ফজলুল বারী: শুরুর সম্পর্কটা ফোনে। বিচিন্তা অফিসে তাঁর ফোন আসতো নিয়মিত। মিনার কী আছে না বাইরে চলে গেছে। মিনার মাহমুদের খোঁজে কথোপকথন শুরু হলেও কথা চলতো আমাদের অনেককে নিয়ে। আমরা তখন ঢাকা শহরে এবং দেশে বিচিন্তার নামে একটি বিপ্লবের বেশকিছু চরিত্র।
মিনার মাহমুদ আমাদের নেতা। দিলু রোডের বিচিন্তা অফিসে আমি, আমিনুর রশীদ, আনোয়ার শাহাদাত তিনজন সর্বক্ষনিক আবাসিক সাংবাদিক। অন্য অনেকের আসা যাওয়া চলতো। কাজ-আড্ডাতো আছেই, এর পাশাপাশি আরেকটা আকর্ষন ছিল এ অফিসটার। এখানে অনেক মানুষের রান্না হতো প্রতিদিন।
পত্রিকার পেস্টিং এর দিন খাবার দাবার পিঠা ঘর থেকে খাবার পাঠাতেন ফরিদুর রেজা সাগর ভাই। আজ তাঁর চ্যানেল আই সহ অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তখন আলোচিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল বঙ্গবন্ধু এভিন্যুর খাবার দাবার পিঠা ঘর। পাশাপাশি শান্তিনগরের এক চিলতে ঘরে ভিডিওর দোকান ইম্প্রেস ভিডিও।
বিয়ের অনুষ্ঠান রেকর্ডিং’এ যেত ইম্প্রেস ভিডিও। সেটিই ক্রমে ক্রমে ইম্প্রেস ভিডিও ও টেলি ফিল্ম হয়ে আজকের চ্যানেল আই সহ বিশাল মিডিয়া মোঘল। তখন সাগর ভাই’র পাঠানো পেস্টিং মেন্যুর খাবারের জন্যেও পেস্টিং এর দিন অনেক তরুন সাংবাদিক বিচিন্তা অফিসে আসতেন।
আমাদের শুরুর সময়ে আমাদের বয়সী সংগ্রামীদের ঢাকার কোথাও একবেলা ফ্রি খেতে পাওয়াও কিন্তু অনেক বড় কিছু ছিল। বিচিন্তায় যারা আসতেন কোয়ালিটির কারনে তারাই মূলত তুমুল ওই সময়কার উদীয়মান প্রতিভা। তারাই বা তাদের অনুসারীরাই এখন মূলধারার মিডিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
যে ফোনের কথা বলছিলাম। প্রথমে খোঁজ নিতেন মিনার ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে কিনা, তোমরা ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতো। তোমরা অনেক ভালো কাজ করছো। তোমাদের ভালো খাওয়া দাওয়াও করা চাই। মিনার এলে বলবে আম্মা ফোন করেছিলেন। জি আম্মা বলবো।
নাম জিজ্ঞেস করলেতো উচ্ছ্বাস থামেনা। তুমি ফজলুল বারী, তুমি সেই ছেলে যে সারাদেশ পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়িয়েছো। মিনার তোমার কথা খুব বলে, তোমার প্রজন্মের পরিভ্রমণ আমি নিয়মিত পড়ি। ইনিই আমাদের আম্মা তথা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
বিচিত্রার শাহাদাত চৌধুরী শহীদ রূমির সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে শাহাদাত চৌধুরী, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সহ রূমির সহযোদ্ধারা রূমির মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আম্মা ডাকতে শুরু করেন। শাহাদাত চৌধুরীর সঙ্গে বিচিত্রার সব সাংবাদিকরা তাকে ডাকতেন আম্মা।
বিচিত্রার মিনার মাহমুদ বিচিন্তা বের করলে নতুন হাউসের সব সাংবাদিকেরও তিনি আম্মা হয়ে ওঠেন। এভাবে প্রিয় প্রজন্মের সব সাংবাদিকের কাছেও তিনি ছিলেন আম্মা। প্রিয় প্রজন্মের জমানায় যেহেতু গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার হয় সেখানে আম্মার আন্দোলনে আমাদের অংশগ্রহন অন্য রকম ছিল।
শুরুর দিকে বিচিন্তায় আনোয়ার শাহাদাতের কাজ ছিল বিখ্যাত বইগুলো পড়ে রিভিয়্যু লেখা। একাত্তরের দিনগুলি’র রিভিয়্যু লিখে আনোয়ার শাহাদাত শুধু আম্মার কাছে না, বিচিন্তার পাঠকদের কাছেও তুমুল পরিচিত। আমিনুর রশীদের এমন একটি পাঠক প্রিয় কাজ ছিল মার্শাল ল’ ইনভেষ্টিগেশন রিপোর্ট।
এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারির পর ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন করেছিল। সে রিপোর্ট অনুবাদ করে আমিন ধারাবাহিক লিখছিলেন। তখন এসব লেখা-ছাপার সাহস সবার ছিলোনা। আমরা তখন একদল সৃষ্টি সুখের উল্লাসী। আমাদের আবার ভয় কিসের।
এভাবে সাহস দেখাতে দেখাতে প্রতি সপ্তাহে শুধুই প্রচার সংখ্যা বাড়ছিল বিচিন্তার। এরশাদও আর সহ্য করলোনা। একদিন বিচিন্তা নিষিদ্ধ করে দিলো! এই যে আমাদের পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছে, এই যে আমরা বেকার হয়ে গেলাম, এসব ভেবে থেমে যাবার বয়স তখনো আমাদের হয়নি।
বন্ধ বিচিন্তার নামে স্টল নেয়া হয়েছে বাংলা একাডেমির বইমেলায়। স্ট্যাচু অব লিবার্টির চোখ বেঁধে আমাদের পোস্টার, ‘আমাকে লিখতে দাও, আমাকে বলতে দাও’। বইমেলা থেকেই গ্রেফতার করা হয় মিনার মাহমুদকে। তখন বাংলা একাডেমির বইমেলার বিচিন্তার স্টলকে কেন্দ্র করে ভিড় আরও বাড়ে।
আমরা বিক্রি করি বিচিন্তার পুরনো সংখ্যা, মিনার মাহমুদের বই ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ আর নিষিদ্ধ বিচিন্তার পোস্টার। মেলায় এলেই বিচিন্তার স্টলে আসতেন আম্মা। আমাদের সাহস দিতে আসতেন। এরশাদ আমলে আর বিচিন্তা বেরোয়না। আমাদের দলটাও ভেঙ্গে যায়।
কিন্তু মিনার মাহমুদের সঙ্গে, আম্মার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অটুট থাকে। এরশাদের পতনের পর সবাই বিজয় উৎসব নিয়ে ব্যস্ত। ওই সুযোগে জামায়াত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দলের আমীর ঘোষনা করে। কেউ প্রতিবাদ করেনা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় উৎসবে বিস্ফোরিত হন আম্মা।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন শহীদ জননী। ‘আমার সন্তানদের আমি নির্দেশ দিচ্ছি, তোমরা এর প্রতিবাদ করো। প্রতিরোধ গড়ে তোলো’। আমার হাতে ছোট্ট একটা টেপ রেকর্ডার ছিল। যা চলতো পেন্সিল ব্যাটারিতে।
কিন্তু আমার টেপ রেকর্ডারে থাকা ব্যাটারি যে পুরনো, অকেজো ছিল। তাতে যে রেকর্ড হয়নি তা বুঝতে পেরেছি পরে, সর্বনাশ হবার পর। শহীদ মিনারের সেই আহবানের ফলোআপে সিদ্ধেশ্বরীর আমিনাবাদ কলোনীতে কর্নেল (অবঃ) কাজী নুরুজ্জামানের বাসার ধারাবাহিক বৈঠকে গঠিত হয় নতুন সংগঠন, ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
এখানকার উদ্যোক্তাদের অনেকে চীনপন্থী হওয়াতে আওয়ামী লীগাররা পাল্টা সংগঠন গড়েন অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীর নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ। দুই সংগঠন মিলে পরে গঠন করা হয় জাতীয় সমন্বয় কমিটি। আওয়ামী লীগ চেয়েছিল এই সংগঠনের নেতৃত্বে থাকবেন কবি সুফিয়া কামাল।
কিন্তু সুফিয়া কামাল প্রস্তাব করেন, জাহানারাই নেতৃত্বে থাকুক। আমি সহযোগিতা করবো। এই আন্দোলনে আমাদের সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্মের ভূমিকা ছিল ভ্যানগার্ডের। আমাদের সাংবাদিকরাই ছিলাম আন্দোলনের কর্মী। গণআদালতে গোলাম আযমের ফাঁসির দিন টেলিগ্রাম বের করেছিল প্রিয় প্রজন্ম।
অনেক কাহিনী। সব লিখতে কয়েকদিন লাগবে। মজার ব্যাপার তাঁর সঙ্গে আমার কোন ছবি নেই। আমরা এমন সময় সাংবাদিকতায় এসেছি এভাবে যে ছবি তুলে রাখতে হয় তা তখন জানতামনা বা ভাবতামনা। এমন কত মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি। তাদের সঙ্গে কখনও কোন ছবি তুলিনি।
৩ মে ছিল আম্মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জন্মদিন। আমেরিকার হাসপাতালে ক্যান্সারে তাঁর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিচার হয়েছে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর।
যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিকে কেন্দ্র করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠলে প্রতিবাদ বিস্ফোরিত হয়েছে আম্মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে। মৃত্যু শয্যা থেকে তাঁর শেষ নির্দেশের চিঠি হয়েছে আন্দোলনের ইশতেহার।
এভাবে বহু বছর পর মানুষ আবার দেখেছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ জননীর আন্দোলন স্থিমিত করা যেতে পারে, কিন্তু তা ধংস করা যায়না। অনেক ভালো থাকবেন আম্মা। আপনার সন্তানরা জেগে আছে, জেগে থাকবে কালের পরিক্রমায়। অনন্ত কালের তরে গৌড় মন মধু করে, পান করি করিবেক, যশস্বী তোমারে।