ফজলুল বারী:অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টির নতুন সরকারে প্রথমবারের মতো দু’জন মুসলিম মন্ত্রী স্থান পেয়েছেন। এদের একজন বসনিয়ান, অপরজন মিশরীয় বংশোদ্ভূত। এছাড়া শিশুকালে মা-বাবা’র সঙ্গে নৌকায় করে অবৈধপথে অস্ট্রেলিয়ায় আসা এক আফগান শরণার্থী পরিবারের সদস্যা দেশটির সংসদের উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্যা নির্বাচিত হয়েছেন।
মুসলিম দুই মন্ত্রীর শপথ নেয়াকে ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করেছে অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া। বিজ্ঞানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেয়া এডাম নুরেদিন হিউসিক আগেও অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। সিডনির ব্ল্যাকটাউন এলাকা থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। বসনিয়ান মুসলিম হিউসিকের জন্ম সিডনিতে।
বাংলাদেশে জন্ম হলে তার নাম নুরেদিন না হয়ে নুরুদ্দিন হতো। দুই মুসলিম মন্ত্রী কোরান ছুঁয়ে শপথ নেন। উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে এবং ধর্মগ্রন্থ না ছুঁয়ে দু’ভাবেই শপথের সুযোগ আছে। যার ধর্ম তার কাছে।
কোরান ছুঁয়ে সংসদ সদস্য হিসাবে হিউসিকের শপথের পুরনো একটি ছবি অনলাইনে আছে। এই হিউসিক সিডনির ওয়াকিফহাল বাংলাদেশীদের কাছে আলোচিত সমালোচিত একটি নাম। আবার লেবার পার্টির সক্রিয় সদস্য, প্রবাসী বাংলাদেশী ব্যক্তিত্ব প্রকৌশলী প্রবীর মৈত্র হিউসিকেকে একজন স্মার্ট মানুষ হিসাবেই উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু বলা হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের একটি জামায়াতী লবি বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের কথা বলে হিউসিককে ম্যানেজ করে ফেলেছিল! বাংলাদেশে তখন গণজাগরনমঞ্চের নেতৃত্বাধীন উত্তাল এক সময়। যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বাঁচাতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও এর বিশেষ একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।
উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ায় জামায়াতে ইসলামী নামে সংগঠন করা যায়না। ইন্দোনেশিয়ার জামিয়া’ সংগঠনটি অস্ট্রেলিয়ায় নিষিদ্ধ। জামিয়া থেকে জামায়াত নামের সংগঠনটির ব্যাপারেও এখানে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী আছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখানে সামাজিক সংগঠন হিসাবে রেজিষ্ট্রিকৃত।
যেমন আওয়ামী লীগের নাম অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগ ইনক। বিএনপিরও নাম একইভাবে রেজিস্ট্রিকৃত। যেহেতু এখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপির একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রেজিস্ট্রেশন পেতে নামগুলোতেও কিছুটা অদলবদল করতে হয়। জামায়াত নামে সংগঠন করতে না পারায় জামায়াত-শিবিরের লোকজন এখানে তবলীগ জামাত সহ ইসলামী নানান সংগঠনের ব্যানারে আড়ালে কাজ করে।
জামায়াতী লবিটি তখন সিডনিতে এমপি হিউসিককে বোঝায়, বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে মুসলমান নেতা, ইসলামী স্কলারদের হত্যা করছে। যারাই এর প্রতিবাদ করছে তাদের জেলে পোরা হচ্ছে। ভিন্নমত বা বিরুদ্ধমতের কোন স্থান নেই বাংলাদেশে। হিউসিক তখন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্যে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে একটি নোটিশ জমা দেন।
কিন্তু পার্লামেন্টে তৎকালীন বাংলাদেশ চাপ্টারের প্রধান ও সিনিয়র এমপি লরি ফার্গুসনের ভূমিকার কারনে সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টির সরকার তখনও ক্ষমতায়। লেবার পার্টির তৎকালীন সিনিয়র এমপি লরি ফার্গুসনের সঙ্গে বরাবরই প্রবাসী বাংলাদেশী নেতাদের সুসম্পর্ক ছিল এবং এখনও আছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার নোটিশ দেখে লরি ফার্গুসন মনে করেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার নোটিশ হতে পারে। তখন তিনি নিজের নামও আলোচনার জন্যে জমা দেন। পরে জানতে পারেন এটি আসলে একটি জামায়াতী উদ্যোগ।
লরি ফার্গুসন তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বাংলাদেশে জামায়াতের তৎপরতার কাগজপত্র চান। এক রাতেই অনলাইন ঘেঁটে তাঁকে উল্লেখযোগ্য পরিমানের প্রমানপত্র দেন প্রবাসী ব্যক্তিত্ব প্রবীর মৈত্র। একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক রনেশ মৈত্র’র ছেলে প্রকৌশলী প্রবীর মৈত্র অস্ট্রেলিয়া লেবার পার্টির সক্রিয় সদস্য, অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম নির্বাচিত বাংলাদেশী জনপ্রতিনিধি।
সিডনির প্যারামাটা কাউন্সিলে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। এসব প্রমানপত্র হাতে পাবার পর লরি ফার্গুসনের আলোচনায় তখন হিউসিক উত্থাপিত আলোচনার মোড়ই ঘুরে যায়। এরপর ফার্গুসন অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বব কার এর সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশীদের একটি প্রতিনিধিদলের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন।
প্রবীর মৈত্রের নেতৃত্বে ওই দলে ছিলেন সেলিমা বেগম, আবু তারিক,আব্দুল জলিল, সিরাজুল হক ও সমীর রায়। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার এমপি মোসলেহ উদ্দিনের মেয়ে সেলিমা ও তাঁর আবু তারিক স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ছিলেন।
সিডনিতে তাঁরা প্রবাসী বাংলাদেশীদের নানান কর্মকান্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িত। সেলিমা তখন বব কারের সামনে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের গণহত্যা সহ নানান অপরাধ কর্মকান্ড ও বিচার কার্যক্রম নিয়ে একটি ভিডিও উপস্থাপন করেন। সব দেখেশুনে সন্তুষ্ট বব কার বলেন, অস্ট্রেলিয়া সরকারও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে।
এভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধী জামায়াতী লবিং এবং এডাম হিউসিকের উদ্যোগ পন্ড হয়। তাঁর মন্ত্রী হবার পর পুরনো ও পরিত্যক্ত জামায়াত প্রসঙ্গ আবার আলোচনায় আসে। ২০১৩ সালে তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী কেবিন রাড হিউসিককে মন্ত্রিপরিষদের সচিব নিয়োগ দিয়েছিলেন।
বুধবার অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের প্রথম মুসলিম মন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন আন্নি আজ্জা আলী। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় তাঁর জন্ম। দুই বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় আসেন আন্নি। পেশায় শিক্ষক আন্নি কাউন্টার টেররিজম বিশেষজ্ঞ। যুব সমাজ কেনো টেররিজমের দিকে ঝুঁকে, এ নিয়ে তিনি গবেষনা করেছেন।
আন্নির বাবা ছিলেন বাস চালক। মিশরের কায়রোর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি শিক্ষকতা করেছেন। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার কওয়ান থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আন্নিকে আর্লি চাইল্ড এডুকেশন ও যুব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ২১ মে’র নির্বাচনে এন্থনি আলবানিজির অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল সস্তায় চাইল্ড কেয়ারের ব্যবস্থা করা। আলবানিজের হয় এ বিষয়টা সামলাতে হবে আন্নিকে।
অস্ট্রেলিয়ার সংসদের উচ্চকক্ষ সিনেটে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ফাতিমা পেমান। উপন্যাসের চরিত্রের মতো এক জীবন ফাতিমার। অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতির গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় বোট পিপল। অভিবাসনের আশায় নৌকায় করে আসা অবৈধ মানুষেরা। এদেরই নেগেটিভ নামটি বোট পিপল।
সর্বশেষ লেবার পার্টির সরকারের আমলে পাঁচশর বেশি নৌকায় করে অভিবাসন প্রত্যাশীরা অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিল। তখন অস্ট্রেলিয়ার জলসীমায় এমন নৌকা বোঝাই অভিবাসন প্রত্যাশীদের উদ্ধার করে নোবাহিনীর জাহাজ নিয়ে যেত ক্রিসমাস আইল্যান্ড নামের একটি দ্বীপের জেলখানায়।
সেখানে তাদের কথা শোনা হতো। এরপর যার যার দেশে এসব তদন্ত করে যারা সত্যিকারের শরণার্থী, তাদের আশ্রয় দেয়া হতো অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ নাগরিক তাদের ট্যাক্সের টাকা খরচ করে এভাবে শরণার্থী আশ্রয় দেয়া নিয়ে ক্ষুদ্ধ হয়। এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় আসে।
এরজন্যে বলা হয় অভিবাসন ইচ্ছুকদের নৌকার ধাক্কায় ক্ষমতাচ্যুত হয় লেবার পার্টির সরকার! এই নির্বাচনে লেবার পার্টির টিকেটে এমন একজন ফাতিমা সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন, যিনি শিশুকালে মা-বাবা’র সঙ্গে এমন একটি অভিবাসী নৌকায় অস্ট্রেলিয়া এসেছিলেন।
পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া থেকে নির্বাচিত আফগান বংশোদ্ভূত সিনেটর ফাতিমা’র মা একটি ড্রাইভিং স্কুল চালান। লোকজনকে ড্রাইভিং শেখান। ২০১৮ সালে ক্যান্সারে মারা যাওয়া তাঁর বাবা’র ইচ্ছা ছিল মেয়ে বড় হয়ে আফগানিস্তানে ফিরে গিয়ে আফগানিস্তানের অবস্থার পরিবর্তন করবে।
বাবা’র সেই মেয়ে হয়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়ার সিনেটের সদস্যা। অস্ট্রেলিয়ার আইন পরিষদে তিনিই একমাত্র হিজাবি সদস্যা। এই বহুজাতিক দেশে হিজাব বা ধর্ম কোন সমস্যা নয়। যার ধর্ম তার কাছে, যার পোশাক তার কাছে, রাষ্ট্রের কি বলার আছে।
ধর্ম পালন করা যাবে বাড়িতে বা ঘরের মধ্যে, কর্মক্ষেত্রে নয়। মাইক বাজিয়ে বা মানুষকে বিরক্ত করে ধর্মাচার এদেশে নিষিদ্ধ। এতে করে কোন ধার্মিকের ধর্ম চর্চা এদেশে বন্ধ নেই। দুই মুসলিম মন্ত্রীর শপথকে এখানে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। এরমানে এই নয় যে অস্ট্রেলিয়া মুসলিম দেশ হয়ে যাচ্ছে।
এটা কাজের দেশ। মানুষের দেশ। ইমাম সাহেবকেও তাই নাম শেষে কাজের উদ্দেশে ছুটতে হয়। ইমাম সাহেব যে নামাজ পড়াতে এসেছিলেন, এটা ছিল তাঁর খেপ। জীবন যেখানে যেমন।