ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোশাক নিয়ে ভয়ংকর ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোশাক নিয়ে ভয়ংকর ছবি

ফজলুল বারী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তোলা ভয়ংকর কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাসছে। কতিপয় ছেলেমেয়ে পোস্টারে পোশাক নিয়ে কিছু মন্তব্যসহ রাজু ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে তা ছড়িয়ে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর উৎস হাইকোর্টে পোশাক নিয়ে এক বিচারপতির মন্তব্য!

নরসিংদী রেলস্টশনে পোশাকের কারনে হেনস্থার শিকার মহিলাকে দোষারোপ করে বক্তব্য রেখেছেন ওই বিচারপতি! প্রধান বিচারপতি তাকে থামাননি। এভাবে দেশে যার যে দায়িত্ব তা পালন করছেননা। অথবা এড়িয়ে চলছেন! এমন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যে যেভাবে পারছে দেশটাকে ভীতিকর এক চেহারায় নিয়ে যাচ্ছে। যা কিন্তু বাংলাদেশের প্রকৃত চেহারা নয়। বাংলাদেশের নানাকিছু চূড়ান্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। দেশের নাম, পতাকা, সংবিধান, নীতি-নৈতিকতা, পোশাক-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ সহ নানাকিছু। মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের ছবিসব মনোযোগ দিয়ে দেখুন। মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি দেখুন। ছবি দেখুন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের।কত শালীন-স্নিগ্ধসব ছবি। কোথাও কোন উগ্রভাব নেই। কাউকে কটাক্ষ অথবা ভয় দেখানোর প্রবনতা নেই। এসবই আমাদের সংস্কৃতি। এখন যে ছবিগুলো দেখানো হচ্ছে এগুলো বিজাতীয় সংস্কৃতি। যারা দেখাচ্ছে তারা বিস্তর পড়াশুনা করেনি। দেশ দেখার সুযোগ পায়নি। পড়তে চাইলে অনলাইনের পৃথিবী খোলা। এই সময়ে এই পৃথিবীর অগ্রসর-মুক্ত অঞ্চলে তার বয়সী ছেলেমেয়েরা কী ভাবছে আর সে কী ভাবছে। কিছু পোশাক বা বক্তব্য দেখিয়ে সে মনে করছে ধর্মের পক্ষে দারুন বিশেষ কিছু করে ফেলছে! আসলে তা নয়।

তার কথায় ধর্ম সমৃদ্ধ হয়ে যাবেনা বা বাঙালি সংস্কৃতি উচ্ছন্নে যাবেনা। কোনটাই অত ঠুনকো বিষয় নয়। এই বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা একবারও ভাবছেনা তাহলো সে বা তারা আরেকজনের সংস্কৃতি নিয়ে উতালা হচ্ছে। তার বা তাদের মা-বাবা’র সংস্কৃতি আরেকজন নিচ্ছে কিনা বা নিতে উদ্ধুদ্ধ করতে পারছে কিনা।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইন্দোনেশিয়া বা সামোয়া দ্বীপে গেলে সেদেশের জাতীয় পোশাক পরে মিডিয়ার সামনে আসেন। বাংলাদেশে থাকা বিদেশিনীরা পহেলা বৈশাখে শাড়ি পরে বাঙালি সেজে মঙ্গল শোভাযাত্রা দেখতে যায়। বাঙালির উৎসব, পার্বনে তারা বাঙালি সাজতে পারলে আনন্দ অনুভব করেন।

বাংলাদেশ সফরে আসা বিদেশিনী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে শাড়ি পরে যাবার চেষ্টা করেন। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার যত পুরনো ছবি পাবেন, প্রায় সবকটিই শাড়ি পরা স্নিগ্ধতার। আর বাংলাদেশের এই প্রজন্মের কিছু মেয়েরা প্রচার করছে আরব সংস্কৃতির পোশাক!

মরুরদেশে আপনি যত বেশি কাপড় পরে নিজেকে ঢেকে রাখতে পারবেন তত আপনার শরীরের সেই অংশগুলোয় তাপ প্রবাহ কম লাগবে। আর এরা মনে করছে এসব বুঝি ইসলামী পোশাক! বাঙালি মায়েরা মেয়েরা যুগ যুগ ধরে শাড়ি পরে নামাজ পড়েছেন। এখনও পড়েন। এতে ইসলাম ধংস হয়নি।

মধ্যপ্রাচ্যের যে সব দেশ থেকে হিজাব-নেকাব-বোরখা এসেছে, সেইসব দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় মানে তাদেরও পরাজয় ছিল। সেই ক্রোধ তাদের আজও যায়নি। তারা বাংলাদেশেকে স্বীকার করেছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর।

এরপর তাদের পোশাক ধর্মের নামে আমাদের দিকে ঠেলে পাঠিয়েছে বা আমাদের লোকজন তা নিয়ে এসেছে, যা সেই সব দেশের সিংহভাগ নারী এখন আর ব্যবহার করেনা। তারাও এসব থেকে মুক্তি চাইছে। এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সৌদি আরব সফরের ছবি দেখেছেন?

জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ক্রাউন প্রিন্সের নেতৃত্বে সৌদি টিমে যে নারী মন্ত্রী সদস্য ছিলেন তিনি বোরকা অথবা হিজাব পরিহিতা ছিলেননা। সৌদি আরব তাদের নানাকিছু প্রতিদিন নারীদের জন্যে উন্মুক্ত করছে। এতে করে ইসলাম ধংস হয়ে যাচ্ছেনা বা বাংলাদেশের লোক হজ করতে অন্যদেশে যায়না।

আমাদের এই তল্লাটে বাঙালি মুসলিম রমনীকূল বহুকাল আগে থেকেই ধর্মকর্মে পুরুষদের চাইতে তুলনামূলক এগিয়ে। এক্ষেত্রে বাঙালির চিরায়ত পোশাক কখনও ধর্মের জন্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ওই সময়গুলোতে দেশে ঘুষ-দুর্নীতি-নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ছিল অনেক কম।

এখন যারা বিজাতীয় পোশাকে মন দিয়েছে তাদের বাদ-বাকিটা অন্ধকার। যাদের পোশাক এরা এখানে আনছে তারা এসব পোশাক ত্যাগ করছে। ১৯৯৭ সালে আমি রিপোর্টের কাজে মিশর যাই। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি ছাত্র যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়, যারা দেশে থাকতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মাদ্রাসায় পড়তেন।

তারা আমাকে বলেন মিশর না এলে জানতেননা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কতটা অধুনিক ও একোমডেটিভ। মিশরের প্রধান ধর্মীয় নেতা গ্রান্ড মুফতির ফতোয়া আইন হিসাবে গ্রহন করা হয়। দাঁড়ি রাখেননা গ্রান্ড মুফতি। কারন মুসলিম ব্রাদার হুড মিশরে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত। এর সদস্যরা দাঁড়ি রাখেন।

গ্রান্ড মুফতির ফতোয়া অনুসারে মিশরে ব্যাংকের সুদ হালাল। এর যুক্তি দেখানো হয়েছে গ্রাহকদের আমানত নিয়ে ব্যাংকগুলো ব্যবসা ও মুনাফা করে। গ্রাহকদের সেখান থেকে লভ্যাংশ দেয়। ১৯৯৭ সালেই মিশর-জর্দানের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক-ব্যবসা-বানিজ্য সব ছিল।

কায়রোর বাংলাদেশী ছাত্ররা বলছিলেন দেশে মাদ্রাসায় তারা শার্ট-প্যান্ট পরতেননা। এখানে পরেন। যার খুশি এরাবিয়ান পোশাকও পরেন। কে কি পরলো না পরলো এ নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। ফেরাউনের মমি দেখিয়ে শত বছর ধরে পর্যটন ব্যবসা করেই গেলো মিশর সরকার।

পিরামিডের ভিতর থেকে মমিগুলো বের করে তারা নিয়ে গেছেন জাদুঘরে। এখন পিরামিড এলাকায় ঢুকতে একটা ফী দিতে হয়। পিরামিডের ভিতরে ঢুকতে দিতে হয় আরেকটা ফী। জাদুঘরে ঢুকতে আবার ফী লাগে। জাদুঘরের যে কক্ষে ফেরাউনের মমি সেখানে ঢুকতে ফী লাগে সবচেয়ে বেশি।

এরজন্য কেউ একজন ফতোয়া দিয়ে বলেনি এটা হারাম। মুক্তবাজার অর্থনীতির সুদ-ঘুষ-দুর্নীতি-মিথ্যাবাদীদের দেশে থাকা কী হালাল? মিশর-জর্দানের পর এরমাঝে কাতার-আরব আমিরাত ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ইসরাইলি বিমানের জন্যে আকাশ উন্মুক্ত করেছে সৌদি আরব।

এভাবে মুসলিম বিশ্বও প্রতিদিন মুক্ত-উন্মুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের সিংহভাগ লোক স্থায়ীভাবে থাকার জন্যে সৌদি আরবে নয়, আমেরিকা-ব্রিটেন-অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপের দেশগুলোতে যেতে চান। আর তালেবান-পাকিস্তানি স্টাইলে একদল বাংলাদেশকে দিনে দিনে শুধু গুহায় ঢোকাতে চাইছে!

জঙ্গী হামলার ভয়ে এখন প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালাও সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে! কিন্তু জঙ্গীরা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ঢুকে পড়েছে সেদিকে কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নজর আছে? না সস্তায় চা-সমুচা-সিঙ্গারা-আলু চপের গৌরব নিয়ে ব্যস্তই থাকবেন ভিসি!

মুক্তিযুদ্ধ সহ নানান আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অন্তত এখানে ধর্মের নামে সব শয়তানি বন্ধ করা দরকার। ঘরে-হলের রূমে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে বসে যত বেশি ধর্ম চর্চা করুন। টিএসসি গান-বাজনা-সংস্কৃতি চর্চার জন্যে বানানো হয়েছে। নামাজ পড়ার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ আছে।

পোশাক নিয়ে বিচারপতির উস্কানির পর যে কয়েক ছেলেমেয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাশে দাঁড়িয়েছে, তারা নিশ্চয় মোক্ষম জবাব পেয়ে গেছে। এত মানুষের প্রতিবাদ! এটাই কিন্তু বাংলাদেশ। এভাবে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে। জোরদার করতে হবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

তাহলে কেউ আমাদের সংস্কৃতিকে দাবায়ে রাখতে পারবেনা। এই ছোট মেয়েটির মতো প্রজন্মকে বোঝাতে হবে, পৃথিবীর যত নারী বিজ্ঞানী, তাদের প্রায় সবাই স্বল্পবসনা। অথবা তারা শীতে বেশি পোশাক, গরমে অল্প পোশাক পরেই অভ্যস্ত। একজন বিজ্ঞানী তার বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবেন। পোশাক ছোট বা বড় তা নিয়ে নয়।