দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও তিনি ‘চিফ’, নাগরিকদের কাছেও তাই
অনলাইন ডেস্কঃ ১২ আগস্ট ২০১৫
উত্তর আমেরিকায় পুলিশের শীর্ষ ব্যক্তিটির পদবি হচ্ছে, ‘চিফ অব পুলিশ’। সম্বোধনের সুবিধার্থেই হোক আর অন্য কোনো কারণে, পুলিশের প্রধানকে সংক্ষেপে ‘চিফ’ বলেই ডাকা হয়। দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও তিনি ‘চিফ’, নাগরিকদের কাছেও তাই।
সম্বোধনের ক্ষেত্রে তিনি ‘চিফ’ হলেও কার্যক্রমে এই সম্বোধনের প্রতিক্রিয়া কদাচিৎ দেখা যায়। তার কাজ হচ্ছে, বাহিনীর কার্যক্রম তদারকি করা, সেখানে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগের এখতিয়ারও তার আছে। নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং নির্বিঘ্ন জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদির বিষযে সবাইকে অবহিত করার জন্য তিনি কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন।
তা বলে কিন্তু মিউনিসিপ্যালিটি তথা সিটি কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণাধীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান হিসেবে পুলিশ চিফকে মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গেও কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায় না, রাষ্ট্রের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ তো অনেক পরের বিষয়।
উত্তর আমেরিকার কোনো দেশের পুলিশের সঙ্গে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর তুলনা করব না। দুটি দেশের পুলিশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। উত্তর আমেরিকায়, যেমন কানাডায় যেখানে পুলিশ সিটি কাউন্সিলের কর্মচারী মাত্র, বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে। সে দিক থেকে বাংলাদেশের পুলিশের অবস্থান কানাডীয় পুলিশের চেয়েও অনেক উপরে। কিন্তু ক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশের পুলিশের অবস্থান কোথায় সেটি অবশ্যই আলোচনাসাপেক্ষ।
বাংলাদেশের পুলিশের ক্ষমতা বা সক্ষমতা যাই হোক না কেন, তারা বিশ্বের যে কোনো দেশের পুলিশের চেয়ে অধিকতর স্বাধীনতা ভোগ করেন, অনেক বেশি ক্ষমতাও। সে ক্ষমতা কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষে্ত্রে নয়, নিজেদের আধিপত্য ও প্রভাব দেখানোর জায়গায়। বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত বাংলাদেশের পুলিশের কর্তাব্যক্তিরাই রাজনীতিকদের মতো বক্তৃতা করতে পারেন। মিডিয়াও এখতিয়ার বা যুক্তির প্রশ্ন না তুলে পুলিশ কর্তাদের সব ধরনের বক্তব্য প্রচার করে। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা এ ধরনের কথা বলতে পারেন কিনা সে প্রশ্ন করারও কেউ নেই বাংলাদেশে!
আর এ জন্যই মাঝে মধ্যে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় যে, পুলিশের কর্তাব্যক্তিটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হয়ে বক্তৃতা করছেন, না কি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা হয়ে। নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব ও পদের এখতিয়ার প্রায়শই ভুলে যান কিংবা মানেন না বলেই হয়তো তারা ‘সীমার বাইরে’ গিয়ে কথাবার্তা বলেন। আবার নিজেরা সেটা করেও অবলীলায় নাগরিকদের ‘সীমা-লঙ্ঘনের’ বার্তা শোনান।
পুলিশের আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক নাগরিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, দেশের প্রচলিত আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা অপরাধ। তেমন কাজ করা ব্যক্তির সাজা ১৪ বছর। তবে কেউ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে তাকে হত্যা করতে হবে, তা মানা যায় না, সেটাও বলেছেন তিনি।
আইজিপির এ বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের এক বিন্দু দ্বিমত নেই। কারও ধর্মীয় অনুভূতি কেন, অন্য যে কোনো অনুভূতিতে আঘাত করাও বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে ‘হেইট ক্রাইম’ নামে কঠিন একটা আইন রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণার উদ্রেক করে এমন আচরণ ও মন্তব্য এ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ অপরাধ বলে বিবেচিত হলে আপত্তির কিছু দেখি না।
সমস্যা হল, বাংলাদেশের আইন ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ বিষয়টির ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট করা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেননি আইজিপি। আইন কি বলেছে যে, কেবল মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ? নাকি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জাতিগত সংখ্যালঘু, আদিবাসী সবার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করাই অপরাধ?
এই যে বেছে বেছে হিন্দু ধর্মালম্বী ব্লগারদেরই জবাই করে হত্যা করা হচ্ছে, এতে কি ওই ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে না? সেটি কি প্রচলিত আইনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে? রামুতে যখন বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের উপসানালয় ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাতে কি বৌদ্ধদের অনুভূতিতে আঘাত করেনি? সারা বছর ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ভাঙা হয়, তাতে কি তাদের অনুভূতিতে আঘাত করা হয় না?
রাষ্ট্রে যদি যে কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা অপরাধ বলে বিবেচিত হয়, তাহলে সে সব অপরাধের জন্য কত জনের শাস্তি হয়েছে বা কজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে সেটা আমরা জানি না। গ্রেফতার হয়েছে কেউ সে রকম খবরও খুব শোনা যায় না। আইজিপি এ সব নিয়ে কখনও কথা বলেননি। কোনো তথ্য-উপাত্ত বা পরিসংখ্যানও দেননি। তাহলে তার বক্তব্যের ‘শানে নুযুল’ কী? ‘বাংলাদেশের আইনে কেবল মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করাই অপরাধ’– এমন একটি বার্তাই কি আইজিপি দিতে চেয়েছেন? বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনও কি তাই বলছে?
সংবিধানে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলামের বিধানটি এখনও অক্ষুণ্ন রয়েছে, সে কথা বিবেচনায় রাখলেও, বাংলাদেশের সংবিধান অন্য ধর্মের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দিয়েছে। সর্বোপরি, নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ নিরাপত্তা বিধানের কাজটি করবে রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী। জনগণের কাছ থেকে নানাভাবে আদায়কৃত কর দিয়ে এই বাহিনীর ভরনপোষণের ব্যবস্থা হয়।
তারপর, সেই নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারা পুলিশের ব্যর্থতা কেবল নয়, দায়িত্বপালনে অক্ষমতাও। অক্ষম কোনো বাহিনীর প্রধান হিসেবে আইজিপি নাগরিকদের পরামর্শ দিতে পারেন কিনা সে প্রশ্নও তো নাগরিকদের পক্ষ থেকে উঠতে পারে।
ব্লগারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। সেটি প্রচলিত আইনে অপরাধ এবং তার জন্য ১৪ বছরের জেলের বিধান রয়েছে বলে আইজিপি নাগরিকদের জানিয়েছেন। তার আগে তিনি কিংবা তার বাহিনী কি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন? ধর্ম অবমাননার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ব্লগারদের আইনের মুখোমুখি করার ‘দায়িত্ব’ তো পুলিশের। পুলিশ সে ‘দায়িত্ব’ও পালন করেনি। একের পর এক ব্লগার যখন জবাই হয়ে যাচ্ছেন, তখনও পুলিশের ভূমিকা কী?
এ পর্যন্ত একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত পুলিশ শেষ করে আনতে পেরেছে বলে জানা যায় না। কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ খুনিদের ধরতে পেরেছে বলায যাচ্ছে না। বরং একটি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সময় পথচারীরা দুই খুনিকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছিল। তারপরও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে নেপথ্যের হুকুমদাতাদের সম্পর্কে সামান্যতম তথ্য পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি।
ব্লগারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে
ঘটনা দাঁড়াচ্ছে এই যে, পুলিশ খুনিদের ধরতে পারবে না, জনতা খুনিদের ধরে তাদের হাতে তুলে দিলেও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের নেপথ্য শক্তিকে পুলিশ চিহ্নিত করতে পারবে না, তাহলে তারা কী কাজ করছে? যে বাহিনী কিছুই করতে পারে না, সে বাহিনীর প্রধান নাগরিকদের ‘নসিহত’ করতে আসেন, সেটা চিন্তার বিষয় বটে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, নাগরিকদের নসিহত দেবার জন্য তিনি এমন একটা সময় বেছে নিয়েছেন যখন ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নিলয় হত্যাকাণ্ডের পর জাতি শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন ও শোকাহত। ছ মাসের মাথায়েএ ধরনের চতুর্থ হত্যাকাণ্ডের দু দিন পর পুলিশ প্রধান যখন সংবাদ সম্মেলন করেন, তখন নাগরিকরা তার কাছে আশ্বাসের কথা শুনতে চায়, জানতে চায় খুনিদের গ্রেফতারের ব্যাপারে পুলিশের পদক্ষেপের বিবরণ। নিজেদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও চান সব নাগরিক।
আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক সে পথে যাননি। তিনি বরং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হত্যাকাণ্ডের সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেছেন যা অনাকাঙ্ক্ষিত, অগ্রহণযোগ্য। তিনি নাগরিকদের মনে নিরাপত্তার বোধ তৈরির চেষ্টা না করে বরং খুনিদের কাছে ‘বার্তা’ পৌঁছে দিয়েছেন। ঘাতকের হাতে নিহত হওয়া একজন নাগরিকের লাশের উপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান যখন খুনিদের ‘নিরাপত্তার বার্তা’ দেন তখন তার এ পদে থাকার বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে ওঠে। এখানে সরকারের দায়িত্ব হল দ্রুততম সময়ে তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া।
এটাও সত্যি যে, অনেক সময় অপরাধীদের চিহ্নিত বা গ্রেফতার করা রাষ্ট্রের প্রশিক্ষিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্যও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পশ্চিমের উন্নত বিশ্বেও এমনটি বেশ ঘটে। কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এটাই প্রমাণ করা যে, তারা অপরাধীদের ধরার ব্যাপারে সক্রিয় রয়েছে; তাদের এ উদ্যোগের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণও তারা নাগরিকদের সামনে তুলে ধরে নাগরিকদের মনে নিরাপত্তার বোধ তৈরি করেন।
বাংলাদেশের পুলিশের প্রধান সে কাজ না করে দায়িত্বপালনে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। সরকার এখানে কী পদক্ষেপ নেবেন তা দেখার আশায় রইলাম।
( প্রকাশিতঃ বিডিনিউজ২৪.কম, শওগাত আলী সাগর: টরন্টো থেকে প্রকাশিত ‘নতুনদেশ ডটকম’এর প্রধান সম্পাদক,)