শুক্রবার দিনটি আবার আমাদের করতে হবে

শুক্রবার দিনটি আবার আমাদের করতে হবে

ফজলুল বারী: শিক্ষক, গবেষক, নাট্যকার, বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক ডক্টর রতন সিদ্দিকীর ওপর হামলার প্রতিবাদে একটি অনুষ্ঠানে রতন সিদ্দিকী স্যারের বক্তব্য শুনছিলাম। ‘আমাদের জীবন থেকে শুক্রবারটা বেহাত হয়ে গেছে। শুক্রবার আর আমাদের নেই’ শিরোনামের প্রতিবাদ।

এতবড় পরিকল্পিত হিংস্র মৌলবাদী  হামলার পরও একজন জ্ঞানতাপস ব্যক্তিত্বের দৃঢ় কন্ঠে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলতে শুনে শ্রদ্ধার মাথা নুয়ে আসে। এরজন্য তাঁর পক্ষে লেখা দায়িত্ব মনে করেছি। আপনার পক্ষে থাকতে হবে স্যার। এরজন্যে সরকারকে বাধ্য করতে হবে।

ডক্টর রতন সিদ্দিকীর পরিবারের ওপর হামলা উপলক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবির বড়সড় মব সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সেই ঘটনার প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন সীমিত সংখ্যক মানুষ। এটাই হয়। এখন এমন একেকটি হামলার পর অনলাইনে অনেক মানুষ কথায় বাক্যে জামার আস্তিন গুটান!

কিন্তু মাঠের প্রতিবাদে আজকাল অল্প-সংখ্যক মানুষ অংশ নেন। এরমাঝে একজন লেখক-প্রকাশক রবীন আহসান সাম্প্রতিক সময়ে একলাই ‘নিপীড়নের প্রতিবাদের শাহবাগ’ শিরোনামে  প্রতিবাদের আয়োজন করে অনেককে বক্তৃতার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই সুযোগে তাঁকে এরজন্যে স্যালুট জানাই।

অসাম্প্রদায়িক লেখক-বুদ্ধিজীবী রতন সিদ্দিকীর হামলার আয়োজন যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবির করেছে। ‘ঘাদানিক’ গালিতে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং এর যোদ্ধাদের সংক্ষেপে ঘাদানিক গালি দেয় যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা।

আমি যখন জনকন্ঠে কাজ করতাম তখন সেই পত্রিকায় আশ্রয় নেয়া সাবেক দৈনিক বাংলার কিছু সাংবাদিকও আমাদের ‘ঘাদানিক’ নামে ডাকতেন! অথবা উপহাস করতেন! বিএনপির নেতাকর্মীরাতো বলে, আওয়ামী লীগে আশ্রয় নেয়া জামায়াত-শিবিরের অনেক পান্ডাও এই গালি দেয়!

জামায়াত-শিবির এই গালি দেবার যৌক্তিক যন্ত্রণা আছে।  কারন এই সংগঠন কি করতে পারে তারাই সবচেয়ে বেশি জানে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে এই সংগঠনের গড়ে তোলা আন্দোলনে তখন গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের প্রতীকি ফাঁসি হয়েছিল।

এই সংগঠনের আন্দোলনের কারনে দেশের সব বড় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হয়েছে এবং এখনও ফাঁসি হচ্ছে।  আওয়ামী লীগ সরকার ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারনে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু আন্দোলনটি গড়ে তুলেছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। অধ্যাপক রতন সিদ্দিকীর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা স্ত্রী ফাহমিদা হক এই সংগঠনের উত্তরা শাখার সভাপতি।

কাজেই যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবির অনেক দিনের জমানো যন্ত্রণা থেকে ওই হামলার ব্যবস্থা করেছে। তাঁর বাংলা ‘রতন’ নামটির হিন্দুয়ানি গন্ধ ছড়িয়ে তারা ওই হামলার ধর্মান্ধ লোকজন জোগাড় করে। ডক্টর রতন সিদ্দিকী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা স্ত্রী ফাহমিদা হক টিপ পরেন।

এটিও হামলার আয়োজন ঘটানোর আরেকটি উপসঙ্গ! সেই পুলিশ সদস্যের ‘টিপ কান্ডের’ কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা আমরা জানি-দেখেছি। বাংলাদেশ কি অদ্ভূত দক্ষতায় সেই ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে ফেলেছে! এমন ঘটনা লিখতে গেলে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কথা মনে পড়ে যায়!

এক সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে যখন নির্বাচনী ট্যুর করতাম তখন বিভিন্ন সমাবেশের রিপোর্টে খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্য লিখতে হতো প্রায়! ‘আর আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কি হবে জানেন, মসজিদে উলুধনি হবে, মা-বোনদের শাঁখা-সিঁদুর পরতে হবে’!

এভাবে বাঙালির সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ টিপকেও একদল হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি বানিয়ে ফেলেছে! অথচ বাঙালি কোন মেয়েটি অন্তত বিয়ের দিন টিপ পরেনি? রতন সিদ্দিকীর ওপর হামলার অনুসঙ্গ হিসাবে এভাবে তাঁর বাংলা নাম, স্ত্রীর সাংগঠনিক পরিচয় আর কপালের টিপকে ব্যবহার করা হয়েছে।

‘ঘাদানিক’ গালি, বাংলা ‘রতন’ নাম, ফাহমিদা হকের কপালের ‘টিপ’, এসবের সঙ্গে ‘নাস্তিক’ গালিটাকে যুক্ত করে ওই হামলা করিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবির। ‘আস্তিক’, ‘নাস্তিক’ এদেশে কাউকে অপদস্থ-আক্রমন করার পুরনো অভ্যাস। ‘পাপপূন্যের বিচার এখন মানুষে করে’!

‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাস লেখার পর নাস্তিক আখ্যা দিয়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এর আগে বোমা হামলা চালিয়ে ব্যাপক হত্যাকান্ড ঘটানো হয় যশোরে উদিচীর সম্মেলনে, ঢাকায় সিপিবির সমাবেশে এবং রমনার বটমূলে।

এরপর একই স্টাইলে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেন বিএনপির চলতি নেটা তারেক রহমান! যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিকে কেন্দ্র করে গণজাগরন মঞ্চের গণজাগরনে শুরুর দিকে বিএনপির তরুন নেতাকর্মীরাও যোগ দিয়েছিল।

ওই সময় সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসে খালেদা জিয়া যখন ওই গণজাগরনকে নাস্তিকদের সমাবেশ নাম দেন তখন সেখান থেকে সরে যায় বিএনপির সেই সব তরুন নেতাকর্মী-সমর্থকরা। এরপর নাস্তিক আখ্যা দিয়ে একের পর এক ব্লগারকে হত্যা করা হয়। প্রান বাঁচাতে অনেকে দেশ ছেড়ে যান।

আওয়ামী লীগের অনেকে মাঝে মাঝে হেফাজত সহ অমুক অমুক দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের জামায়াত-শিবির বিরোধী বলে জ্ঞান দেন! কিন্তু এরা যে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবিরের আরেক রূপ-বি টিম তা প্রকাশ পেয়ে যায় শাহবাগের প্রিয় প্রজন্ম তারুণ্যের গণজাগরনের পর।

ওই গণজাগরনকে নাস্তিকদের সমাবেশ বলে প্রতিরোধের ডাক দেয় হেফাজত! গণজাগরন মঞ্চের নেতাদের তারা চট্টগ্রামে ঢুকতে দেয়নি! এরপর তারা বিএনপি-জামায়াত-এরশাদের সমর্থনে মতিঝিলে সমাবেশ ঘটিয়ে তান্ডব চালায়-কোরান পোড়ায়, এরপর কান ধরে বিদায় নেয়!

সরকার পরে রেলওয়ের জমি সহ নানাকিছু দিয়ে তাদের সঙ্গে সমঝে চলার নীতি নেয়! কিন্তু এতে করে বিএনপি সাময়িক হতভম্ভ্ব হলেও আওয়ামী লীগ বা দেশের কোন লাভ হয়নি তা সবাই নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময় দেখেছে। ব্রাহ্মনবাড়িয়া রেলস্টেশন সহ নানা স্থাপনা তারা পুড়িয়ে দিয়েছে।

স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বর্ষপূর্তি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশের কোন মৌলবাদী দল কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনি। কিন্তু তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করতে দেয়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য তারা বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দেবার ধৃষ্ট হুমকি দিয়েছিল!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সহযোগী ও এক কোটি শরণার্থীর আশ্রয়দাতা দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর পন্ড করতে তারা ধংসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। সবকিছুর সঙ্গে এরা আস্তিক-নাস্তিক বিষয়গুলোকে সরলপ্রান মানুষজনকে বিভ্রান্ত করতে কাজে লাগায়।

ডক্টর রতন সিদ্দিকীর ওপর হামলার সময়ও তারা একই কায়দা নিয়েছে। উত্তরার ৫ নং সেক্টরে তাদের পারিবারিক বাড়ির ড্রাইভওয়েতে প্রথমে মোটর সাইকেল রেখে পথ আটকে তারা পরিস্থিতির সূচনা করে! এরপর এরা এই জ্ঞানতাপস অধ্যাপককে অকথ্যভাষায় গালিগালাজ করে তাঁর গায়ে আশ্রয় দিয়েছে!

তাঁর স্ত্রী, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উত্তরা শাখার সভানেত্রী ফাহমিদা হককে ক্ষমা চাইবার জন্যে চাপ সৃষ্টি করেছে! এরজন্যে বাসার সামনের মসজিদের মুসল্লীদের তারা ভুল বুঝিয়ে উত্তেজিত করে হামলায় জড়িয়েছে! RAB সদস্যরা সেখানে দ্রুত পৌঁছে যাওয়ায় রক্ষা পেয়েছে পরিবারটি।

এসবের প্রতিবাদে আয়োজিত এক সমাবেশে রতন সিদ্দিকী আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমাদের জীবন থেকে শুক্রবারটা বেহাত হয়ে গেছে। শুক্রবার আর আমাদের নেই’! শুক্রবারকে ব্যবহার করে তাঁর ওপরও হামলা করা হয়েছে। অথচ সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিতে এদেশে শিল্প-সংস্কৃতির অনেক অনুষ্ঠানও হয়। এক সময় শুভমুক্তি শুক্রবার’ শিরোনামে মুক্তি পেতো নতুন ছবি।

কিন্তু আজকাল শুক্রবার দিনটিতে ঢাকা সহ সারাদেশে জুম্মার নামাজের মুসল্লী জমায়েতকে কাজে লাগিয়ে বিশেষ লোকজন অশান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়! শান্তির ধর্মকে কাজে লাগানো হয় অশান্তি সৃষ্টির কাজে! পুলিশ সহ আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের এদিন বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়।

রতন সিদ্দিকীর ওপর হামলার দিন যে লোকটি তাঁর বাড়ির সামনে মোটর সাইকেল রেখে ঘটনার সূচনা করা হয়েছিল তাকে কী গ্রেফতার করা হয়েছে?  সে বাড়ির সিসিটিভির ফুটেজ দেখে দেখে অশান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের সেরা একজন জ্ঞানতাপস অধ্যাপক পরিবারের ওপর আক্রমনকারীদের গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখিন করা হবে কী?

না অনেক ঘটনার সঙ্গে এই ঘটনাও ধামাচাপা দেয়া হবে? এতে কিন্তু  দেশের  কোন লাভ হচ্ছেনা। দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত লোকজনের এমন ঘটনার প্রতিবাদে ধারাবাহিক প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে। সরকারকে অবশ্যই অশান্তির লোকজনকে ধরে বিচারের সম্মুখিন করতে।

আমাদের ক্ষমা করবেন স্যার। এতকিছুর পরও আপনার পরিবারের প্রতিবাদ একটি সাহসী দৃষ্টান্ত। এই প্রতিবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। মানুষকে দিতে হবে প্রকৃত শিক্ষার-বাঙালির সংস্কৃতির আলোর ছটা। পহেলা বৈশাখের মতো সাংস্কৃতিক প্রান প্রবাহে মানুষকে জাগিয়ে তুললে তারা হারবে।

শুক্রবারটাও আবার আমাদের হবে স্যার। জয় বাংলা।