ফজলুল বারী:এমন একটি ভয়াল ঘটনা আর মানুষের সাড়ার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৫ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রাবাসের পুরনো মিলনায়তনের ছাদ ধসে ৩৯ ছাত্র নিহত, ৩ শতাধিক আহত হন। বিটিভির নাটক দেখতে ছাত্ররা ওই সময়ে মিলনায়তনে ভিড় করেছিলেন।
জরাজীর্ণ সেই ভবনটি সেখানে ছাত্রদের ওপর ভেঙ্গে পড়ে। তখন আজকের মতো মোবাইল ফোন, এত মিডিয়া-সোশ্যাল মিডিয়া ছিলোনা। তা স্বত্ত্বেও খবরটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সারা ঢাকা শহরের হৃদয়বান মানুষেরা রাতের বেলা ছুটে এসেছিলেন জগন্নাথ হলে এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
আহত ছাত্রদের কোলে, রিকশা-স্কুটারে, ফটো সাংবাদিকদের মোটর সাইকেলে নিয়ে উদ্ধার অভিযানে সম্পৃক্ত মানুষেরা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াতে অনেককে সে রাতে বাঁচানো সম্ভব হয়। রক্ত দেবার জন্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সে রাতে মানুষের লাইন পড়েছিল।
তখন কেউ ভাবেনি ছেলেগুলো হিন্দুর ছেলে কীনা। বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে বিপন্ন মানুষের জন্যে এগিয়ে আসে তা ওই ঘটনায় দেখেছে দেশ। রানা প্লাজার ঘটনায়ও মানুষের বিপদে এগিয়ে এসেছিল মানুষ। লঞ্চের আগুনের ঘটনায়ও গ্রামের মানুষ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষ বাঁচিয়েছে।
সীতাকুন্ডের কন্টেইনার ডিপোর আগুনের ঘটনায় আবার দেশবিদেশের মানুষ দেখলো বাংলাদেশের আসল চেহারা। মানুষের বিপদে এখানে মানু কতটা আন্তরিক-মানবিক হয়। বিশেষ করে দেশের তরুন সমাজ, আমাদের প্রিয় প্রজন্ম সৃষ্টি সুখের উল্লাসী ভবিষ্যত বাংলাদেশ।
অথচ আমাদের দেশের কিছু মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ আছেন যারা সারাক্ষন দেশের নেগেটিভটাই খুঁজে বেড়ায়। বিশেষ কিছু সাংবাদিকও আছেন। এদের কিছু পত্রিকার কাজ হলো দুনিয়ার কোথায় দেশের বিরুদ্ধে কি ছাপা হয়েছে সেটা খুঁজে বেড়ানো!
বিদেশী অনেক অনুল্লেখ্য পত্রিকা-অনলাইনের খবর অথবা কল্পগল্পও এরা বড় করে ছেপে দেখায় যেন দেশ গেলো দেশ গেলো! আর কিছু পন্ডিতনমন্য পট করে বলার চেষ্টা করে এই দূর্ভিক্ষ হলো বা এলো বলে! এরা যে বাংলাদেশের মানুষকে চেনেনা জানেনা সীতাকুন্ডের ঘটনায় তা আবার সামনে এসেছে।
আমাদের প্রিয় প্রজন্ম ছেলেরা মানুষের প্রয়োজনে এবারেও যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, এর বিস্তারিত জেনে ছবি দেখে আনন্দে চোখে পানি এসেছে। রক্ত দিতে বাস বোঝাই করে রাতেই চলে এসেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা! এরাই কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত বাংলাদেশ। আমাদের লাল ভালোবাসা।
নানা কারনে দেশে যে ছেলেদের ভীষন ভালোবাসি তাদের একজন চট্টগ্রামের নুরুল আজিম রনি। চট্টল বীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাতে গড়া রনিকে অনেকে সোহাগে শ্রদ্ধায় ডাকেন ছোটদের মহিউদ্দিন। দেশে নানা কারনে ছাত্রলীগ যুবলীগ করা অনেকে বদনামে ভারাক্রান্ত।
কিন্তু বহুদিন ধরে ছাত্রলীগ করা অভাবনীয় জনপ্রিয় একটি মুখ নুরুল আজিম রনি। তাঁর এই জনপ্রিয়তা শুধু চট্টগ্রামে নয়, সারা বাংলাদেশ জুড়ে। কারন রনি সব সময় ছাত্রদের-জনগনের পক্ষ নেন। করোনার সময়ও সবাই তাকে দেখেছেন। চট্টগ্রামের সিআরবি আন্দোলনেও তিনি সামনে থেকে নেতৃত্বে সক্রিয়।
সবার প্রিয় রনিকে শনিবার রাত থেকে আবার স্বরূপে দেখছে বাংলাদেশ। নিজের কর্মী বাহিনী নিয়ে তিনি পানি, জরুরি ওষুধ নিয়ে ছুটে এসেছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে থেকে আহতদের শুশ্রষা, শৃংখলা রক্ষায় কাজ করে চলেছেন সবার ভালোবাসার রনি ও তাঁর কর্মীরা।
আরিফ নামের এক যুবকের একাধিক ছবি ভাসছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। নিজেদের ছোটখাটো ওষুধের দোকানের টেবিলে বুক লাগিয়ে আরিফ লিখছিলেন একটি মানবিক বাংলাদেশের ইশতেহার! রক্ত লাগলে যোগাযোগ করুন, কারও ওষুধ লাগলে বলুন’। এটাইতো আমাদের প্রানের বাংলাদেশ, তাই নয় কি!
আরিফের পরের ঘটনাটি চোখ ভিজানোর। বিপন্ন মানুষজনের জন্যে রক্ত-ওষুধের সংগ্রাম যখন তিনি করছিলেন তাঁর পরিবার তাঁকে খুঁজছিল। কারন বিদেশে তাঁর বাবা’র মৃত্যু হয়েছে। ভোরের দিকে বাড়িতে ফেরার পর তিনি খবরটি জানতে পারেন। তাঁর বন্ধুরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন এটাই আরিফ।
আমাদের জন্মভূমি দেশটার অনেক সমস্যা সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু আমাদের যে এমন রনি-আরিফদের মতো লাখো যুব সম্পদও আছে, সীতাকুন্ডের ঘটনা তা আবার মনে করিয়ে দিয়েছে। সময়মতো তারা ঝলসে ওঠেন। তাদের দাওয়াত করে আনতে হয়না। তোমাদের অভিবাদন প্রিয় প্রজন্ম। শকুন গরু মরার যত দোয়া পড়ার পড়ুক, তোমাদের কারনে হারবেনা বাংলাদেশ।
জনবহুল বাংলাদেশে অগ্নি দূর্ঘটনা প্রায় একটি নিয়মিত ঘটনা। নদীতে লঞ্চে আগুনের পর সীতাকুন্ডের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছে আমাদের তথ্য ঘাটতি। সীতাকুন্ডের আগুন নেভাতে ছুটে গেছেন ফায়ার সার্ভিসের যোদ্ধারা। কিন্তু তারাতো জানেননা সেখানে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের মতো রাসায়নিক পদার্থ জ্বলছিল।
পানি দিয়েতো দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের আগুন নেভানো যায়না। বাংলাদেশের সব ঘটনার মতো মানুষের ভিড় আর পানির স্বল্পতায় ফায়ার ফাইটারদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বিদেশে এ ধরনের স্পট এলাকায় ফায়ার ফাইটার-পুলিশ সদস্যদের বাইরে আর কেউ ঢুকতে পারেননা।
সীতাকুন্ডের অকুস্থলের ভয়ংকর দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের অস্তিত্ব বুঝতে বুঝতে মৃত্যু হয় নয়জন ফায়ার ফাইটারের। বাংলাদেশে কোন ঘটনায় এত বেশি সংখ্যক ফায়ার ফাইটারের মৃত্যুর ঘটনা এই প্রথম। ৪৯ জন মানুষের মৃত্যু, দেড়শ’র বেশি আহত হয়েছেন ভয়াবহ এই দূর্ঘটনায়।
এমন দাহ্য রাসায়নিক সারাদেশে আরও নানান জায়গায় আছে। চুড়িহাট্টা সহ নানান ঘটনা স্বত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মানুষজনকে বোঝানো যায়না জীবিকার চেয়ে জীবন বড়। বাংলাদেশের নিরাপদ কর্মক্ষেত্রের ধারনাটি এখন পর্যন্ত খাতাপত্রে। আগুনের ঘটনা ফেসবুক লাইভ করতে করতে প্রান হারিয়েছে এক তরুন।
সীতাকুন্ডের ঘটনার পর কিছু উদ্যোগ নজরে এসেছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সব চিকিৎসককে ডেকে পাঠানো হয়। আশেপাশের চিকিৎসকদেরও ডেকে পাঠানো হয় হাসপাতালে। সব ঘটনার মতো এ ঘটনাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারারাত জেগে থেকে মনিটর করেছেন।
অকুস্থলে সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাঠিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী। সেনা হেলিকপ্টারে আহত অনেককে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার কারনে সীতাকুন্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ এই প্রথম পরিবেশ রক্ষার কথা ভেবে জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছে।
ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যাতে নদীতে-সাগরে গিয়ে না পড়ে এরজন্যে সেনা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত কাজে লাগানো হয়। আমাদের অনেক তরুন প্রিয় প্রজন্ম সাংবাদিক অকুস্থল থেকে এ ঘটনারও চমৎকার রিপোর্ট করেছেন। আগুনের কাছে যাওয়া যাচ্ছিলোনা।
স্পট থেকে তারা বলছিলেন বাতাসে রাসায়নিক দাহ্যের প্রভাবে তাদের চোখ জ্বলছে। ফায়ার ফাইটার, পুলিশ সদস্যদের মতো স্পট রিপোর্টারদের সরেজমিন পরিশ্রমী রিপোর্ট দেখতে দেখতে সিনিয়র হিসাবে মনে ভয়ে গেছে। সবাইকে দোয়া ও অভিনন্দন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের এ ভূমিকাটা ভালো লাগলোনা। যখন সবাই মিলে জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেবার কাজ করছে তখন কি এভাবে মুখস্ত সরকার বিরোধিতার সময়? সাবেক শিক্ষক এই রাজনীতিবিদের সাম্প্রতিক এমন কিছু ভূমিকাকে দূর্ভাগ্যজনক বলতে হয়।