ফজলুল বারী: আওয়ামী লীগের এখনকার নেতারা এমপি–মন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনার কারনে। শেখ হাসিনাই তাঁর টোয়েন্টিফোর সেভেন পরিশ্রম আর একাগ্রতায় এই দলটিকে ক্ষমতায় এনেছেন, ক্ষমতায় ধরে রেখেছেন। আর কিছু আবালকে মন্ত্রী করেছেন তাঁকে নিয়মিত গালি খাওয়ানোর জন্যে!
সাম্প্রতিক রেল–বানিজ্য–কৃষিমন্ত্রীগং এমন কিছু মন্ত্রী। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দেখিয়েছেন তাঁর বহু বিবাহ করা বর্তমান স্ত্রী বেগম রেলমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে কিভাবে রেলওয়ের কর্মকর্তার চাকরি খাওয়ারও যোগ্যতা রাখেন! বিনা টিকেটে তার আত্মীয়–পরিজনকে রেলভ্রমনের দিতে হবে অধিকার!
মন্ত্রীর এ যাত্রার নয় মাসের বৈবাহিক জীবনে তার এই স্ত্রী আর কী কী অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন, তাও হয়তো একদিন জানা যাবে। কিন্তু দিন শেষে এসবের সব দায়–গালি যে গিয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। কারন শেখ হাসিনাই এমন কথিত ‘বিজ্ঞজন’দের মন্ত্রী করেছেন।
এই কথিত ‘বিজ্ঞ’রা একবারও ভাবেননা বা লজ্জিত হননা যে তাদের জন্যে তাদের নেত্রী শেখ হাসিনাকে দেশের মানুষের কাছে প্রতিদিন ছোট হতে হচ্ছে, গালি খেতে হচ্ছে! সরকারের তেমন আরেকজন ব্যর্থ মন্ত্রীর নাম বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি। আজ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় পরিচালনায় তার কোন মুন্সিয়ানা কেউ দেখলোনা।
পিঁয়াজ–তেল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার–পণ্যমূল্যের তদারকি শুধু চায় দেশের মানুষজন। বেশিরভাগ মানুষের দিন আনি দিন খাই জীবন। তাদের নিত্য ভোগ্যপণ্যের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের কোন বার্ষিক প্ল্যান আছে কিনা, তা আজ পর্যন্ত কেউ দেখলোনা–জানলোনা।
ইউক্রেন যুদ্ধের জন্যে দুনিয়াব্যাপী ভোজ্যতেল–আটা সহ নানান ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির। রুটি যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য নয়, তাই আটার দাম কোথায় কত বাড়লো তা আমাদের বেশিরভাগ মানুষের জীবন প্রনালীতে খুব একটা প্রভাব ফেলেনা।
কিন্তু তেল–পিঁয়াজের সরবরাহ–দামে হেরফের হলে লংকাকান্ড বেধে যায়। আর বাংলাদেশের বাজার ওলটপালট করে দিতেতো ইউক্রেন যুদ্ধ লাগেনা। বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি ব্যবসায়ী হিসাবে নিজে কিভাবে দাম বাড়ান সে অভিজ্ঞতা লাগিয়েওতো দয়া করে শেখ হাসিনাকে একটু কম গালি খাওয়ানোর কথা ভাবতে পারতেন।
তিস্তার পানিতো আর আসবেনা কোনদিন। এরসঙ্গে ভারতের পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনা ঘটেছে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা শিরোনাম করেছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনের হেঁসেল তথা রান্নাঘরকে কম পিঁয়াজে অথবা পিঁয়াজ ছাড়া রান্না করতে বলেছেন।
পিঁয়াজ ইস্যুতে বাংলাদেশে ভারত বিরোধী রাজনীতি–প্রচারনা আরেক দফা গতি পায়। মিয়ানমার, এমনকি মিশর থেকেও পিঁয়াজ আমদানি হয়েছে কৃষির দেশ বাংলাদেশকে। কিন্তু কিছু লোকজনের যে ভারতীয় গরুর মতো পিঁয়াজও পছন্দ! ভারতীয় পিঁয়াজের তেজ তারা মিয়ানমার–মিশর ঘুরেও পায়না!
পরিবহন সহ নানা কারনে ভারতের পিঁয়াজ তুলনামূলক সস্তাও। করোনার ভ্যাকসিনও শুরুতে বাংলাদেশ সস্তায় খুঁজছিল। সিরাম ইন্সটিটিউটের সস্তা ভ্যাকসিন খুঁজতে গিয়ে এক তরফা ভারত নির্ভরতার মাশুল পিঁয়াজের পর করোনার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।
আবার ভারত পিঁয়াজ রপ্তানি শুরু করলে বাংলাদেশের বাজার স্থিতিশীল হয়। এভাবে পিঁয়াজ ইস্যুতে কত মানুষ, নিম্নবিত্ত–মধ্যবিত্তের কতবার কতভাবে যে পকেট কাটা গেছে! খসেছে কত হাজার কোটি টাকা! গালিটা কিন্তু শেখ হাসিনার বরাত থেকে মিস যায়নি। কারন তিনি যে এদের মন্ত্রী–সচিব করেছেন।
আজ পর্যন্ত দেশের মানুষ পূর্নাঙ্গভাবে জানলোনা সারা বছর কোন আমদানি পণ্য কখন কোথা থেকে আসবে যাবে এসব নিয়ে এদের প্ল্যানটা কী? অথবা আদৌ কোন প্ল্যান আছে কীনা! অমর্ত্য সেন’এর তত্ত্বের কত প্রচার হলো, ‘তথ্য প্রবাহ অবাধ থাকলে কোথাও সংকট হয়না’। কিন্তু প্রয়োগ হলোনা!
ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোকে কেন্দ্র করে বানিজ্যমন্ত্রী–কৃষিমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে কান্না শুরু করে দিয়েছিলেন! ‘দাম না বাড়ালে গোস্বা করে বাবু’রা যদি আর তেল আমদানি না করে’? এভাবে বারবার করে দাম বাড়ানো হলো! কিন্তু ফলাফলটা কী?
রোজার ঈদের আগে সবাই যখন বাড়ি যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত, তখন বানিজ্য–কৃষিমন্ত্রীর আদর–সোহাগ প্রাপ্ত বিশিষ্ট মজুতদাররা হঠাৎ করে বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও করে দেন! ১/১১’র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপির নেতা–এমপিদের বাড়ির পুকুর থেকে শুধু ঢেউটিন উদ্ধার হচ্ছিল।
‘তাহাদের সকলের বাড়ির পুকুর সমূহ ঢেউটিনের আশ্চর্য খনি হইয়া উঠিয়াছিল’!
এবার সয়াবিন তেলের সংকটের সময় বাদাম তেল ব্যবহার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ট্রল হয়েছে। কারন বাদাম তেলের লিটার হাজার টাকা। কিন্তু বানিজ্যমন্ত্রী–কৃষিমন্ত্রীর প্রিয়ভাজন ব্যবসায়ীদের গুদাম থেকে যে শুধু লুকানো সয়াবিন তেলের খনি বেরুচ্ছে এ নিয়ে তাদের মুখে কোন ‘রা’ আছে?
পাঁচদিনে দেশজুড়ে উদ্ধার হয়েছে সাত লাখ লিটার সয়াবিন তেল! সুশাসন বাবু এখন কোথায় ঘুমান? বিএনপি আমলে যদি এমন ঘটনা ঘটতো আওয়ামী লীগ কি ছেড়ে কথা বলতো? এখন অসহায় মানুষ কিছু করতে পারেনা। চোখ মুছে আর মনে মনে গালি দেয়। কি আর করবে।
কারন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গালি খাওয়ানো আর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাভ গোনা ছাড়া তাঁর মন্ত্রীদের যে কোন মিশন–ভিশন নেই! এভাবে কিন্তু কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক তার নানা বাড়িতেও মিন্টো রোডের মন্ত্রিপাড়ার বাড়ির আদলে প্রাসাদ গড়েছেন!
প্রশ্ন করবেনা। উত্তর পাবেন, শশুরপক্ষ জমিদার ছিলো! আর কথিত জমিদারের মেয়ের জামাই মন্ত্রীদের কর্মকান্ডে নিত্য গালি খাওয়া ছাড়া শেখ হাসিনার কোন বরাত নেই। স্বামীর রেখে যাওয়া সুধা সদন ছাড়া কোথাও কোন বাড়ি–সম্পত্তি নেই। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয় তাঁর বা তাঁর বোনের নামে কেউ যাতে কোন তদবির অনুমোদন না করে।
এমন বিজ্ঞপ্তি বা ঘোষনা বাংলাদেশের আর কোন মন্ত্রী–এমপি, এমন কি ছাত্রলীগ–যুবলীগের সভাপতি–সাধারন সম্পাদকও দিতে পারেননা। কারন তদবির করাই তাদের রুটি–রুজি–মালকড়ি কামাইর উৎস। কার কখন মাথার ওপর থেকে ছায়া সরে যায় তা কেউ জানেনা। অভিজ্ঞতা ভালো নয়।
এবার সবাই দিব্যি দেখলো–জানলো দেশের মানুষজনকে জিম্মি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেল সব গুদামে লুকিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছেন! আর এসবের প্রকাশে তাদের মুখোশ খসে পড়তে শুরু করলে তারা আবদার করে বললেন, অভিযান বন্ধ করতে হবে! কোন সাহসে–ভরসায় এই আবদার?
কাকে কত শেয়ার–কমিশন দেয়া হয়েছে, অথবা দেয়া হবে? মহাসড়কের ট্রাক–গাড়ি থেকে পুলিশ এখন মাসিক টাকার ব্যবস্থা করেছে। আজ পর্যন্ত এমন কোন অসাধু হারামখোর ব্যবসায়ীর লাভের বখরা কার কাছে কিভাবে যায় তা জানা গেলোনা। এদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোন শাস্তির ব্যবস্থাও হলোনা!
তোফায়েল আহমদের মতো নেতাকে সরিয়ে টিপু মুন্সিকে বানিজ্যমন্ত্রী করা হয়েছে! মতিয়া চৌধুরীর জায়গায় বসানো হয়েছে আব্দুর রাজ্জাককে! ফলাফল কী? বিশাল বিশাল শূন্য। শেখ হাসিনাকে অবিরাম গালি খাওয়ানো! কোন আত্মসমালোচনা নেই! তোফায়েল–মতিয়া এরা কী মন্ত্রণালয় চালাতে পারছিলেননা?
হঠাৎ করে ভারতীয় পিঁয়াজ আমদানি বন্ধ করে বাজারে আবার বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে পিঁয়াজের দাম! অতএব নিম্নবিত্ত–মধ্যবিত্ত তোমরা মরো! মরার আগে শেখ হাসিনাকে আবার গালি দাও! দেশে একবছর পর নির্বাচন হয়ে থাকে তাহলে এসব স্বেচ্ছাচারের মানে কী? এসব কিসের খেলা?
কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, কৃষকরা যাতে দাম পায় সে কারনে এখন ভারত থেকে পিঁয়াজ আমদানি বন্ধ করা হয়েছে! এভাবে হঠাৎ হঠাৎ সিদ্ধান্তে কি কৃষক দাম পায়? না ব্যবসায়ীরা লাভ গোনে? এর মানে দাঁড়ালো কুরবানির ঈদ পর্যন্ত বাজারে পিঁয়াজের দাম বাড়তেই থাকবে। গালিও চলবে।
আপনারা হঠাৎ এমন কৃষক বান্ধব হয়ে উঠলে কৃষককে আলাদা সুবিধা দিন। কৃষককে সুবিধা দেবার নামে সাধারন মানুষের পকেট কাটা আর আরেকদফা তথা শেখ হাসিনাকে গালি খাওয়ানোর আয়োজন করা কি ঠিক হলো! নেত্রীকে নিয়মিত গালি খাওয়ানো ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা–মন্ত্রীদের মাথায় যেনো আর কোন প্ল্যান কাজ করেনা!