ফজলুল বারী:সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যুগের প্রিয় প্রজন্ম কম্পিউটার–ইন্টারনেট ব্যবহারেও অনেক সৃষ্টিশীল। তাদের কাছে তথ্য গোপনের সুযোগ নেই। যে যখন বচন যা দিচ্ছেন তথ্য–উপাত্ত ঘেটে তারাই এর জবাব দিয়ে দিচ্ছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে অনেকে আগডুম বাকডুম অনেক বক্তৃতা–বচন দিয়েছেন।
স্বপ্নের সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে মানুষের উচ্ছ্বাসের সময়টায় ‘তাহারা নিখোঁজ’! অনলাইনে প্রিয় প্রজন্ম তাদের ফটো কার্টুন করে ছেড়েছে। শিরোনাম করেছে ‘তাহাদের মন ভালো নাই’! দেশবাসীর আনন্দের সময়টায় তারা নিখোঁজ থাকার কারন তারা জনবিচ্ছিন্ন।
পরিবর্তিত পৃথিবীর এই সময় শুধু বিরোধিতার জন্যে বিরোধিতার রাজনীতিটাই সেকেলে। সব সময় মানুষের পক্ষে এবং মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে। গঠনমূলক বিরোধিতায় পাল্টা বিকল্প উপস্থাপন করতে হয়। গণতান্ত্রিক সমাজে যা করে একটি ছায়া সরকার। বাংলাদেশে তা নেই।
সারা দেশের মানুষ যখন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের অপেক্ষায় তখন বিএনপির নেতারা ডিম আগে না মুরগি আগে বিতর্ক করছিলেন! কখনও এত টাকার সেতু নির্মানের ব্যয় এত টাকা হলো কেনো বা আমরাও স্বপ্ন দেখেছিলাম বলা নিয়ে ব্যস্ত! পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর থেকে তারা কী সেতু এলাকায় মানুষের উচ্ছ্বাস দেখেছে?
আওয়ামী লীগের জনসভার লোকজন আয়োজনের–দাওয়াতের লোকজন হলেও এই উচ্ছ্বাসের মানুষগুলো কিন্তু দাওয়াতের না। আন্দোলন যেমন ঈদের পরে বা দিন–তারিখ ঘোষনা দিয়ে হয়না তেমনি উচ্ছ্বাসের লোকজনকে দাওয়াত দিয়ে আনা যায়না। তারা কোন কিছুকে নিজের মনে করলে সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই আসে।
আওয়ামী লীগ এই মানুষজনকে অউন করতে পেরেছে। বিএনপি–জামায়াত জোট পারেনি। তাদের ডিম আগে না মুরগি আগে বিতর্ক শুনলে তারা আসতোনা। শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত জামায়াত শয়তানির চেষ্টা করেছে। তাদের শেষ শয়তানিটা ছিল পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাদ দেয়া হয়েছে বলে বিবৃতি দেয়া!
এই আওয়ামী লীগ যেখানে সারাদেশ জুড়ে মডেল মসজিদ বানায় সেখানে তারা ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দিয়ে জামায়াতের হাতে ইস্যু তুলে দেবার মতো বোকা সংগঠন না। শিক্ষামন্ত্রী ও মন্ত্রণালয় সঙ্গে সঙ্গে ব্যাখ্যা দেয়ায় তাদের শয়তানি পাবলিক খায়নি। পাবলিকের মনোযোগও তখন পদ্মা সেতুতে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মানের খরচ কেনো বেড়েছে গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অধ্যাপক আইনুন নিশাতের বক্তব্যে এর যথেষ্ট ব্যাখ্যা এসেছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম খরস্রোতা নদী পদ্মাকে শাসন করে করে কাজ অগ্রসর হয়েছে। খরচ তাই অনেক বেড়েছে এবং আগামীতে আরও বাড়বে।
বিশ্বব্যাংকের চিন্তার পদ্মা সেতুতে রেললাইন ছিলোনা। বিশ্বব্যাংক সহজে রেললাইনের কথা শুনলে টাকা দিতে চায় না। কারন যাদের টাকায় বুদ্ধিতে বিশ্বব্যাংক চলে রেললাইনে তাদের গাড়ির বিক্রি কমে যাবার ঝুঁকি তৈরি হয়। সবাই বাংলাদেশের মতো দেশে বেশি বেশি গাড়ি বিক্রি করতে চায়।
ট্রেনের বগি প্রতিদিন বিক্রি করা যায়না। কথিত ভারত বিরোধীদল বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বাংলাদেশে ভারতীয় গাড়ির বাজার করে দিতে জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি বন্ধ করেছিলেন। সেই লক্করঝক্কর ভারতীয় গাড়ির বেশিরভাগ কিছুদিনের মধ্যে পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
ভারতীয় সিএনজি অটো বাংলাদেশে যখন আসতে শুরু করে তখন এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করতেন কোকো । ভারতের চেয়ে তিন–চারগুণ বেশি টাকায় এখানে একজন সিএনজি অটোর মালিকানা পেতেন। কাজেই এখন ফেরেশ্তা সেজে লাভ নেই। সেই যে বাড়তি টাকা তোলার নাম করে সিএনজি অটো বাংলাদেশে গণবিরোধী আচরন নিয়েছিল তা আর জনবান্ধব হয়নি।
পদ্মা সেতু নিয়ে চীন, এমনকি পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়া দেখে বিএনপি বিব্রত। কারন এরাইতো তাদের রাজনীতির কেবলা। এরাই যদি আওয়ামী লীগের সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় ‘তাহা হইলে তাহাদের হইবেটা কী!’ আসলে পদ্মা সেতু নির্মানের কাজটি দেশেবিদেশে এমন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে যে এখানে নিন্দার কিছু ছিলোনা।
হাজার হাজার শ্রমিকের শ্রমেঘামে তাজমহল নির্মান করা হয়। পদ্মা সেতুও তেমন বাংলাদেশের তাজমহল হয়েছে। এরজন্য সবাই এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করে প্রশংসার প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। অতএব ‘তাহাদের মন ভালো নাই!’ এক মুখরা নারী এমপির জ্বরে আক্রান্ত ছবিও এখন তাই ভাইরাল হয়!
ঢাকায় নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিশেষ মিশন নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন মনে করা হয়। ইনি ইদানীং নানা জায়গায় গিয়ে বানী দেন! নির্বাচন কমিশনে গিয়ে বানী দেন! কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের অনুষ্ঠানে এসে বানী দেন! তার বানীতে খুশি খুশি নুরু–রেজা কিবরিয়াগং!
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে এই নেতারাও নিখোঁজ! পিটার হাসও পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেননা। ওয়াশিংটনে তিনি শলা–পরামর্শের জন্যে গেছেন! তার সাম্প্রতিক এক বানীর পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন প্রতিক্রিয়া দেবার পর পিটার হাসের অবশ্য ওয়াশিংটনে গিয়েই শলা–পরামর্শ করা ভালো।
কারন শেখ হাসিনার জমানায় তার এসব বানী বিতরন কাজে আসবেনা। আমেরিকার বুদ্ধি শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতোনা। হিলারি ক্লিনটন যে ডক্টর ইউনুস ইস্যুতে অযাচিত হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন এর প্রমান আছে। ডক্টর ইউনুসের মন্দ ভাগ্য হিলারি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি।
আওয়ামী লীগ আরেকটি তথ্য ভুলে যায়। গ্রামীণ ফোনে এক সময় ইনকামিং চার্জও ছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে সিটিসেলের মনোপলি মোবাইল ফোনের ব্যবসা ভাঙ্গতে গ্রামীণ ফোনের লাইসেন্স দেয়। কিন্তু মাফিয়া কোম্পানির ইনকামিং চার্জ বন্ধে উদ্যোগ নিলে ডক্টর ইউনুস ক্ষিপ্ত হন।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে ডক্টর ইউনুসের সম্পর্কের আবনতি তখন থেকে। মোহাম্মদ নাসিম তখন টেলিফোন মন্ত্রী। ডক্টর ইউনুস আওয়ামী লীগকে ভয় দেখাতে তখন বেশ কিছু মার্কিন সিনেটর–কংগ্রেসম্যানকে দিয়ে চিঠি লিখান। এতে বলা হয় ইউনুস তাদের বন্ধু।
ডক্টর ইউনুস ভেবেছিলেন এসব চিঠি দেখে শেখ হাসিনা ভয় পাবেন! কিন্তু শেখ হাসিনাতো সেই নেত্রী না। তিনি চিঠিগুলো আমাদের ছাপতে দেন। মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান প্রকাশ হয়ে গেলে ডক্টর ইউনুসের মুখে চুনকালি পড়ে। এরপর ১/১১’র সময় ডক্টর ইউনুস কি করেছেন তা সবাই জানে।
সামরিক শাসকদের পক্ষ নিয়ে তিনি কিংস পার্টি খুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সে পার্টির চেয়ারম্যান হবার খোয়াব দেখায় তা পন্ড হয়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপি গঠনের সময় জিয়াকে চেয়ারম্যান রেখে তিনি মহাসচিব হন। কিন্তু ডক্টর ইউনুস জেনারেল মইনকে চেয়ারম্যান না করায় একূল–ওকূল দুই কূল হারান। কাজেই তার সাধু সাজার চেষ্টা না করাই ভালো।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষন ছিল পরিশীলিত–রাষ্ট্র নায়কোচিত। জাতিকে স্বপ্ন দেখানোর প্রতীক এখন এই পদ্মা সেতু। দেশের মানুষ পক্ষে থাকলে কারও আলগা মোড়লিপনাকে অগ্রাহ্য করা চলে। পিটার হাসদের গতিবিধির ব্যাপারে সরকারকে সাবধান হতে হবে।
কারন এর আগে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস বঙ্গবন্ধু হত্যায় ভূমিকা রেখেছে। এর প্রমান আছে মার্কিন নথিতে। পিটার হাসগং আবার সে চেষ্টা করতে পারে। অতএব সাধু সাবধান। পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে যেন কোন ঢিলেমি না হয়। নাশকতার চেষ্টা হতে পারে যে কোন সময়।