যে কারনে স্বামী হত্যার বিচার চাননা খালেদা জিয়া!

যে কারনে স্বামী হত্যার বিচার চাননা খালেদা জিয়া!

ফজলুল বারী:প্রতি বছর ৩০ মে জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী এলে জিয়া হত্যার বিচারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। বিএনপির নেতাকর্মীরা জিয়ার মাজারে গিয়ে নানান শপথ নেন। কিন্তু কখনো তারা জিয়া হত্যার বিচার দাবি করেননা! বিএনপি কেন জিয়া হত্যার বিচার দাবি করেনা, আজকাল এই প্রশ্নটি আওয়ামী লীগের তরুন নেতাকর্মীরা প্রায় করেন!

বাংলাদেশের রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসাবে আমার ধারনা খালেদা জিয়া এরশাদের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা পেয়ে স্বামী হত্যার বিচার বিষয়ে এরশাদের ব্যবস্থাদি মেনে নিয়েছেন। উপকার নিলে এরপর আর সবকিছু আলাদা দাবি করা যায়না। খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসবেন, এ ধারনা তখনও ছিলোনা।

জিয়া হত্যার আসল হোতা এরশাদ। চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্টকে হত্যা করে ঢাকার ক্ষমতা পাওয়া যায়না। মঞ্জুরের মতো চৌকস বীর মুক্তিযোদ্ধাও বিষয়টি না বোঝার কথা না। এরশাদের পরিকল্পনায়  হত্যাকান্ডটি ঘটান জেনারেল মঞ্জুর। এরপর ওই অবস্থায় লাশটি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের মেঝেতে পড়েছিল।

বিএনপির কোন নেতা-কর্মী তাদের নেতা জিয়ার লাশ তখন দেখা বা সৎকারের চেষ্টা করেছে, এমনও শোনা যায়নি। জিয়াকে এমনভাবে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয় তার লাশ দেখে চেনা সম্ভব ছিলোনা। জিয়াকে হত্যার পর এরশাদ মঞ্জুরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন।

জিয়া হত্যার নেপথ্যে এরশাদের ভূমিকা যাতে ফাঁস না হয়, এরজন্য সাক্ষী ধংস করতে হত্যা করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল মঞ্জুরকে। তৎকালীন থানার ওসি কুদ্দুসকে দিয়ে হত্যা করা হয় জেনারেল মঞ্জুরকে। টেলিভিশনে প্রচার করা হয় একদল বিক্ষুদ্ধ সৈনিক মঞ্জুরকে মেরে ফেলেছে!

কিন্তু সাক্ষীতো ওসি কুদ্দুস। এই ওসির রাজ কপাল। এরশাদ এখানে সাক্ষী কুদ্দুসকে না মেরে মুখ বন্ধ করতে টাকার বস্তা দিয়েছে। ওসি কুদ্দুস পুলিশের চাকরি ছেড়ে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় ওসি কুদ্দুসের গার্মেন্টেস প্রতিষ্ঠানটি এখনও কী আছে?

জিয়া-এরশাদ এভাবে কত যে সামরিক হত্যাকান্ডের সঙ্গে হত্যার সঙ্গে জড়িত! জিয়ার আমলে সামরিক বাহিনীতে হত্যাকান্ডের ঘটনা বেশি ঘটেছে।  এরপর তারা উর্দি গায়ে রাজনীতিতে আসেন। সামরিক শাসনের ঔরসে  জন্ম নেয়া দলগুলো দেশের মানুষকে গণতন্ত্রের সবক দেয়!

জিয়া-এরশাদের রাজনৈতিক অবতরনের গল্পও এক!  গল্পখানা হলো, তাদেরকে জোর করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে! ক্ষমতায় যেতে তাদের একদম ইচ্ছা করছিলোনা! বিচারপতি সায়েমের বইতে আছে, এক গভীর রাতে জিয়া সদলবলে বঙ্গভবনে গিয়ে হাজির হয়।

তাকে ঘুম থেকে তুলে অস্ত্রের মুখে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেন জিয়া। এরপর আয়োজন করেন হ্যাঁ না গণভোটের। ব্যালট পেপারে জিয়ার ছবি! আপনি জিয়াকে চান ,মানে হ্যাঁ চিহ্ন। না ভোট দেবারও কথা ছিল। কেন্দ্রে কোন লোক না থাকলেও নিজের পক্ষে শতভাগ ভোট নেন জিয়া!

জেনারেল জিয়ার সেই নির্বাচনই বাংলাদেশের ইতিহাসের  প্রথম জঘন্য জালিয়াতির নির্বাচন।  এরশাদও জিয়াকে হত্যর পর সরাসরি ক্ষমতা না নিয়ে ক্ষমতায় বসান ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারকে। বিচারপতি সাত্তার তখন হাসপাতালে। দাঁড়াতে পারেননা।

প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবার পর দেখা গেলো তিনি দৌড়াতে পারেন! তখন টেলিভিশনে দেখানো হলো, সদ্য বিধবা খালেদা জিয়া গরিব, খাবেন কী! থাকবেন কোথায়! বাচ্চাদের মানুষ করবেন কী করে! কারন জিয়া কোন বিষয় সম্পত্তি রেখে যাননি! ছেঁড়া গেঞ্জি পরতেন জিয়া!

সম্পদ বলতে ছিল ভাঙা একটা সুটকেস! জিয়ার শার্ট-পেন্ট কেটে ছোট করে তারেকের পরার শার্ট-পেন্ট বানানো হতো! তখন দয়ার সাগর এরশাদ খালেদা জিয়াকে দশ লাখ টাকার চেক দিলেন! সেনানিবাসের বাড়ি, গুলশানে আরেকটি বাড়ি লিখে দেয়া হয়! খালেদা জিয়ার নামে!

জোশে ভুলেই গিয়েছিলেন যে আইনত একজনক একটির বেশি সরকারি বাড়ি দেয়াই যায়না।  এই আইনি কারনে খালেদার জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি হাতছাড়া হয়েছে। তখন সদ্য পিতৃহারা তারেক-কোকোর পড়াশুনার দায়িত্ব নেন  এরশাদ! তাদের এরশাদ চাচা।

বিএনপির নেতাকর্মীরা তখন আশ্বস্ত হলো যাক, জিয়ার স্ত্রী-সন্তানরা অন্তত না খেয়ে মরবেননা! এরশাদ ততদিনে কোর্ট  মার্শাল করে জিয়ার হত্যায় কথিত জড়িতদের বিচার করে ফাঁসি দিয়ে দেন। মঞ্জুরকেও মেরে ফেলেন। ব্যাস, জিয়া হত্যার সঙ্গে এরশাদ যে হুকুমের আসামী, তা বলার মতো কোন সাক্ষী রইলোনা।

খালেদা জিয়া ঈমানদার মানবী! পাক্কা মুসলমান। যে এরশাদ তাকে দুটো বাড়ি, দশ লাখ টাকা দিয়েছেন স্বামীর মৃত্যুর ক্ষতিপূরন! এরশাদের করা বিচার মেনে নেন বিএনপির নীতি নির্ধারকরা। এরজন্যে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় কখনও জিয়া হত্যার বিষয়টি সামনে আনা হয়নি।

বিএনপি ক্ষমতায় যাবার পরও স্বামী হত্যার বিচার সঠিক হয়েছে কিনা, সেটিও কোনদিন তদন্ত করে দেখার উদ্যোগ নেননি খালেদা জিয়া। অতএব, সবার ধারনা হয় বিএনপিও তাদের নেতা জিয়া হত্যার বিচার চায় না। জিয়া হত্যারর বিচারের বিষয়টি এভাবে অমিমাংসিত থেকে যায়।

আওয়ামী লীগ মঞ্জুরের ভাইকে দিয়ে এরশাদকে এক নাম্বার আসামী মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়ের করিয়েছিল। যখনই এরশাদ আওয়ামী লীগের অবাধ্য হবার চেষ্টা করতেন, তখনই নাড়াচাড়া করা হতো মঞ্জুর হত্যা মামলা। এরশাদ চুপ হয়ে যেতেন!

কারন জেলে থাকার অভিজ্ঞতা তার অনেক হয়েছে! আর নয়। এরশাদ চুপ হয়ে গেলে মামলাটিও তখন চুপ হয়ে যেতো! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এরশাদ মঞ্জুর হত্যা  মামলাটি নিয়ে পেরেশানিতে ছিলেন। মৃত্যুর মাধ্যমে জিয়া-মঞ্জুর সহ অনেক কয়েকটি মামলা থেকেও বিদায় ঘটেছে এরশাদের।

জিয়া হত্যার বিচার নিয়েও বিএনপিতে কোন হা-হুতাশ নেই। কারন যার স্বামী তিনিই এরশাদের কোর্ট মার্শালের বিচার মেনে নিয়েছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ফোঁড়নকাটা প্রশ্ন নিয়ে বিএনপিতে তেমন প্রতিক্রিয়া হয়না। কারন এ দলটির ধাচই আলাদা।