নিলয় হত্যায় শ্রম প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা নাহিন আটক

নিলয় হত্যায় শ্রম প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা নাহিন আটক

অনলাইন ডেস্কঃ ১৩ আগস্ট ২০১৫

আইনশৃংখলা বাহিনী ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় হত্যাকাণ্ডে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সন্দেহভাজন কয়েকজন সদস্যকে নজরদারির আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। আর এ হত্যাকাণ্ড এবিটির সংশ্লিষ্টরাই করেছে বলে অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত সংস্থাগুলো। নিলয় হত্যাকাণ্ডের পর সন্দেহভাজন হিসেবে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। পাশাপাশি তার দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে অভিযানও চলছে বলে জানা গেছে। তবে প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা নিলয় হত্যায় জড়িত কিনা তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।

আইনশৃংখলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের খুনিদের একজন হলেন সাদ আল নাহিন। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই নাহিন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর ভাতিজা বলে জানা যায়। সাদ আল নাহিন এর আগেও ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিল। তাকে ওই সময় গ্রেফতারও করা হয়েছিল। পরে আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিতে সাদ আল নাহিন এবিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার আদ্যোপান্ত সব তথ্য দেয়। এদিকে, আটক এই সাদ আল নাহিন শ্রম প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা কিনা তা জানার জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি অসুস্থ বলে ফোন রিসিভ করেনি। পরে তার পিএস আমিরুল ইসলাম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নজরুল হক নান্নু প্রতিমন্ত্রীর ছোট ভাই বলে জানেন তিনি। সে হিসেবে নাহিন তার ভাতিজা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি বলেন, প্রতিমন্ত্রী অসুস্থ তাই বিশ্রামে আছেন। এ জন্য হয়তো ফোন রিসিভ করছেন না। তদন্ত সংস্থার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাদ আল নাহিন আসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগদানের পর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। সে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যা চেষ্টায় জড়িত ছিল। পরে আদালতে জবানবন্দি দেয়। এ মামলায় সে জামিনের পর আবার পুরনো বৃত্তে জড়িয়ে ‘তথাকথিত জিহাদি চেতনায়’ উদ্বুদ্ধ হয়।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্র জানায়, শুক্রবার রাজধানীর পূর্ব গোড়ানের ৮ নম্বর রোডের ১৬৭ নম্বর বাসায় ব্লগার নিলয় খুনে যে চারজন খুনিরা বর্ণনা তারা পেয়েছেন, তাদের মধ্যে সন্দেহভাজন বাঁ-হাতি আবদুল করিম ওরফে জাবেরের বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ০ এমনকি এবিটির খুনি দলে যারা আছে তার মধ্যে নাহিনও অন্যতম। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আটক করেছে বলে জানা গেছে। তবে ডিবি পুলিশের কোনো কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিক এ সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।
পরে নাহিনকে আটকের বিষয়ে তার বাবা নজরুল হক নান্নুর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি যুগান্তরের কাছে স্বীকার করে বলেন, ‘ডিবি পুলিশ তার ছেলে নাহিনকে আটক করেছে। নিলয় হত্যায়কাণ্ডে সে জড়িত আছে কিনা সে বিষয়ে ডিবি পুলিশ সন্দেহজনকভাবে তাকে আটক করে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আমি দাবি করছি আমার ছেলে জড়িত নয়।’ আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফোনে এ বিষয়ে কিছু বলব না। তিনি সাক্ষাতে এ বিষয়ে কথা বলতে চান।’
নিলয় হত্যার পর সাদ আল নাহিনকে আটকের বিষয়ে তার বাবা নজরুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘শুনেছি জিজ্ঞাবাদের জন্য আটক করেছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ডিবি পুলিশ ছেড়ে দিতে চেয়েছে কিনা এ বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো জানি না। আমি কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছি। দেখি কী হয়।’
জানা যায়, নজরুল হক নান্নু কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের দাহিয়া ইউনিয়ের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি দু’বার এ ইউনিয়ন থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাশাপাশি একজন শিক্ষকও।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সাদ আল নাহিনের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার মুন্সীবাড়িতে। নাহিন ঢাকায় পশ্চিম মিরপুরের কাফরুলের একটি বাসায় থাকতেন। তার জম্ম ১৯৯১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। এই নাহিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী। ২০১২ সালের মে মাসে সে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করে।
গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা গেছে, কাফরুলের ওই বাসায় থাকাকালীন মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর মসজিদে নামাজ পড়ার সময় পরিচয় হয় কাওসার হোসেন, কামাল হোসেন, কামাল সর্দার, কাওসারের ভাই নবীর হোসেনের সঙ্গে। পরে তাদের সঙ্গে সাদ আল নাহিনের খুব ঘনিষ্ঠশুরু হয়। একপর্যায় তারা সবাই ধর্মীয় নানা বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে স্বীকার করা তথ্যে নাহিন বলেছে, ধর্মীয় আলোচনা দিনের পর দিনে করার পর নবীর হোসেনের হাত ধরে আবদ করিম ওরফে জাবেরের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এই জাবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। তার মাধ্যমেই সে উগ্রপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায় সে খুন করার মতো অপরাধেও নিজেকে জড়ায়।
সাদ আল নাহিন তার দেয়া তথ্যে জানিয়েছে, ২০১২ সালের জুলাই মাসের প্রথম শুক্রবার সে আবদুল করিম ওরফে জাবেরের সঙ্গে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বছিলা রোডের একটি মাদ্রাসায় যায়। সেখান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানীর (নিষিদ্ধ এবিটির প্রধান) সঙ্গে দেখা করে তার বয়ান শুনে নিজেকে সে পথেই পরিচালিত করে। জসিম উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর আবদুল করিম ওরফে জাবেরের মাধ্যমে সে ক্বীতাবুল আকাইদ, ক্বীতাবুল তাওহিদ, দ্বীন কায়েমের সঠিকপথ ও ক্বীতাবুদ দু’আসহ বিভিন্ন বই বিক্রির মাধ্যমে ‘প্রকৃত ইসলাম’ প্রচারে উদ্বুদ্ধ হয়।
নাহিনের কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মুফতি জসিম ও তার শিষ্য আবদুল করিম ওরফে জাবেরের মাধ্যমে আরেক শিষ্য রেজওয়ানুল আজাদ রানার সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের মাধ্যমে সে জিহাদে উদ্বুদ্ধ হয়। আবদুল করিমের মাধ্যমে রানা এবং নকির সঙ্গে পরিচয়ের পর সে জানতে পারে, রানা হচ্ছে মুফতি জসিমের গোড়ার দিকের শিষ্য। একপর্যায় সে রানা ও করিমের সব কথা শোনা শুরু করে। এভাবেই সে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের একজন সক্রিয় সদস্য ও পরে গুরুত্বপূর্ণ অনেক দায়িত্ব পালন করে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, নিলয় হত্যার পর পরই তারা সাদ আল নাহিনের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া শুরু করে। একপর্যায় তার সন্ধ্যান পাওয়া যায়। পরে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে গোয়েন্দারা। নিলয় হত্যার বিষয়ে তার কাছে নানা তথ্য জানার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানায়, ‘বাঁ-হাতি আবদুল করিম ওরফে জাবের এবং তার সহযোগী হাসিব ও ফাহিমকে গ্রেফতারে চলছে অভিযান। পাশাপাশি অন্যান্য সন্দেহভাজনদের কয়েকজনকে নজরদারিতে আনা হয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরিবারের অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন সদস্যকে গ্রেফতার করলে কেউ কেউ প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ অভিযুক্ত হলে আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে রেহাই নেই। ( সুত্রঃ যুগান্তর)