ফজলুল বারী: পদ্মা সেতুর একটি ছবি শোভা পাচ্ছে অনেকের টাইম লাইনে। নীল আকাশের নীচে বাংলাদেশের মানুষের বড় আহ্লাদ আর গর্বের পদ্মা সেতু! পাশাপাশি আরেকটি ছবি গুদাম থেকে উদ্ধার করা লুকানো সয়াবিন তেলের মজুত! দ্বিতীয় ছবিটা দেশের মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করে। কারন এমন ঘটনায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত।
ডিজিটাল বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে অতিকথনে বিরক্ত মানুষজনের কান ঝালাপালা! সময়ের প্রয়োজনে সর্বশেষ প্রযুক্তি একটি রাষ্ট্রের ও ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এরজন্যে এটিকে কেউ বলেনা ডিজিটাল আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া। বাস্তব নানাকারনে বিষয়টি অনেকটা হাসি-ঠাট্টায় রূপ নিয়েছে।
১৯৯৪-৯৫ সালে বাংলাদেশে সৌভাগ্যবানদের হাতে প্রথম বাটন মোবাইল ফোন এসেছিল। বিজ্ঞাপনে দেখানো হতো নকিয়ার একটি হ্যান্ডসেট। অন্ধকার সিনেমাহলে একটি কল আসার সঙ্গে সঙ্গে আলোময় হয়ে যায় চারপাশ! এরপর ব্ল্যাকভেরির সেট আসে তুলনামূলক উন্নত।
এখন আইফোন, স্যামসাং এর নানান ব্র্যান্ডের যুগে নকিয়া-ব্ল্যাকভেরি বা রেডিও সেটের মতো বিশাল বপু সেট সব চলে গেছে জাদুঘরে। আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে মোবাইল ফোন-ইন্টারনেটের বিপ্লব ঘটে গেছে সত্য। কিন্তু ইন্টারনেটের গতি সহ মানের প্রশ্নটি এখনও সামনে আসছে প্রতিদিন।
এরজন্য করোনা কালে অনলাইনে পড়াশুনা সারাদেশে সমান কার্যকর ছিলোনা। এবার ঈদে রেলের টিকেট বলা হলো অনলাইনে কাটো। কিন্তু কেউ আর অনলাইনে ঢুকতে পারেনা। এরপর দু’দিন, তিনদিন লাইনে দাঁড়িয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ শ্লোগানের গোষ্ঠী উদ্ধারের খবরাখবর কেউ কী রেখেছে?
এই সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বানায়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠায় আকাশে। কিন্তু দেশের মানুষের তেল-পিঁয়াজের সমস্যার সুরাহা করতে পারেনা। একটা পণ্যের বছরে চাহিদা কত, তা আমদানি করতে হলে এর দাম-সময়-মান এসবকিছুর পঞ্চাশ বছরেও কোন জবাবদিহির জায়গা হলোনা!
কিন্তু গালিতো সরকার তথা শেখ হাসিনাই খাচ্ছেন! প্রধানমন্ত্রীকে অবিরাম গালি খাওয়ানোর জন্যে এসব মন্ত্রী-সচিব সহ দায়িত্বশীলদের আজ পর্যন্ত কিছু করা গেলোনা কেনো? নানান জায়গার বখরা ছাড়া কি এসব হয়? না দেশটা ফেরেশতায় সয়লাব হয়ে গেছে?
দেশের অসহায় মানুষজন ভোজ্য তেলের কৃত্রিম সংকটে আরেক দফায় ফতুর হবার পর বানিজ্য মন্ত্রী বললেন, ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে তিনি ভুল করেছেন! তিনি কি পয়দা হয়েছেন মাত্র? তিনি নিজেওতো একজন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের চামার-অতিমুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের তিনি চেনেননা জানেননা?
আজকের যুগে এমন সবকিছু সম্ভব হচ্ছে ডিজিটালাইজেশনের ব্যর্থতার কারনে। আমি কত টাকা দিয়ে কত পিঁয়াজ-তেল কিনলাম-আমদানি করে আনলাম, এর রাহা খরচ-ট্যাক্স-ভ্যাট বাদে কত টাকায় বিক্রি করলাম, মুনাফা করলাম কত, এর পুরো হিসাব জমা হচ্ছে অনলাইনে।
ইন্টারনেটের যুগে এসবতো এক টিপেই সব বের হবার কথা। কিন্তু আপনি ইভিএম’এ একটি টিপে ভোট দেয়া-নেয়া আর ফল বের করার পদ্ধতি নিয়ে কাইজ্যা করছেন, এক টিপে তেল-পিঁয়াজের হিসাব কেনো বেরুচ্ছেনা সেটা নিয়ে সবার মুখ বন্ধ! এনালগ অসৎ লোকজনের কারনে বাংলাদেশ ডিজিটাল হচ্ছেনা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরের গল্পগুলো এই প্রজন্ম জানেনা। সবাই মিলে রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা হলো। কত স্বপ্ন আর আত্মত্যাগের দেশ, কিন্তু কিছু লোক ব্যস্ত হয়ে গেলো মজুতদারি-কালোবাজারিতে। এসব সামাল দিয়ে নাকাল হতে হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে।
‘চেয়েছিলাম সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি’ বলেও তাকে হতাশা ব্যক্ত করতে হয়েছে। তখনকার নারায়ন ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ ছবিতে এসব ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়। ছবির মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন চরিত্রের হাহাকার নিশ্চয় সবার মনে আছে।
খলিলের চরিত্রটির মাধ্যমে মুনাফাখোর কালোবাজারি-মজুতদার চরিত্রটি ফুটে ওঠে। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে তখন রক্ষী বাহিনী নামানো হয়। এলাকায় এলাকায় কালোবাজারি-মজুতদার ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে যেতো রক্ষী বাহিনী। তবু বাজার আর নিয়ন্ত্রনে আসেনা! বাজার আরও পণ্য শূন্য হয়।
ঘটে যায় চুয়াত্তরের দূর্ভিক্ষ। সেই অভিজ্ঞতায় অনেক সময় বাজারে অভিযান বন্ধ রাখা হয়। অজুহাত দেয়া মুক্তবাজার অর্থনীতির! যেনো মুক্ত বাজার অর্থনীতি শুধু বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজদের জন্যে পৃথিবীতে এসেছে! অথচ আপনার দেশ ডিজিটাল হয়ে থাকলে এমন সব শয়তানি সহজেই নিয়ন্ত্রন করা যায়।
অস্ট্রেলিয়ায় আমরা সুপার মার্কেটে গিয়ে রেকে সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম লেখা পাই। বলা হয় একজন বিক্রেতা তার দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ ইন্টারনেট খরচ-মজুরি মিলিয়ে ৪০% লাভ রেখে তার পণ্য বিক্রয় করবেন। কিন্তু এসব দেশে সব সময় কম লাভে বেশি বিক্রির প্রবণতা প্রায় সব ব্যবসায়ীর।
বাংলাদেশে রোজায়-ঈদে নানান পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। নানান কৌশল করে দাম বাড়াতে এদের অবশ্য ঈদ-রোজার বাহানাও করতে হয়না। এই তেল এই পিঁয়াজ এভাবে একেকবার একেক বাহানায় দাম বাড়িয়ে ফতুর করা দেশের মানুষকে। এভাবে সরকারের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়।
উন্নত দেশগুলোয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের ক্রেতাবান্ধব হিসাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে সব সময়। বড়দিন-বক্সিং ডে সহ নানান উপলক্ষে এরা দাম কমায়। দোকান কর্মচারীরা নিজেদের দোকানের মালিক মনে করেনা। একসময় আমাদের বাজারে গঞ্জে হিন্দু ব্যবসায়ীদের আধিক্য ছিল।
খদ্দেরকে তারা তাদের বানিজ্যলক্ষী মনে করতেন। পারলে পুজা করতেন খদ্দেরকে। আর এখন খদ্দের মানে জিম্মি করার বিষয়। ব্যবসায়ীরা এখন কথায় কথায় সরকারকে জিম্মি করেন। খদ্দেরকেতো তারা গোনায় ধরেননা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব ব্যবসায়ী আবার পিজিপি তথা প্রেজেন্ট গভর্নমেন্ট পার্টি হয়। তাদের গায়ে কেউ হাত দেয়না বা দিতে পারেনা।
মুক্তিযুদ্ধের পরেও বাংলাদেশে রেশনিং ব্যবস্থায় কম আয়ের মানুষের অন্তত চাউল-গম কেনার ব্যবস্থা ছিল। ভারতে এখনও এই রেশনিং ব্যবস্থা চালু আছে। রেশন কার্ডকে সেখানে নাগরিকত্বের অন্যতম সনদ হিসাবে দেখা হয়। বাংলাদেশে এখনও সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ-আনসার বাহিনীতে চালু আছে রেশনিং ব্যবস্থা।
এরমাঝে সশস্ত্র বাহিনীর রেশনিং’এ অবিশ্বাস্য কম মূল্যে দেয়া হয় খাদ্য-দ্রব্য ও ভোগ্যপণ্য। তবু তোমরা বাবারা অভ্যূত্থানের চিন্তা করোনা! বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীর চার সদস্যের পরিবারকে মাসে ৩৫ কেজি চাল, ৩০ কেজি আটা, ৫ কেজি চিনি, ৮ লিটার সয়াবিন তেল, ৮ কেজি মশুর ডাল দেয়া হয়।
আপনারা অনলাইনে চেক করলে পুলিশ-আনসার সদস্যদের রেশনের নানান তথ্য পাবেন। সেনাবাহিনীরটা পাবেননা। করোনার দূর্যোগের সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় দূস্থদের মাঝে নিজেদের রেশনের খাদ্য সামগ্রী বিলি করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সেই রেশন সামগ্রীতে সাবানও ছিল।
পুলিশকে রেশনে সতের টাকা কেজিতে চাউল দেয়া হয়। আগে এই চাউল পোকা খাওয়া নিম্নমানের ছিল। পুলিশ এখন নিজেরা গুদামে গিয়ে ভালো চাউলটা নিয়ে আসে। পুলিশ সদস্যদেরও এখন আজীবন রেশন দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সবার এমন আদায় করার পক্ষ আছে। জনগনের পক্ষে কেউ নেই।
টিসিবির গাড়ির লাইনের অভিজ্ঞতা ভূক্তভোগীরা জানেন। মধ্যবিত্তের দরকার সবচেয়ে বেশি। মধ্যবিত্ত এখানে দাঁড়াতে পারেননা। দাঁড়িয়েও পণ্য কিনতে পারেননা। ১/১১’র তত্ত্বাবধায়কের বিডিআরের পণ্য বিক্রির লাইনে খাদ্যদ্রব্য কিনতে মতিয়া চৌধুরীর দাঁড়ানোর ছবি ছাপা হয়েছিল।
মতিয়া চৌধুরী এখন মন্ত্রী না হলেও এমপি। এমপি হিসাবে তার যে ভাতা-আয়, ছোট সংসার, তার আর এখানে লাইনে দাঁড়ানো লাগেনা। এখন মতিয়া চৌধুরী টিসিবির পণ্যের লাইনে দাঁড়ালে তাতে সরকারের বদনাম হবে। অতএব শেরপুর থেকে তাঁর পাব্লিক বাসে ঢাকা আসার ছবি ছাপা হয়।
দেশের অসহায় মধ্যবিত্ত-নিম্ন আয়ের মানুষের ছবির দরকার নেই, তাদের দরকার সহনীয় মূল্যে পণ্য। রেশন হোক অথবা যেভাবে হোক মধ্যবিত্ত-নিম্ন আয়ের মানুষের বাড়িতে সহনীয় মূল্যে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা গেলে তা পদ্মা সেতুর মতো একটি যুগান্তকারী কাজ হতো।