্রীর স্ত্রীর ভাগ্নে পরিচয়ে টিটিই’র সঙ্গে গরম দেখান! প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এটেন্ডেন্ট। অস্ট্রেলিয়া হলে ট্রেন থামিয়ে রেখে সঙ্গে সঙ্গে ট্রিপল জিরোতে ফোন করে এদেরকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হতো।
কিন্তু এই তিন কথিত মন্ত্রী ভাগ্নে কমলাপুর স্টেশনে নেমে উল্টো টিটিইর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন! এর আগে তারা এ নিয়ে মন্ত্রী অথবা তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন কিনা জানা যায়নি। এদেরকে আইনত এখনও গ্রেফতার করা যায়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ উল্টো মুঠোফোনে টিটিইকেই বরখাস্ত করেছেন!
আগে বরখাস্ত, পরে শো’কজ! এটাই রেল কর্তৃপক্ষের দুষ্টের দমনন শিষ্টের পালন নীতি! উল্টো টিটিইর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যাত্রীর সঙ্গে অসদাচরনের! বাহ রেলওয়ে বাহ! কর্তৃপক্ষের ভাগ্য ভালো এমন জুলুমের প্রতিবাদে এতক্ষণে সব টিটিই সহ রেল কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করে দেয়নি!
যাত্রীদের সঙ্গে রেলওয়ের অনেক কর্মকর্তা কর্মচারীদের অসদাচরনের অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু এমন অসদাচরনের অভিযোগে রেল কর্তৃপক্ষ এর আগে কখনও কোন কর্মচারী বা টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে সাম্প্রতিককালে রেলওয়ের কার্যপ্রনালী–ইতিহাস ব্যাপক পড়তে হবে।
কিন্তু ওই টিটিই’র বিরুদ্ধে যে জুলুম হয়েছে, এর মাধ্যমে সব টিটিইকে দেয়া হয়েছে বিশেষ এক বার্তা! অর্থাৎ মন্ত্রীর শ্যালক–ভাগ্নে–ভাতিজা পরিচয়ে বিনা টিকেটের কোন যাত্রীকে প্রথম শ্রেনীতে ভ্রমনে পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবেনা! এ ঘটনা দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছে।
কিন্তু রাষ্ট্রের যে চরিত্র এর কারনে এরপরও সংশ্লিষ্ট টিটিইর বিরুদ্ধে আসতে পারে আরও শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত! ওই ঘটনা নিয়ে মিডিয়ার সঙ্গে সত্য কথা বলায় তার বিরুদ্ধে আরও শাস্তির ব্যবস্থা হতে পারে। মোট কথা ঈদে রেলওয়ের সমস্ত ভালো কাজকে কালিমা দিয়েছে এই একটি ঘটনা।
এটা রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের পতন অথবা বিদায় ঘন্টা বাজার ঘটনাও বলা যেতে পারে। পতন সমূহ কিন্তু এভাবেই আসে। এই পতন অথবা বিদায় ঠেকাতে দ্রুত একটি কাজ করতে পারেন রেলমন্ত্রী। কাজটা করতে হবে মিডিয়ার লোকজনকে ডেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অথবা রেলভবনের মিলনায়তন কক্ষে।
মিডিয়ার সামনে ঘটনার জন্যে সেই টিটিইর হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে তার বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে হবে। রেলমন্ত্রীর ভাগ্নে শুনেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ায় পুরস্কৃত করতে হবে সেই টিটিইকে। আইন লংঘন ও টিটিইর সঙ্গে বাদানুবাদের দায়ে কথিত তিন ভাগ্নেকে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে।
মন্ত্রী যদি এই কাজগুলো করেন তাহলে এতে তার ও সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে। জানি, বাংলাদেশের প্রচলিত কাঠামোয় রেলমন্ত্রী এর একটিও করবেননা। মন্ত্রিত্বের গরম যে তারও আছে। এর দায় যাতে সরকারের ঘাড়ে না আসে এরজন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিকল্প কাজটি করতে পারেন।
রেলমন্ত্রী ঘটনার জন্যে দূঃখ প্রকাশ–ক্ষমা প্রার্থনা করে বেআইনি ভ্রমণের সঙ্গে জড়িত স্ত্রীর ভাগ্নেদের আইনের হাতে সোপর্দ না করলে তাকে বরখাস্ত ও সেই টিটিইকে পুরস্কৃত করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। এতে করে তাঁর ও সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে।
ঈদের ছুটিতে আরেকটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সারওয়ার আলমকে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়! নানান অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম এখন এক রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় মন্ত্রণালয়ে নিষ্কর্মার ভূমিকায় আছেন!
তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে লেখায় একজন মন্তব্য করেছেন, ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম সরকারি চাকুরিবিধি পড়েননি। এরজন্যে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াটা ঠিকই হয়েছে! এর জবাবে লিখেছিলাম, আজকাল অনেক সরকারি কর্মকর্তা রাজনৈতিক নেতার মতো বক্তৃতা দেন। কারন তারা চাকরিবিধি পড়েছেন!
সয়াবিন তেলের দাম লিটারে এক লাফে ৩৮ টাকা বাড়ানো, জাফলং’এ পর্যটকদের ওপর হামলা ঈদের ছুটির মধ্যে আরও দুটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে সারা বিশ্বে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার একটি রাজনৈতিক সরকারের মতো এটিকে হ্যান্ডেল করতে পারছেনা।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ সরকার নানাভাবে রাজনৈতিক দল ও সরকারের চরিত্র হারিয়েছে। সারাক্ষণ অমুক অমুককে ধমকের মধ্যে রাখাই একটি রাজনৈতিক সরকারের আসল কাজ নয়। কেন যেন তাদের অনেককে আজকাল অনেক নির্লিপ্ত–পরিশ্রান্ত মনে হয়!
দেশের মানুষকে রাজনৈতিকভাবে আস্থায় রাখার চেষ্টাটাই এখন যেন তাদের নেই। বাসে–গাড়িভাড়া করে জাফলং সহ পর্যটন স্পটগুলোতে ঘটা করে যেতে পারলে দশ টাকা প্রবেশমূল্য কেনো দেয়া যাবেনা, এর বিনিময়ে পর্যটন স্পটগুলোকে কি কি অবকাঠামো করা হবে, তা নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়নি।
পর্যটন স্পটে পর্যটকদের ওপর হামলা একটি আত্মঘাতী ঘটনা। হামলাকারীদের অতিদ্রুত গ্রেফতার করা হয়েছে ভালো কথা। পর্যটন স্পটগুলোর ব্যবসা সহ সংশ্লিষ্ট লোকগুলোর পর্যটন বান্ধব প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করুন। পর্যটক সহ সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে।
পর্যটন বান্ধব প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, পথঘাট, শৌচাগার, থাকার মতো মান সম্মত হোটেল–রেষ্টুরেন্ট নেই, যা আছে সেগুলোর নেই পর্যটন বান্ধব পরিবেশ, আবার ‘ভাত দেবার মুরোদ নেই কিল মারার গোসাইদের’ দিয়ে পর্যটন চলবেনা। সবাই যার যার অবস্থান নিয়ে আত্মসমালোচনা করুন প্লিজ।