তেলের দাম বাড়ালে কি প্রতিক্রিয়া হয় দেখেছেন

তেলের দাম বাড়ালে কি প্রতিক্রিয়া হয় দেখেছেন

ফজলুল বারী: পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে কি যে আনন্দ-প্রতিক্রিয়াই না হয়ে গেলো দেশজুড়ে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে বাস করা বাংলাদেশিদের মাঝেও এই আনন্দ হৃদয় ছুঁয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছিলেন, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারে নাই।

যদি কোন জরিপ হতো দেখা যেত এক পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা তখন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে! কিন্তু জোয়ার শেষে ভাটার টান লাগতেও যে সময় লাগলোনা! এই ভাটা এমন এক ভাটা যে এরপরও যে প্রতিদিন দেশের নদী-সমুদ্রে জোয়ার আসছে যাচ্ছে তা কেউ আর জানতেও চাইছেনা!

বিএনপির পতনের বড় একটি কারন ছিল বিদ্যুৎ সমস্যা। বিদ্যুতের জন্যে কানসাটে গুলি করে মানুষ মারার ঘটনা তখন দেশের মানুষের মনে দাগ কাটে। কানসাটের ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়ে  আওয়ামী লীগ লাভবান হয়। কানসাট আন্দোলনের নেতা গোলাম রাব্বানিকে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীও করা হয়েছে।

ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বিদ্যুৎ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করতে চালু করে কুইক রেন্টাল বিদ্যূৎ। অনেক দাম পড়ে সেই বিদ্যুতের। আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়াউর রহমানের মতো করে বলা শুরু করেন, মানি ইজ নো প্রবলেম। জিয়াউর রহমান কথায় কথায় এই হুংকার ছুঁড়তেন,  মানি ইজ নো প্রবলেম!

জিয়ার মৃত্যুর পর এই কথাটি বেশ চাউর হয়েছিল। তাহলো দেশের মানুষ দুটি কথা শুনেছে। মানি ইজ নো প্রবলেম আর মানি ইজ প্রবলেম। শেষেরটাই সত্য। দেশের টাকায় পদ্মা সেতু, নিজের টাকায় পদ্মা সেতু কথাগুলো চাউর হয়েছিল বেশ। এত এত টাকা। হঠাৎ সব টাকাগুলো কোথায় গেলো।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পরিবেশ মন্ত্রী থাকতে সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। বাঘগুলো সব গেলো কোথায়,  জিজ্ঞেস করলে মন্ত্রী বলেন, বাঘগুলো সব সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে বেড়াতে গেছে! পরে যদি গননায় পাওয়া যায় তখন ধরে নিতে হবে বাঘগুলো আবার ভারত থেকে ফিরে এসেছে!

বাংলাদেশের শতভাগ বিদ্যুতের উৎসব ফিকে হয় লোডশেডিং’এর প্রত্যাবর্তনে। আমরা শুধু ইউক্রেন যুদ্ধের দোষ দিলাম। আমরা দেশের মানুষকে বোকা ভেবে লিখে দিলাম অস্ট্রেলিয়ায়ও লোডশেডিং হচ্ছে! ডিজিটাল বাংলাদেশের মানুষ যে এখন গুগলে সার্চ দিয়ে ফ্যাক্ট চেক করতে জানে তা ভাবলামনা!

শতভাগ বিদ্যুৎ সাফল্যে দেশের নানাক্ষেত্রে যে অগ্রগতির আশা করা হয়েছিল তা থমকে গেছে। আমাদের যেহেতু মানি ইজ নো প্রবলেম, শ্লোগান ছিল-তাই এক ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে আমাদের থমকে যাবার কথা ছিল না। সত্যটা অবশেষে জানা গেলো, মানি ইজ প্রবলেম।

আমরা দেশের পাচার হয়ে যাওয়া টাকা আমরা ফেরত আনতে পারিনি। তারেক-কোকো-গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের যে সব টাকা ফেরত এসেছে সেখানে আমাদের কোন কৃতি্ত্ব নেই। সে টাকাগুলো এসেছে মার্কিন আর সিঙ্গাপুরের গোয়েন্দা চ্যানেলে। কিন্তু আমেরিকার ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি অথবা পাচারের কোন টাকায় ফেরত আসেনি।

বিদ্যুতের পর তেলের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। বাজার অর্থনীতির দেশে বিদ্যুৎ আর জ্বালানি তেলের আমদানি-ব্যবসার নিয়ন্ত্রন কেন সরকারের হাতে থাকবে সে জবাব আজ পর্যন্ত পাওয়া গেলোনা। দেশের মানুষ বুঝতে পারে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনা কোথায় মজা!

বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর মতো অস্ট্রেলিয়ার বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেল সেক্টরও বেসরকারে খাতে। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর মতো এদেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলোও প্রতিযোগিতামূলক গ্রাহকদের নানান সুযোগ-সুবিধা-ব্যয় সাশ্রয়ী অফার সহ ব্যবসা বাড়ানোর কাজ করে।

বাংলাদেশে দুর্নীতির নিয়ন্ত্রন রাখতেই কি এসব সেক্টরের বেসরকারিকরনে অনাগ্রহ? অথবা ভোটের বাজার ঠিক রাখতেও এদেশের সরকারগুলো ভুর্তকি দিয়ে হলেও এই সেক্টরগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রেখেছে। কিন্তু আখেরে কি ঘটছে? এক তেলের দাম বৃদ্ধিতে কেন্দ্র করে গোটা দেশ যেন হঠাৎ করে সরকারের বিপক্ষে চলে গেছে।

ওবায়দুল কাদের বলেছেন,  নিরুপায় হয়ে তারা দাম বাড়িয়েছেন! এত নিরুপায় হতে তাদের কে হাতে পায়ে ধরেছে জ্বালানি তেলের পুরো সেক্টরটা সরকারের নিয়ন্ত্রনে রাখতে? বেসরকারি কোম্পানিগুলো কী কখনও ভুর্তকি দিয়ে ব্যবসা করতো? না প্রতিযোগিতা করে? টুডে অর টুমরো এসবতো বেসরকারিখাতে ছাড়তেই হবে। কিন্তু এখনই তেমন উদ্যোগ নয় কেন?

আমাদের দেশের রাজনৈতিক এক্টিভিস্টরা দলীয় সরকারকে ভালোবাসেন বলে অতিদ্রুত কোন দেশে তেলের কত দাম তা চার্ট বানিয়ে ফেসবুকে আপলোড করে দিয়েছেন! বড় সরল এসব এক্টিভিস্টের মন! যে সব দেশের উল্লেখ করা হয়েছে তাদের দেশে কী এগুলো সরকার ঠিক করে দেয়?

না ডলারের দামের সঙ্গে এসবের দামও ওঠানামা করে? তাদের দেশে কী তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা থেকে গণপরিবহন উধাও হয়ে যায়? পেট্রোল পাম্পগুলো তাদের পুরনো মজুদ নতুন দামে বিক্রি করে লালে লাল হয়ে যায় রাতের মধ্যে? ফ্যাক্ট চেক দিলেইতো এখন সবকিছু জানা যায়।

তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার বৈঠক করে যানবাহনের ভাড়া বাড়িয়েছে। লঞ্চের ভাড়া বাড়বে। সরকারি মালিকানাধীন রেলের মন্ত্রী বলে দিয়েছেন ভাড়া তারাও বাড়াবেন। ট্রাকের ভাড়া বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সব পণ্যমূল্য। বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্যমূল্য বাড়াতে তেলের দাম বাড়ানো লাগেনা।

মন চাইলো কিছুদিন পরপর সিন্ডিকেট করে বাড়ানো হয়। তেলের দাম সরকার বাড়িয়ে দেয়ায় তাদের মনে যে ঈদ লেগেছে! চাল-ডাল-নুন-তেলের দাম আবার বেড়েছে। সব সবজির দাম বেড়েছে বাজারে। কারন ট্রাকের খরচ বেড়েছে। পুলিশের খরচও কমে যায়নি। সবকিছুর দাম বাড়ায় পুলিশ নিশ্চয় বাড়িয়ে দেবে তাদের চাঁদার রেট!

যারা তেলের দামের বিভিন্ন দেশের চার্ট করেছেন তারা কি দেশের মানুষকে চার্ট করে দেবেন তেলের দাম বাড়ানোয় কাকে কোথায় যেতে কত বেশি ভাড়া গুনতে হবে বা বেশি দামে গ্রোসারি সামগ্রী সহ নানাকিছু কিনতে হবে। যার বেতন দশ হাজার, বাকি টাকা তাকে কে দেবে? এই চার্টটা করবে কে?

আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের জনবান্ধব সরকার মনে করে। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা সবই জনবান্ধব ছিল। কিন্তু তাদের কোন সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া কি দাঁড়াবে তা কী কখনও আর হিসাব কষে এই জনবান্ধব সরকার? জনগনকে বাকি টাকাগুলো কে দেবে? কৃষিমন্ত্রী খুব রূঢ় একটি মন্তব্য করেছেন!

তাহলো, দেশের কৃষকেরা স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে হলেও ফসল ফলায়। কথা সত্য। আরও সত্য তিনি এমন একজন অযোগ্য-ব্যর্থ মন্ত্রী যে তার কৃষকদের কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারেননি। নিজের নানাবাড়িতেও মিন্টো রোডের আদলে তিনি প্রাসাদ বানিয়েছেন। কিন্তু এই বাজারে তার কৃষক আরও নিঃস্ব হবে।

তখন সে একটা ঘর পাবে আশ্রয়ন প্রকল্পে! কারন এমন নিঃস্ব মানুষদের ঘর দেবার জন্যেই আশ্রয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু যার সব ছিল হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে সে সমৃদ্ধ হবার চেয়ে নিঃস্ব কেন হচ্ছে তা জানলোনা কেউ। এমন একটি দেশের জন্যে আওয়ামী লীগ যুদ্ধ করেনি। অন্যরাতো আরও হতচ্ছাড়া।

You may also like

মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের চিঠি মানে কোরান বা বাইবেল নয় !

ফজলুল বারী:একটি চিঠি নিয়ে অনলাইন এখন গরম! অনেক